পেছনে পড়ে আছে সহায়-সম্বল আর বসতভিটা। সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। শাহপরীর দ্বীপ দিয়ে প্রবেশ করছেন রোহিঙ্গারা
১ অক্টোবর ২০১৭, রবিবার, ১২:১৯

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী জোর করে স্বীকারোক্তি আদায় করছে রোহিঙ্গাদের

বাংলাদেশে আসতে চায় এমন রোহিঙ্গা মুসলমানদের মিয়ানমারের সেনাবাহিনী আটকে রেখে সেখানকার ‘সেনাবাহিনী মানুষ হত্যা করেনি’ এমন স্বীকারোক্তি আদায় করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গতকাল শনিবার মিয়ানমারের মংডু এলাকা থেকে শাহপরীর দ্বীপ হয়ে টেকনাফে যাওয়ার পথে রোহিঙ্গারা এমন কথা জানিয়েছেন। তারা বলছেন, তাদের অনেকে কোরবানির ঈদের আগে থেকে (২ সেপ্টেম্বর) মগবাহিনী দ্বারা বাড়িঘরসহ অন্যান্য স্থাপনা পুড়িয়ে ছাই করে দেয়ার পর এবং গুলি করে মানুষ হত্যার পর পাহাড়ে গিয়ে পালিয়ে ছিলেন। সেখান থেকে বের করে আমাদের নিয়ে আসে এবং দ্ইু দিন ক্যাম্পে আটকে রাখে। শেষ দিন মগবাহিনী এসে আমাদের শিখিয়ে দেয় যে গুলি করে রোহিঙ্গাদের কারা হত্যা করেছে সাংবাদিকেরা এমন প্রশ্ন করলে তার উত্তরে যেন বলি, ‘আমরা তাদের চিনি না’। মগ বাহিনী বলেছে, সাংবাদিকদের কাছে এই কথা বললেই তারা আমাদের বাংলাদেশ যেতে দেবে। কে রোহিঙ্গাদের হত্যা করেছে এ প্রশ্নের উত্তরে আমরা ‘কে হত্যা করেছে আমরা তাদের চিনি না’ এমন কথা বললে আমাদের থাকতে দেয়া হবে কিনা আমাদের একজন এটা জানতে চাইলে তাকে মগবাহিনী লাথি দেয় এবং হাতের লাঠি দিয়ে নির্দয়ভাবে পিটিয়েছে।

বুচিডংয়ের মাওলানা শাহীদুর রহমানের পুত্র মাহমুদুর রহমান (৪০) জানিয়েছেন, আমরা এক মাস পাঁচ দিন বাড়ি থেকে বের হয়ে পাশের পাহাড়ে জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে ছিলাম। আমরা দেখতে চাচ্ছিলাম মগ বাহিনী আমাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে চলে যায় কিনা। একই সাথে আমাদের সম্প্রদায়ের লোকদের হত্যা করা বন্ধ করে কিনা। এরা চলে গেলে আমরা আবার আমাদের বাড়িঘরে ফিরে যাবো। কিন্তু ঈদের দুই দিন পর মগ বাহিনী কিভাবে যেন জেনে যায় আমরা কাছের পাহাড়ে লুকিয়ে আছি। আমাদের তারা সেখান থেকে নিয়ে আসে। কোনো ধরনের মারধর অথবা কাউকে গুলি করেনি। এরা আমাদের দুই দিন পর এসে প্রস্তাব দেয়, রোহিঙ্গাদের কে হত্যা করেছে সাংবাদিকেরা এমন প্রশ্ন করলে উত্তরে আমরা যেন বলি তাদের আমরা চিনি না। এদের মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা ছিল তখন। এ সময় তারা আমাদের শান্ত থাকতে বলে। আমাদের একজন জিজ্ঞাসা করে আমরা এসব কথা বললে আমাদের এখানে থাকতে দেয়া হবে কিনা। এ কথা বলায় ওই লোকটাকে নির্দয়ভাবে মগ বাহিনী পিটিয়েছে বুট জুতা দিয়ে। মাহমুদুর রহমান বললেন, ‘এর এই অবস্থা দেখে আমরা আর সাহস করিনি কথা বাড়াতে। মগবাহিনী যা শিখিয়ে দিয়েছে আমরা কয়েকজন তা শান্ত থেকে সুন্দরভাবে বলে দিয়েছি।’ মাহমুদুর রহমান জানালেন, ভিডিও করার পর তারা আমাদের চলে যেতে বলেছে। আমরা ওদের ক্যাম্প থেকে বের হয়ে যাই এবং সন্ধ্যা নেমে এলে আমরা আবার সামনে এগিয়ে পাহাড়ে গিয়ে গাছ ও পাহাড়ের আড়ালে পথ চলতে থাকি। আমরা বুঝতে পারছিলাম আমরা কোথায় আছি তা তারা জেনে গেছে। সে জন্য দ্রুত স্থান ত্যাগ করলাম রাতের বেলায়।

মংডুর আহমদ হোসেনের পুত্র মহিবুল্লাহ (২২) জানান, তার পাঁচ বোন ও তিন ভাই ছিল। তারা কোথায় আছে তিনি বলতে পারবেন না। মগবাহিনী গুলি চালিয়ে রোহিঙ্গাদের হত্যা করার সময় সে বাড়িতে ছিলেন না। পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়ে এলে রাতের বেলা বাড়িতে গিয়ে কাউকেই পাননি তিনি। ঈদের পর পরই তাদের এলাকা আক্রান্ত হলেও মহিবুল্লাহ এত দিন পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য অপেক্ষা করেছেন। কাছের পাহাড়ে গিয়ে লুকিয়ে ছিলেন তিনি। মাদরাসাপড়–য়া মহিবুল্লাহ জানান, এত দিন অপেক্ষা করে অবশেষে পাঁচ দিন আগে রাতের বেলা লুকিয়ে লুকিয়ে গত রাতে (গত শুক্রবার) শাহপরীর দ্বীপের জেটি দিয়ে বাংলাদেশের মাটিতে এসে পড়েছি। ‘বাংলাদেশে কেমন থাকব জানি না, কিন্তু কেউ হত্যা করতে আসবে না এ নিশ্চিত।’ মুহিবুল্লাহ জানান, একদিন রাতের বেলা নাফ নদী অতিক্রমের চেষ্টা করলে মগ বাহিনী এখানেও হামলা চালায়।
হাসিম খান (৩৪) জানান, তার পরিবারসহ আরো ৫-৬টি পরিবারের প্রায় ৫০ জন মানুষকে বুচিডংয়ে আটকে রেখে স্বীকারোক্তি আদায় করে নেয় যে তাদের এলাকায় গুলি করে যারা মানুষ হত্যা করেছে তাদের তারা (রোহিঙ্গারা) চিনে না। যারা হত্যা করতে এসেছিল তাদের মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা ছিল। এরা বাংলা ও বর্মি ভাষায় কথা বলছিল। মগবাহিনী আমাদের শিখিয়ে দেয় যে যারা মানুষকে গুলি করে মেরেছে তারা আলিকিন (আল ইয়াকিন পার্টির সদস্য) হবে হয়তো। কারণ এরা মাঝে মধ্যে জিহাদের কথা বলছিল। হাসিম খান জানান, মগবাহিনী যেভাবে শিখিয়ে দিয়েছে আমরা সুন্দর করে সেভাবে ক্যামেরার সামনে বললে মগেরা আমাদের ছেড়ে দেয় এবং আমরা বাংলাদেশের দিকে চলতে থাকলে এরা আমাদের কিছু বলেনি। আপনাদের মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে গেছে কিনা প্রশ্ন করলে হাসিম খান জানান, কি নেবে এরা? আমাদের কাছে কিছু নেই। আমরা কিছু নিয়ে আসতে পারিনি। আমাদের বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে এরা। সেই সাথে আমাদের সব কিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কিছু বার্মিজ টাকা আমাদের ছিল, আমাদের মেয়েদের কিছু স্বর্ণ ছিল সেগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। গায়ের কাপড় চাপড় ছাড়া আর কিছু আমাদের সাথে নেই। নাফ নদী পার হওয়ার টাকাও আমাদের কাছে ছিল না। এ পারের কিছু মাওলানা আমাদের নদী পারের টাকা দিয়েছেন। হাসিম খান বললেন, বাংলাদেশের মানুষের উপকার কখনো ভুলতে পারব না। আমি শুনেছি টেকনাফের আশ্রয় শিবিরে বাংলাদেশের মানুষ অনেক খানাপিনা দিচ্ছে। পরনের কাপড় দিচ্ছে। অসুস্থতায় ওষুধ ও চিকিৎসা দিচ্ছে। আপনি এত কিছু জানেন কেমনে, আপনিতো আশ্রয়শিবিরে যাননি, জানতে চাইলে, হাসিম খান একটু হেসে বললেন, আমার আত্মীয়-স্বজনেরা মোবাইল ফোনে জানিয়েছেন, যারা আশ্রয়শিবিরে আগে থেকে চলে গেছে। তিনি একটি ছোট মোবাইল ফোন দেখিয়ে বললেন, এটা কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম। তিনি জানান, চার্জ দিতে না পারায় এটা এখন আর চলে না। দেখি আশ্রয়শিবিরে গিয়ে চলবে কিনা।
শাহপরীর দ্বীপে এমন আরো কয়েকজন ঠিক এভাবেই বলছিলেন, তাদের মিয়ানরমারের সেনাবাহিনী আটকে রেখে স্বীকারোক্তি আদায় করে নিয়েছে, সেনাবাহিনী তাদের হত্যা করেনি।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/256295