২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শুক্রবার, ১১:৫৯

নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকের প্রাক্কালে চাতুর্যের কৌশল মিয়ানমারের

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের রোহিঙ্গা বিষয়ক বৈঠকের প্রাক্কালে চাতুর্যের কৌশল নিয়েছে মিয়ানমার। গতকাল বৃস্পতিবার নিউইয়র্ক সময় দুপুরে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ‘জাতিগত নিধনকান্ড’ পরিচালনার দায়ে সু চির দেশের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ঠিক এমন সময় মিয়ানমার নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের রাখাইনে পুনর্বাসন করার ঘোষণা দিয়েছে। এর আগে বাংলাদেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকগণ, একে মিয়ানমারের সময়ক্ষেপণের কৌশল বলে মনে করছেন।

অথচ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী দমন-পীড়নে ক্রমশই বেপরোয়া হয়ে ঊঠেছে মিয়ানমার। মুখে তারা রাখাইন রাজ্যে নৃশংসতার কথা অস্বীকার করলেও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও গণমাধ্যমের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা নিরীহ রোহিঙ্গাদের নির্মূলে কতটা বর্বরতা প্রদর্শন করেছে। বিশ্বব্যাপী এ ইস্যূতে নিন্দা-প্রতিবাদের ঝড় অব্যাহত রয়েছে। তারপরও মিয়ানমার শান্তিকামী ও মানবতাবাদী বিশ্বকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তাদের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকের দিনও জাতিসংঘের তদন্ত দলকে রাখাইনে ঢুকতেই দিলো না দেশটির সরকার। বিশ্লেষকরা বলছেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে শান্তিতে নোবেলজয়ী সু চির সরকার জাতিসংঘসহ বিশ্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে।

এদিকে, নিউইয়র্কে যখন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের রোহিঙ্গা বিষয়ক বৈঠকের আয়োজন, ঠিক সে সময়ও যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের পাশে থাকার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আশা করা হচ্ছে, চীন ও রাশিয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে বাংলাদেশকে সমর্থন ও সহযোগিতা করবে। এছাড়া গতকাল বৃহস্পতিবার চীন ও ভারত থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ এসে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছেছে।

উল্লেখ্য, গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের মগ সেনারা তথাকথিত ক্লিয়ারেন্স অপারেশনের নামে রাখাইন রাজ্যের নিরীহ রোহিঙ্গাদের ওপর দমন-পীড়ন শুরু করে। হত্যা-ধর্ষণের মতো বর্বরোচিত ঘটনা ঘটায় মগ সেনারা। আগুনে পুড়িয়ে দেয় রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলো। প্রাণ বাঁচাতে রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুরা দল বেঁধে নাফ নদী ও সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী কক্সবাজারের অস্থায়ী ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে বলে ধারণা করা হয়। জাতিসংঘ জানিয়েছে, স্থানীয় বৌদ্ধদের সহযোগিতায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী ‘জাতিগত নিধনকান্ড’ চালাচ্ছে। মিয়ানমার সরকার জাতিসংঘের অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

আরো উল্লেখ্য, ১৯৮২ সালের বিতর্কিত বর্ণবাদী নাগরিকত্ব আইনে মিয়ানমারের প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার নাগরিকত্ব অস্বীকার করা হয়। এতে মিয়ানমারে বসবাসকারীদের ‘সিটিজেন’, ‘এসোসিয়েট’ এবং ‘ন্যাচারালাইজড’ পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। এমনকি দেশটির সরকার তাদের প্রাচীন নৃগোষ্ঠী হিসেবেও স্বীকৃতি দেয়নি অষ্টম শতক থেকে বসবাসকারী এসব জনগোষ্ঠীকে। ১৮২৩ সালের পরে আগতদের ‘এসোসিয়েট’ আর ১৯৮২ সালে নতুনভাবে দরখাস্তকারীদের ‘ন্যাচারালাইজড’ বলে আখ্যা দেয়া হয়। ওই আইনের ৪ নম্বর প্রভিশনে আরও শর্ত দেয়া হয়, কোনও জাতিগোষ্ঠী রাষ্ট্রের নাগরিক কি না, তা আইন-আদালত নয়; নির্ধারণ করবে সরকারের নীতি-নির্ধারণী সংস্থা ‘কাউন্সিল অব স্টেট’। এ আইনের কারণে রোহিঙ্গারা ভাসমান জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত হয়।

হংকংভিত্তিক এশিয়া টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রাখাইন রাজ্যে বর্তমানে ৭০ ব্যাটালিয়নেরও বেশি মিয়ানমার সেনা অভিযান চালাচ্ছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের ধারণা, রাখাইনে সব মিলিয়ে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার সেনা অবস্থান করছে। যদিও স্বাধীনতাকামী রোহিঙ্গাদের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিকে (আরসা) দমন করার জন্য সেনা অভিযান চালানোর দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু রাখাইনের মুসলিম প্রধান তিনটি টাউনশিপ (জেলা) জনমিতি বদলে দেয়ার জন্য এত বিপুলসংখ্যক সেনাকে মোতায়েন করা হয়েছে।

রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য গতকাল নিউইয়র্ক সময় দুপুরে বৈঠকে বসেছে ১৫ সদস্যের জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সেখানে মিয়ানমারের পরিস্থিতি তুলে ধরবেন। বাংলাদেশও সেখানে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরবে বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী জানিয়েছেন। সর্বশেষ ১৩ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের জাতিসংঘ সদর দফতরে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে। এতে দীর্ঘ ৯ বছর পর নিরাপত্তা পরিষদের সব সদস্যের ঐকমত্যের ভিত্তিতে দেয়া এক অনানুষ্ঠানিক বিবৃতিতে রাখাইন রাজ্যে চলমান সহিংসতায় চরম উদ্বেগ ও নিন্দা জানানো হয়।

বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও শান্তিকামী দেশগুলো মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তাবও করেছে। কূটনীতিকরা বলছেন, পরিস্থিতির উন্নতি না হলে একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়ার বিষয়ে ভাববে নিরাপত্তা পরিষদ। তবে মিয়ানমারের মিত্র চীন ও রাশিয়া এ বিষয়ে জোরালো কোনো প্রস্তাব গ্রহণের বিরোধিতা করতে পারে। যদিও চীন ও ভারত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ পাঠিয়েছে।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশ রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে মিয়ানমার সরকারের সমালোচনায় সোচ্চার হলেও চীন ও রাশিয়া রয়েছে উল্টো অবস্থানে। স্বাধীনতাকামী রোহিঙ্গাদের দমনের নামে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওই অভিযানকে সমর্থন জানিয়ে আসছে তারা।

নিরাপত্তা পরিষদে কোনো প্রস্তাব পাস করতে ১৫ সদস্য দেশের মধ্যে অন্তত নয় দেশের সমর্থনের পাশাপাশি পাঁচ স্থায়ী সদস্য চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের অনাপত্তি দরকার হয়। বর্তমানে মিসর, ইতালি, জাপান, সুইডেন, বলিভিয়া, ইথিওপিয়া, কাজাখস্তান, সেনেগাল, ইউক্রেইন ও উরুগুয়ে নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য।

যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য গতকালও রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশের পাশে থাকার কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে বলে দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে চাপ তীব্রতর করতে একযোগে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছে কানাডাও।

এদিকে, রাখাইনে জাতিগত নিধনকান্ডের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে রোহিঙ্গাদের জাতীয় যাচাইকরণ কার্ড (ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড- এনবিসি) প্রক্রিয়া শিগগির শুরু করবে মিয়ানমার সরকার। গতকাল মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সমাজকল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী ড. উইন মিয়াত আয়ই এ কথা জানিয়েছেন। তবে মিয়ানমার সরকারের দৃষ্টিভঙ্গী বিচারে সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গারা পুনর্বাসিত হবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

সরকার পরিচালিত সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে ফ্রন্টিয়ার মিয়ানমার জানায়, সমাজকল্যাণমন্ত্রী জানিয়েছে মংডু শহরের টাউংপাইয়ু লেটিয়ার গ্রামে শিগগিরই এই যাচাইকরণ প্রক্রিয়া শুরু হবে। এখানে সড়ক পথে বাংলাদেশ থেকে যারা ফিরবে তাদের যাচাইকরণ প্রক্রিয়া অনুষ্ঠিত হবে। আর যারা নৌপথে ফিরবেন তাদের যাচাই প্রক্রিয়া অনুষ্ঠিত হবে মংডুর উত্তরে অবস্থিত নগা খু ইয়া গ্রামে।

ড. উইন মিয়াত আয়ই বলেন, যাচাই প্রক্রিয়া শেষে শরণার্থীদের দার গায়ই জার গ্রামে পুনর্বাসিত করা হবে। মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা ও ডি ফ্যাক্টো নেতা অং সান সু চির ঘোষণা পুনর্ব্যক্ত করেছেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী। তিনিও জানান, ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ- মিয়ানমারের স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুসারেই শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেয়া হবে।

বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ১৯৯৩ সালের চুক্তি অনুযায়ী কেবল মিয়ানমারের বৈধ কাগজপত্রসহ নিবন্ধিতরাই ফিরতে পারবে রাখাইনে। অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক সংবাদমাধ্যম এবিসি নিউজ পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে মাত্র ৫৮০০ জন নিবন্ধিত। তারাও সবাই রাখাইনে ফিরতে পারবে, এমন নয়। কেন না নিবন্ধিত হওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে নাগরিকত্বের প্রমাণ থাকা ব্যক্তিরাই কেবল ফিরে যেতে পারবেন।

ফ্রন্টিয়ার মিয়ানমারের ২০১৫ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী রাখাইনে তখন থাকা ১০ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড পেয়েছিল ৭ হাজার ৫৪৮জন। এর বাইরে আর কোনও কাগজপত্রই রোহিঙ্গাদের নেই। তাই ৭ হাজার ৫৪৮ জনের বেশি মানুষের মিয়ানমারে ফেরার কোনও সুযোগ নেই।

এদিকে, রোহিঙ্গা বিষয়টি এখন আর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের দ্বিপাক্ষিক বিষয় নয়। এটি এখন আন্তর্জাতিক ইস্যু। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে রোহিঙ্গা সঙ্কটের মূল কারণগুলো তুলে ধরে এর নিরসনে পাঁচ দফা প্রস্তাব বিশ্ব নেতাদের সামনে তুলে ধরেন। প্রস্তাবগুলো হলো - অবিলম্বে এবং চিরতরে মিয়ানমারে সহিংসতা ও ‘জাতিগত নিধন’ নিঃশর্তে বন্ধ করা; অবিলম্বে মিয়ানমারে জাতিসংঘের মহাসচিবের নিজস্ব একটি অনুসন্ধানী দল প্রেরণ করা; জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান করা এবং এ লক্ষ্যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সুরক্ষা বলয় গড়ে তোলা; রাখাইন রাজ্য হতে জোরপূর্বক বিতাড়িত সকল রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে তাদের নিজ ঘরবাড়িতে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা এবং কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালার নিঃশর্ত, পূর্ণ এবং দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। মিয়ানমার সরকারের উচিত হবে, শেখ হাসিনার প্রস্তাবকে ভিত্তি ধরে রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে মিয়ানমারের আন্তরিকতা প্রদর্শন করা।

মুসলিম রোহিঙ্গাদের নাগরিক এবারে মানতে নারাজ মিয়ানমারে সরকার এদের ফেরত নিতে অনীহা দেখিয়ে আসছিল। তবে এবারের সহিংসতায় সমালোচনার মুখে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি যাচাই সাপেক্ষে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া এই রোহিঙ্গাদের নাগরিক পরিচয় কীভাবে যাচাই হবে, সেই প্রশ্ন উঠেছে। সু চি বলেছেন, ১৯৯২ সালে দুই দেশের চুক্তি অনুযায়ী যে নীতিতে যাচাই হয়েছিল, এবারও তার ভিত্তিতেই হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জাতিসংঘের নেতৃত্বেই পরিচয় যাচাইয়ের কাজটি করার প্রস্তাব দিয়েছেন তারা। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য মিয়ানমারের মিনিস্টার অব দি অফিস ও স্টেট কাউন্সেলর কিও তিন্ত সোয়ের আগামী সপ্তাহে বাংলাদেশ সফরে আসার কথা রয়েছে।

জাতিসংঘের তদন্ত দলকে রাখাইনে ঢুকতেই দিলো না মিয়ানমার : নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকের দিনই জাতিসংঘের এক অনুসন্ধানী দলকে রাখাইনে প্রবেশ করতে দেয়নি মিয়ানমার। ডি ফ্যাক্টো সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসংঘের পরিকল্পিত এই সফর বাতিল করে দেয়া হয়েছে। জাতিসংঘের একজন মুখপাত্রকে উদ্ধৃত করে বৃটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি গতকাল এই খবর নিশ্চিত করেছে। ওই মুখপাত্র জানিয়েছেন, সফর বাতিলের কোনও কারণ জানায়নি মিয়ানমার।

ওই অনুসন্ধানী দল মিয়ানমারে প্রবেশ করতে পারলে ২৫ আগস্টের রাখাইন সহিংসতার পর সেটাই হতো জাতিসংঘের প্রথম সফর। সেই সহিংসতার পর সেনাবাহিনী অভিযান জোরালো করার পাশাপাশি জাতিসংঘের ত্রাণ কর্মীদের জোরপূর্বক রাখাইন থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। এবার তদন্ত দলকে সেখানে প্রবেশ করতে দেয়া হলো না। ইয়াঙ্গুনে জাতিসংঘের একজন মুখপাত্র বিবিসিকে বলেছেন, কোনও কারণ ছাড়াই নির্ধারিত ওই সফর বাতিল ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ।

মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের ঘটনাকে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন ইতোমধ্যে ‘জাতিগত নির্মূলের পাঠ্যপুস্তকীয় দৃষ্টান্ত’ আখ্যা দিয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব প্রশ্ন তুলেছেন দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ দেশ ছাড়তে বাধ্য হলে তাকে ‘জাতিগত নিধনকান্ড’ ছাড়া আর কী নামে ডাকা হবে। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়ন ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণকে রোহিঙ্গা তাড়ানোর অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগও এনেছে জাতিসংঘ। তবে কোনভাবেই আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের সেখানে প্রবেশাধিকার দিচ্ছে না তারা।

রোহিঙ্গাদের জন্য আরও সহায়তার আশ্বাস যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্রের : নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের জন্য আরও চার কোটি ৬২ লাখ ডলার সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে যুক্তরাজ্য সরকার ৩০ মিলিয়ন পাউন্ড (৪ কোটি ২ লাখ ৭৬ হাজার ডলার) দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যা মিয়ানমার ও বাংলাদেশে ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের জন্য ব্যয় করা হবে। আর যুক্তরাষ্ট্র ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের (ইউএসএআইডি) মাধ্যমে দেবে আরও ৬০ লাখ ডলার, যা জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডাব্লিউএফপি) মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় ব্যয় হবে।

যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ বিষয়ক দফতরের প্রতিমন্ত্রী মার্ক ফিল্ড এবং আন্তর্জাতিক সহায়তা বিভাগের প্রতিমন্ত্রী অ্যালিস্টার ব্রুটের নেতৃত্বে নয় সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল গতকাল সচিবালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া এবং ত্রাণ সচিব শাহ কামালের সঙ্গে বৈঠক করে অর্থ সহায়তার বিষয়টি জানান।

মন্ত্রী মায়া পরে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য যুক্তরাজ্য এর আগে ৫ দশমিক ৯ মিলিয়ন পাউন্ড সহায়তার ঘোষণা দিয়েছিল। তারা আরও ৩০ মিলিয়ন পাউন্ড দেবে এবং ভবিষ্যতেও সহায়তা অব্যাহত রাখবে। তাদের (যুক্তরাজ্যের প্রতিমন্ত্রী) বলেছি, সমস্যাটা মিয়ানমারের, তাদেরই এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। সম্মানের সঙ্গে তাদের নাগরিকত্ব দিয়ে দেশে ফিরিয়ে নিতে হবে। তারা বলেছেন, যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের পাশে থাকবে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট গত ২০ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে ত্রাণমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রোহিঙ্গাদের জন্য দুই কোটি ৮০ লাখ ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। গতকাল ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ইউএসএআইডির মাধ্যমে আরও ৬০ লাখ ডলার সহায়তার ঘোষণা দেয়া হয়।

যুক্তরাষ্ট্র এ নিয়ে চলতি বছর রোহিঙ্গাদের জন্য প্রায় দশ কোটি দশ লাখ ডলারের সহায়তার ঘোষণা দিল জানিয়ে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ছাড় করা অর্থ ইউএসএআইডি বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে কক্সবাজারে ব্যয় করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ সরকার আপাতত আশ্রয় দিলেও রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। বৃটিশ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাতের পর ত্রাণমন্ত্রী মায়া সাংবাদিকদের বলেন, বর্তমানে ১০ লাখের মত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে বসবাস করছে। মানবিক বিবেচনা করে সাধ্যমত তাদের আশ্রয়, থাকা-খাওয়া ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে কুতুপালংয়ে দুই হাজার একর জমি চিহ্নিত করা হলেও সেখানে সবার সঙ্কুলান হবে না বলে মনে করছেন ত্রাণমন্ত্রী। তিনি বলেন, যখন দুই থেকে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল তখন ওই জায়গা ঠিক করা হয়েছিল। এখন লোক বেড়েছে, ওই ছোট জায়গায় তাদের রাখা সমীচীন মনে করি না। সেখানে পাঁচ হাজার একর জায়গা আছে, প্রয়োজনে আরও জায়গা আমরা বরাদ্দ দিতে পারব।

ত্রাণ সচিব বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য অবকাঠামোগত সহযোগিতার পাশাপাশি খাদ্য সহায়তা দেয়া হবে বলে যুক্তরাজ্যের প্রতিমন্ত্রীরা আশ্বাস দিয়েছেন।

রোহিঙ্গাদের দীর্ঘ সময় বাংলাদেশে রাখতে হলে তাদের ভাসান চরে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে জানিয়ে মায়া বলেন, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি ও বান্দারবানের পরিবেশ আমাদের রক্ষা করতে হবে। নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসান চরে রোহিঙ্গাদের রাখতে নৌবাহিনী কাজ শুরু করেছে জানিয়ে ত্রাণমন্ত্রী বলেন, সেখানে ১০ থেকে ১২ হাজার একর জমি আছে।

ওই চর রোহিঙ্গাদের রাখার জন্য প্রস্তুত করতে চার থেকে পাঁচ বছর সময় লাগবে বলে ত্রাণসচিব শাহ কামাল জানান।

সু চির সঙ্গে কথা বললেন বৃটিশ প্রতিমন্ত্রী : রোহিঙ্গাদের দুর্দশা লাঘবে সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির প্রতি আহবান জানিয়েছে বৃটিশ পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মার্ক ফিল্ড। গতকাল মিয়ানমারের রাজধানী নেইপিদাওতে অং সান সু চির সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন। পরে বৈঠক শেষে তিনি সু চিকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে যুক্তরাজ্য সরকারের উদ্বেগের কথা জানান।

সম্প্রতি মিয়ানমার সফর করা প্রতিমন্ত্রী মার্ক ফিল্ড বলেছেন, রাখাইনে সহিংসতা বন্ধ করে মানবিক সহায়তা দেয়ার যে আহ্বান জাতিসংঘ দিয়েছে তা মিয়ানমারের নেত্রীকে সাড়া দিতে হবে। গণতন্ত্রে ফেরার পথে গত কয়েক বছরে যে অগ্রগতি মিয়ানমার অর্জন করেছে, রাখাইনের ঘটনা প্রবাহে তা ভেস্তে যেতে পারে বলেও সতর্ক করেছেন তিনি।

সেনা শাসনের মধ্যে দীর্ঘদিন গৃহবন্দী জীবন কাটিয়ে অহিংস গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য নোবেল পাওয়া সু চি ২০১৫ সালের নির্বাচনে মিয়ানমারের ক্ষমতায় আসেন। কিন্তু রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধের পদক্ষেপ না নেয়ায় পশ্চিমা মিত্রদের কাছেও এখন তিনি সমালোচিত হচ্ছেন।

ভারত ও চীন থেকে এসেছে আরো ত্রাণ : রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনার দিনে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের জন্য ভারত ও চীনের সাড়ে সাতশ টন ত্রাণ চট্টগ্রামে পৌঁছেছে। এর মধ্যে ভারত থেকে তৃতীয় চালানে ৭০০ টন ত্রাণ নিয়ে ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ আইএনএস ঘড়িয়াল গতকাল ভোর পাঁচটায় চট্টগ্রাম বন্দরের ১ নম্বর জেটিতে পৌঁছায়। আর চীন থেকে পাঠানো দ্বিতীয় চালানে সাড়ে ৫৩ টন ত্রাণ নিয়ে একটি উড়োজাহাজ সকালে ৯টার দিকে চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে নামে।

বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাই কমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে তার সরকারের পাঠানো ত্রাণ চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক জিল্লুর রহমান চৌধুরীর কাছে হস্তান্তর করেন। ভারত থেকে তৃতীয় দফায় আসা এই ত্রাণের চালানে চাল, ডাল, লবণ, চিনি, চা, গুঁড়ো দুধ, বিস্কুট, সাবান ও মশারি রয়েছে। রোহিঙ্গাদের জন্য ভারত থেকে মোট সাত হাজার টন ত্রাণ দেয়ার পরিকল্পনার কথা এর আগে জানিয়েছিলেন হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা।

একই দিন চীন থেকে আসা দ্বিতীয় চালানে রয়েছে তিন হাজার কম্বল। বাংলাদেশে চীন দূতাবাসের ইকোনমিক অ্যান্ড কমার্শিয়াল কাউন্সেলর লি গুয়াংজুন বিমানবন্দরে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের কাছে এই ত্রাণ হস্তান্তর করেন।

মিয়ানমারের মিত্র চীন ও ভারত রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের দমনে দেশটির সরকারকে সমর্থন দিলেও পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীর অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের সংস্থানে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য এখন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ, রেডক্রস ও রেড ক্রিসেন্টের দেয়া মোট এক হাজার ৩০৩ টন ত্রাণ চট্টগ্রামে পৌঁছেছে। এর মধ্যে ভারত দুটি বিমান ও একটি জাহাজে ৮০৭ টন, চীন দুটি বিমানে ১১০ দশমিক ৫৩ টন, সৌদি আরব একটি বিমানে ৯৪ টন, ইন্দোনেশিয়া আটটি বিমানে ৭৭ টন, ইরান দুটি বিমানে ৬৮ টন, মরক্কো একটি বিমানে ১৪ টন ও মালয়েশিয়া একটি বিমানে ১২ টন ত্রাণ পাঠিয়েছে। এছাড়া মালয়েশিয়ার রেড ক্রিসেন্ট ১০১ দশমিক ৫ টন ও জাপানি রেডক্রস ১৮ দশমিক ৫ টন ত্রাণ পাঠিয়েছে বাংলাদেশে।

সু চিকে কড়া ভাষায় চিঠি কানাডীয় প্রধানমন্ত্রীর : মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চিকে কড়া ভাষায় একটি চিঠি দিয়েছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। এতে তিনি রোহিঙ্গাদের ওপর ‘বর্বর নিপীড়নে’ হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। রোহিঙ্গা সংকটের শুরুতেই পাশ্চাত্যের যে গুটিকয়েক নেতা এ নিয়ে সরব হয়েছেন, তাদের অন্যতম কানাডার উদারপন্থী প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো। তিনি চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সু চিকে ফোন করেও তার গভীর উদ্বেগের কথা জানান। এরপর ১৮ সেপ্টেম্বর তিনি সু চিকে একটি চিঠি লেখেন। তবে সেই চিঠি এখন প্রকাশ্যে এসেছে।

সু চিকে কানাডা সরকার সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দিয়েছে। সেই বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করে ট্রুডো লিখেছেন, আমি গভীর হতাশা, বিস্ময় ও ক্ষোভের সঙ্গে আপনাকে জানাতে চাই, কানাডার অন্য নাগরিকরা লক্ষ করছেন মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর বর্বর নিপীড়ন চলছে অথচ আপনি মুখ বুজে রয়েছেন।

তিনি লিখেছেন, তারা যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন এবং মিয়ানমারের সব সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীর সুরক্ষা নিয়ে আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ মানবাধিকার লংঘন ও আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করে স্থলমাইন বসানোর কথা উল্লেখ করে ট্রুডো লিখেছেন, এগুলো মানবতাবিরোধী অপরাধ। ট্রু–ডো লিখেছেন, জাতিসংঘ বলেছে রাখাইনে যা চলছে তা ‘জাতিগত নিধনের এক পাঠ্যপুস্তকীয় দৃষ্টান্ত’। এটি অস্বীকার করার উপায় নেই।

http://www.dailysangram.com/post/301513