৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৮:৪৯

বিশ্বজনমত উপেক্ষা

জাতিসঙ্ঘসহ পশ্চিমা দেশগুলোর চাপ এবং বিশ্বজনমত উপেক্ষা করেই নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের পক্ষেই অবস্থান নিলো চীন ও রাশিয়া। আন্তর্জাতিক অঙ্গন ও দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েও ভেটো ক্ষমতার অধিকারী প্রভাবশালী এ দুই দেশকে নিরাপত্তা পরিষদে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে সম্মত করাতে পারেনি বাংলাদেশ; বরং চীন ও রাশিয়ার সমর্থনে বলিয়ান হয়ে মিয়ানমার নিরাপত্তা পরিষদে দম্ভভরে ঘোষণা করেছে, রাখাইনে কোনো জাতিগত নিধন বা গণহত্যা চালানো হচ্ছে না। রাখাইন সঙ্কট ধর্মীয় নয়; বরং সন্ত্রাসবাদের কারণে সৃষ্টি হয়েছে। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদ কোনো ব্যবস্থা নিলে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাবে।

রাখাইনে মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর নিধনযজ্ঞ থেকে বাঁচতে সীমান্ত পেরিয়ে আশ্রয় নেয়া নতুন-পুরনো মিলিয়ে ৯ লাখ রোহিঙ্গা নিয়ে অসহনীয় পরিস্থিতির কথা নিরাপত্তা পরিষদে তুলে ধরে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গাদের জন্য মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে একটি নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তোলার প্রস্তাবও দেয় বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদে ওই প্রস্তাব অনুমোদনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশেরই বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত চীন ও রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স নিরাপত্তা পরিষদে রাখাইনে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের নিধনে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর কড়া সমালোচনা করেছে ঠিকই। কিন্তু এ নৃশংসতা বন্ধ করে রাখাইনে নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তাব করেনি। ফলে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকের আয়োজনটির অর্জন কেবল বিতর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেল।

তবে এ অর্জনকেও খাটো করে দেখছেন না কূটনীতিকেরা। কেননা চীন ও রাশিয়ার বিরোধিতায় ২০০৯ সালের পর থেকে মিয়ানমার ইস্যুতে কোনো উন্মুক্ত আলোচনা সম্ভব হয়নি। নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার অজুহাতে গত অক্টোবর থেকে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ শুরু হওয়ার পর ইস্যুটি নিয়ে নিরাপত্তা কাউন্সিল চার দফা রুদ্ধদার বৈঠক করেছে। কিন্তু এসব বৈঠকের পর বিবৃতি দিতে বাধা দেয় চীন। তবে ২৫ আগস্টের পর রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দমন অভিযান সীমা ছাড়িয়ে গেলে এবং বাংলাদেশ সীমান্ত অভিমুখে উদ্বাস্তুদের বাধভাঙা স্রোত নেমে এলে বিশ্বজনমতের প্রেক্ষাপটে ১৪ সেপ্টেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর একটি কড়া বিবৃতি দেয়া হয়। নিরাপত্তা পরিষদের সব সদস্যের ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রায় ৯ বছর পর কোনো ইস্যুতে এমন বিবৃতি দেয়া সম্ভব হলো। বিবৃতিতে রাখাইন রাজ্যে চলমান সহিংসতায় চরম উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এ ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানানো হয়।

কূটনীতিকদের মতে, নিরাপত্তা কাউন্সিলে উন্মুক্ত বিতর্কে শক্ত কথাবার্তা বলা হলেও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া যায়নি ঠিকই, তবে এর মাধ্যমে দেশটির বিরুদ্ধে শক্তিশালী বার্তা পৌঁছে দেয়া হয়েছে। এটি সঙ্কট সমাধানে রাজনৈতিক সংলাপ শুরুর একটি প্রেক্ষাপট তৈরি করতে পারে। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা রাখাইন রাজ্যের সঙ্কট নিরসনে মিয়ানমার সরকার গঠিত কমিশনের বক্তব্য শুনতে আগামী সপ্তাহে জাতিসঙ্ঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানকে আমন্ত্রণ জানানোর পরিকল্পনা করছে। কফি আনানের নেতৃত্বে এ কমিশন গঠন করেছিলেন মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় পরামর্শক অং সান সু চি। এ কমিশন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়ার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করাসহ তাদের অবাধ চলাফেরার স্বাধীনতা, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ মৌলিক অধিকার নিশ্চিতের সুপারিশ করে। কিন্তু আনান কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশের পর দিনই রাখাইনে পুলিশ স্টেশন ও সেনাছাউনিতে সন্ত্রাসী হামলার অভিযোগ তুলে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ শুরু করে মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনী। আনান কমিশনের প্রতিবেদনকে অকার্যকর করা এবং রাখাইন রাজ্যকে রোহিঙ্গামুক্ত করার লক্ষ্য সামনে রেখেই মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনী পরিকল্পিতভাবে এ হামলার ঘটনা সাজিয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।

মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে সতর্ক পশ্চিমারা : মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারেÑ এমন আশঙ্কায় সতর্ক ছিল পশ্চিমা দেশগুলো। আর এর ইঙ্গিত মিলেছিল মিয়ানমার সফর শেষে বাংলাদেশে আসা ব্রিটেনের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মার্ক ফিল্ডের বক্তব্যে। গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, সু চির সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার পরিবর্তে কূটনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানের দিকে যাওয়া উচিত। কেননা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সু চি ব্যর্থ হলে সেনাবাহিনী সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হবে। তাতে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতে পারে। সু চি আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ চাপের মধ্যে একটি উপযুক্ত পথ বের করার চেষ্টা করছেন।

মিয়ানমারের পক্ষে চীন ও রাশিয়ার অবস্থানের নেপথ্যে : আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার চাপে ২০১৫ সালে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয় মিয়ানমারের সামরিক জান্তা। এর আগে বেশ কয়েক দশক ধরে সামরিক বাহিনী মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে রাখে, গৃহবন্দী করে রাখে গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চিকে। নির্বাচনে সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমক্র্যাসি (এনএলডি) ক্ষমতায় আসে ঠিকই, কিন্তু সংসদের এক-তৃতীংশ আসন, প্রতিরক্ষা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলো হাতে রেখে দেয় সামরিক বাহিনী। ফলে সু চি সামরিক বাহিনী পরিবেষ্টিত থেকেই রাষ্ট্র পরিচালনা করতে থাকেন।

বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা অবস্থায় অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে চীনের ওপর নির্ভরশীল ছিল মিয়ানমার। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রাকৃতিক সম্পদসমৃদ্ধ মিয়ানমারে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করে চীন। পাইপ লাইনের মাধ্যমে গ্যাস নেয়া, গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন ও অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে মালাক্কা প্রণালীর বিকল্প গড়ে তোলা এবং অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করে মিয়ানমারে ব্যাপক বিনিয়োগের ক্ষেত্র সৃষ্টি করে চীন। অন্য দিকে রাশিয়াও মিয়ানমারের ওপর পশ্চিমাদের প্রভাব বিস্তার যতটা সম্ভব রুখতে চায়। সেই সাথে মিয়ানমারের প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে আগ্রহী দেশটি।
সু চি ক্ষমতা নেয়ার পরও মিয়ানমার অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে চীনের ওপর নির্ভরশীল থেকে যায়। নিরাপত্তা পরিষদ বিরূপ কোনো পদক্ষেপ যাতে নিতে না পারে, সে জন্য চীন ও রাশিয়ার সম্পর্ককে কাজে লাগায় মিয়ানমার। আর তারই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সাথে সুসম্পর্ক থাকার পরও মিয়ানমারের পক্ষে নিরাপত্তা পরিষদে প্রকাশ্যে অবস্থান নিলো বিশ্বের এ দুই বৃহৎ শক্তি।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/255923