১ অক্টোবর ২০১৭, রবিবার, ১২:২১

আজ প্রবীণ দিবস

বাবা-মা কিছু করেনি, এমন কথা বলো না প্লিজ...


স্বামী-স্ত্রী আর এলসেশিয়ান, জায়গা বড়ই কম, আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম...। প্রতি বছর প্রবীণ দিবসটি এলেই এই হৃদয়স্পর্শী গানের লাইনগুলো হৃদয়ে যেন শেল হয়ে বেঁধে।
প্লিজ বাবা-মা কিছু করেনি এমন কথা তাদের মুখের ওপর যেন কারো সন্তানেরা না বলে। বাবারে প্রবীণ বয়সে সন্তানদের মুখে এমন কথা তীè বর্শার মতো বুকে বেঁধে। দয়া করে কেউ তার বয়স্ক বাবা-মাকে যেন নাতি-নাতনী থেকে দূরে না রাখে। মাসে অন্তত একবার যেন সন্তানেরা তাদের বয়স্ক বাবা-মাকে একটু বাইরে বেড়াতে নিয়ে যায়, অফিস আছে কাজ আছে বলে যেন দুরে না সরিয়ে দেয়।

আজকের প্রজন্মের কাছে এভাবেই আকুতি জানালেন প্রবীণ মোহাম্মদ আবু তৈয়ব। আজকের সন্তানদের জন্য তার উপদেশ কী... বলার সাথে সাথে নিজের লেখা ডায়েরি খুলে কয়েক লাইন পড়ে শোনালেন। বললেন, একজন বাবা-মা অনেক কষ্ট করে সন্তানকে বড় করে তোলেন। কিন্তু জীবনের শেষ সময়ে যখন সন্তানেরা বলে, তোমরা কিছুই করনি, বোকা গর্দভের মতো কাজ করে গেছোÑ তখন মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। মনে হয় এর চেয়ে মরে যাওয়া ভালো।

পেশায় প্রকৌশলী ছিলেন মোহাম্মদ আবু তৈয়ব। তার ঠাঁই এখন আগারগাঁওয়ের প্রবীণ নিবাসের একটা ছোট্ট রুমে। দুইজনের এই রুমে ঠাঁই পাওয়া মোহাম্মদ আবু তৈয়বের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে। জীবন কেমনভাবে কেটে যাচ্ছে জানতে চাইলে রুমের এক কোণে কাপড়-চোপড়ে ঢেকে থাকা বারান্দার ফাঁকে আকাশ পানে চেয়ে দেখলেন কয়েকবার। এরপর মুখ খুললেন, এখানে কেমন আর থাকব? এটা কি কোনো প্রশ্ন হলো। সমস্যা আছে বলেই তো এখানে আছি। বললেন, ঢাকা শহরের অনেক সরকারি ভবন তার হাত দিয়েই হয়েছে। সন্তানেরা বেঁচে থাকতে কেন এখন এখানে আছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে নিজেকেই দোষারোপ করে বললেন, আমি হয়তো বেশি খারাপ, তাই এখানেই থাকতে হচ্ছে। আর বললেন মনটা ভালো নেই। কারণ হিসেবে জানালেন কয়েক দিন আগে এ রুমেই একজন রুমমেট মারা গেছেন।

মোহাম্মদ আবু তৈয়বের সাথে কথা বলতে বলতে প্রবীণ নিবাসের আরেক জনের সাথে পরিচয় হলো। ৭৮ বছর বয়সের এ মহিলার বাড়ি বরিশাল। নাম তার মেরি মাধুরি ফলিয়া। তার তিন মেয়ে এক ছেলে। সন্তানেরা সবাই ভালো চাকরি করছেন। সন্তানরা সবাই মিলে তাকে প্রবীণ নিবাসে রেখে গেছেন। এখানে সবাই আসেনও, খরচা-পাতিও দেন তারা। বড় মেয়ে সপ্তাহে দুই দিনই আসেন। ছেলেও এসে দেখে যান। কিন্তু তারপরেও কেন সন্তানেরা নিজের কাছে মাকে রাখছেন না? কেনই বা ছেলেমেয়েরা সন্তানদের সাহচর্যে এই বৃদ্ধাকে রাখেন না। জানতে চাইলে তিনি বললেন, জানি না, কি করা যাবে সন্তানেরা যদি আমাকে না রাখে কাছে। নাতি-নাতনীকে দেখতে কার না মন চায়? কিন্তু কী করব? কথাগুলো বলতে বলতে তার চোখ পানিতে টলমল করছিল। একপর্যায়ে গাল বেয়ে পড়তে গেলেই দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে ফেললেন বহমান চোখের পানি। বললেন মায়ের চোখের পানি মাটিতে পড়লে সন্তানদের অমঙ্গল হবে। মা হয়ে আমি তো সন্তানদের অমঙ্গল চাইতে পারি না...। কথাগুলো বলতে বলতে আঁচল ভিজে যাচ্ছিল চোখের পানিতে তারই মনের অজান্তে।

তার পাশেই আরেক খাটে বসে ছিলেন প্রায় ৭০ বছর বয়স্ক এক মহিলা। ক্ষণে ক্ষণে ভুলে যান সব কথা। রুমের এককোণে তার স্বামীর ছবি ঝুলিয়ে রেখেছেন। বললেন আইএলওর বড় কর্মকর্তা ছিলেন তিনি। তার নাম মিনা রীরা। এক সন্তান আছেন আমেরিকায়। যদিও তিনি এই প্রতিবেদককে বললেন ছয় মাস আগে এসে দেখে গেছেন, তবে পাশে থাকা একজন আয়া বললেন, চার বছরে তাকে কেউ দেখতে আসেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পাস করেছেন তিনি। তবে কোনো চাকরি করেননি।

এভাবেই প্রবীণদের শেষ জীবন কাটছে নিদারুণ একাকিত্বে। রাজধানীর এক কোণে থাকা এ প্রবীণ নিবাসে এসে তাদের সাথে কথা বলে কারো মন স্থির থাকে না। আগারগাঁওয়ের এই প্রবীণ নিবাসে আছেন ৪৬ প্রবীণ-প্রবীণা। শত কষ্ট আর বুক ফাটা আর্তনাদের মধ্য দিয়ে প্রতি বছর একটি দিবস ঘুরে ফিরে এসে একটু হলেও প্রবীণ-প্রবীণাদের নাড়িয়ে যায়। জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা ২০১৩ অনুযায়ী ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সের নারী-পুরুষরা প্রবীণ বলে গণ্য হবেন এবং ২০১৪ সালে প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে ‘সিনিয়র সিটিজেন’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ২৭তম আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস আজ। এবারের সেøাগান হচ্ছে আগামী পথে : প্রবীণের সাথে। দেশের প্রেক্ষাপটে বলা হচ্ছে বাংলাদেশসহ বিশ্বে প্রবীণদের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে। দেশে বর্তমানে ১.৪০ কোটি প্রবীণ আছেন, যে সংখ্যা ২০১৫ সালে প্রায় ২.৮০ কোটি, ২০৫০ সালে প্রায় ৪.৫০ কোটি এবং ২০১৬ সাল নাগাদ হবে প্রায় ৫.৬০ কোটি। জাতিসঙ্ঘের সিদ্ধান্তে ১৯৯১ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী ১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস পালন করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সঙ্ঘের মহাসচিব অধ্যাপক ড. এ এস এম আতীকুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, আজকের প্রবীণারাই আমাদের জন্ম দিয়েছেন। প্রতিপালন করে বড় করেছেন। গড়ে তুলেছেন এই আধুনিক সমাজ, সংস্কৃতি আর সভ্যতা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে এই প্রবীণ ব্যক্তিরাই ক্রমবর্ধমানহারে অবহেলিত, বঞ্চিত। অথচ বার্ধক্যের হাত থেকে বাঁচার কারো সাধ্য নেই। তিনি একটি প্রবীণ মন্ত্রণালয় গঠনের তাগিদ দেন।
দিবসটি উপলক্ষে আজ প্রবীণ হিতৈষী ও জরা বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হবে। সমাজকৃল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাথে যৌথ উদ্যোগে সকাল ১০টায় আগারগাঁওয়ের প্রবীণ ভবন থেকে সমাজসেবা অধিদফতর পর্যন্ত র্যা লি বের করা হবে। এ ছাড়া অধিদফতর মিলনায়তনে আলোচনা সভা হবে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/256293