২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:৫৭

ব্যাংকে আমানত কমছে ঋণের চাহিদাও নেই

সুদের হার কমতে কমতে একেবারে তলানিতে নেমেছে। ব্যাংকে টাকা রাখলে এখন নামমাত্র সুদ মেলে।
মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় এই সুদহার কিছুই নয়। এ জন্য অনেকেই এখন টাকা ব্যাংকে রাখছে না। ফলে আগের মতো বাড়ছে না আমানত। এর চেয়েও খারাপ খবর হলো, কম সুদেও ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ আমানত পাচ্ছে, সেটাও ঋণ হিসেবে বিতরণ করতে পারছে না। নতুন করে বিনিয়োগ চাহিদা না থাকায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ব্যাংকগুলোর কাছে দীর্ঘদিন ধরেই বিনিয়োগ করার মতো পর্যাপ্ত তহবিল রয়েছে। কিন্তু সে তুলনায় চাহিদা কম। এ কারণে নতুন করে তহবিল সংগ্রহে আগ্রহ নেই অনেক ব্যাংকেরই।
বিনিয়োগ না বাড়ায় আমানত নিয়ে ওই অর্থ বসিয়ে রেখে সুদ দিতে রাজি নয় ব্যাংকগুলো।
সুদ কম হলেও ঋণের চাহিদা কম থাকার কারণ জানতে চাইলে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আনিস এ খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিনিয়োগের চাহিদা তো থাকতে হবে। চাহিদা না থাকলে ঋণটা কাকে দেব? লোকজনের ঋণের দরকার হচ্ছে না। বাড়িঘর করতেও লোকজন আগের মতো ঋণ নিচ্ছে না। কত অ্যাপার্টমেন্ট তো খালি পড়ে আছে। বিক্রি নেই। শিল্পোদ্যোক্তারা আর কোথায় বিনিয়োগ করবেন? গত কয়েক বছরে বড় খাতগুলোতে অনেক বিনিয়োগ হয়েছে। সিমেন্ট ফ্যাক্টরি হয়েছে, কল-কারখানা হয়েছে। পণ্যের চাহিদা না থাকলে কত আর উৎপাদন করবেন শিল্পোদ্যোক্তারা। ’
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের ব্যাংকের ঋণের প্রবৃদ্ধি আগে ছিল ২২-২৩ শতাংশ। এখন ১৬-১৭-র বেশি হচ্ছে না। ’
ঋণের সুদহার কম থাকায় তহবিল খরচ কমাতে স্বল্প সুদের আমানতের দিকে ঝুঁকছে ব্যাংকগুলো। এ বিষয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, ‘আমরা আমানত কম নিচ্ছি না। যতটুকু দরকার ততটুকুই নিচ্ছি। তবে সেগুলো যতটা সম্ভব কাসার মাধ্যমে নেওয়ার চেষ্টা করছি। কাসা হলো কারেন্ট অ্যাকাউন্ট অ্যান্ড সেভিংস অ্যাকাউন্ট। এ ধরনের আমানতের সুদহার কিছুটা কম। আমাদের ৬০ শতাংশ আমানতই কাসার মাধ্যমে আনা। আমরা বড় আমানত নিচ্ছি না। এটা করলে আমাদের তহবিল খরচ বেড়ে যেত। সম্পদ-দায় ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী হতো না। ’
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে যখন আমানতের সুদহার ৮ শতাংশের বেশি ছিল, তখন আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল এখনকার তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। ২০১৪ সালের জুনে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৬.৩৭ শতাংশ। তার পর থেকে সুদের হার যত কমছে, ব্যাংকে আমানতের প্রবৃদ্ধিও তত কমছে। ২০১৫ সালের জুনে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে ১২.১৭ শতাংশে নামে। সর্বশেষ গত জুলাই মাসে দেশের ব্যাংকগুলোতে গচ্ছিত আমানতের স্থিতি দাঁড়িয়েছে আট লাখ ৮২ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকায়। চলতি বছরের জুলাইয়ে আগের বছরের একই মাসের তুলনায় প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে ৯.৮৩ শতাংশ। এক মাস আগে, অর্থাৎ গত জুনে এই প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১০.৬১ শতাংশ।

আন্ত ব্যাংক আমানত ও সরকারি আমানত বাদ দিয়ে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিভাগ। প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, যখন তখন তুলে নেওয়া যায় এমন তলবি আমানত এবং দীর্ঘ মেয়াদে জমা রাখা স্থায়ী আমানত—দুই ধরনের আমানতের প্রবৃদ্ধিই কমেছে। গত বছরের জুলাইয়ের তুলনায় চলতি বছরের জুলাইয়ে তলবি আমানত বেড়েছে ১৩.৩৩ শতাংশ আর মেয়াদি আমানত ৯.৪০ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে তলবি ও মেয়াদি আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল যথাক্রমে ২০.৫১ ও ১১.৯২ শতাংশ।
২০১৪ সালের জুনে ব্যাংকগুলোতে আমানতের স্থিতি ছিল ছয় লাখ ২৩ হাজার ৩২২ কোটি টাকা। ২০১৫ সালের জুনে তা বেড়ে হয় ছয় লাখ ৯৯ হাজার ১৮৩ কোটি টাকা। ২০১৬ সালের জুনে আমানত বেড়ে হয় সাত লাখ ৯৩ হাজার ৭০৬ কোটি টাকা। চলতি বছরের জুলাই শেষে আমানতের স্থিতি দাঁড়ায় আট লাখ ৮২ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা।
বর্তমানে ব্যাংকগুলোতে আমানতের গড় সুদহার ৪.৮৯ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংকে ১০০ টাকা রাখলে বছরে সুদ পাওয়া যাবে ৪.৮৯ টাকা। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আমানত রাখলে ব্যাংকভেদে সুদ পাওয়া যাচ্ছে ৪ থেকে ৭, সাড়ে ৭ শতাংশ। চলতি বা সঞ্চয়ী হিসাবে (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ও সেভিংস অ্যাকাউন্ট) জমা থাকা আমানতের ওপর ৩ থেকে সাড়ে ৩ শতাংশ সুদ পাওয়া যাচ্ছে। অথচ বছর তিনেক আগেও এই চিত্র ছিল ভিন্ন। তখন ব্যাংক আমানতের ওপর সর্বোচ্চ ১২.৫০ শতাংশ সুদ পাওয়া যেত। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার কমিয়ে আনতে শুরু করে। এর পর থেকে তা কমতে কমতে এই পর্যায়ে নেমে এসেছে। আমানতের সুদ সবচেয়ে বেশি কমেছে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে। ব্যাংকঋণের গড় সুদহার এখন ৯.৯১ শতাংশ। ২০১৩ সালের জুলাইয়ে ১৩.৬৩ শতাংশ। সেখান থেকে কমতে কমতে গত তিন-চার বছরে ঋণের গড় সুদহার কমতে কমতে ১০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।

বর্তমানে ব্যাংক আমানতের তুলনায় সঞ্চয়পত্রের মুনাফা বেশি থাকায় অনেকেই আমানত ভাঙিয়ে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছে। এতে ব্যাংকে বেসরকারি আমানত কমলেও সরকারি আমানত বাড়ছে। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে নিট পাঁচ হাজার ৫৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ এসেছে সঞ্চয়পত্র থেকে।
অন্যদিকে ঋণ কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর দুশ্চিন্তার শেষ নেই। কারণ কম সুদে যে আমানত পাওয়া যাচ্ছে সেগুলোও ঋণ হিসেবে বিতরণ করতে না পারলে ব্যাংকের মুনাফা কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সে কারণে ব্যাংকগুলো এখন আমানত গ্রহণে আগ্রহ হারিয়ে ঋণ বিতরণে জোর দিয়েছে। ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় থেকে ঋণ বাড়াতে ম্যানেজারদের নির্দেশনা পাঠানো হচ্ছে। ম্যানেজাররাও ভালো গ্রাহকদের পেছনে ঘুরছে। তা সত্ত্বেও ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে না।
গত আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান আয়োজিত এক কর্মশালায় রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেন, ‘বেসরকারি খাত বিদেশি ঋণ নিচ্ছে। ফলে আমরা অনেক চেষ্টা করেও ঋণ বিতরণ বাড়াতে পারছি না। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক তার মোট আমানতের মাত্র ৩৭ শতাংশ ঋণ বিতরণ করতে পারছে। ’ দেশের ভেতরে ঋণ বিতরণ কমে যাওয়ায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর জন্য অফশোর ব্যাংকিং উন্মুক্ত করার প্রস্তাব করেন তিনি।

চলতি বছরের জুলাই শেষে দেশের ব্যাংকগুলোতে ঋণের স্থিতি ছিল ৯ লাখ ৮৪ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা, যা এর আগের বছরের জুলাইয়ের তুলনায় ১১.৮৬ শতাংশ বেশি। তবে ২০১৬ সালের জুলাইয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১২.৭৫ শতাংশ। ব্যাংকঋণের এই তথ্যের মধ্যে ঋণ ও অগ্রিম, কলমানি ও রিভার্স রেপোতে খাটানো অর্থের পরিমাণ সাত লাখ ৪৫ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। আমদানি ও অভ্যন্তরীণ বিল বাবদ ঋণ রয়েছে ২৯ হাজার ৯৭ কোটি টাকা এবং ব্যাংকের ট্রেজারি বিল-বন্ড, শেয়ার ও সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ রয়েছে এক লাখ ৬৯ হাজার ৭৪২ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ঋণ-আমানতের অনুপাত ৫১.৬০ শতাংশ। অর্থাৎ কোনো ব্যাংক ১০০ টাকার আমানত সংগ্রহ করলে যেখানে ৮১ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়ার সুযোগ আছে, সেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো মাত্র ৫১.৬০ টাকা ঋণ দিতে পারছে। ফলে ব্যাংকগুলোতে অলস অর্থ বাড়ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি ব্যাংকের মধ্যে সোনালী ব্যাংকের ঋণ-আমানতের হার সবচেয়ে কম, ৩৭.১০ শতাংশ।
আর বেসরকারি ব্যাংকগুলোর গড় ঋণ-আমানতের হার ৮৩.৫৮ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে এ হার ৬৮.১৫ শতাংশ। সব মিলিয়ে ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণ-আমানতের হার ৭৩.৯১ শতাংশ। যেহেতু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো দেশের মোট ঋণের উল্লেখযোগ্য অংশ বিতরণ করে থাকে, তাই বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকের ঋণ আমানতের হার সন্তোষজনক হলেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর হার কমে যাওয়ায় এটি স্পষ্ট যে দেশে ঋণের চাহিদা কমে গেছে।

ব্যাংকঋণের সুদহার অনেক কমে যাওয়ার পরও ব্যবসায়ীদের মধ্যে ঋণ চাহিদা না থাকার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে হা-মীম গ্রুপের মালিক ও দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশে এখনো অবকাঠামোগত সংকট রয়েছে। বিশেষ করে জমির অভাব ও গ্যাস সংযোগ না পাওয়া। এ কারণেই ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগ করতে পারছে না। তবে সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছে, সেগুলো সম্পন্ন হলে এবং এলএনজি আমদানির মাধ্যমে শিল্পে গ্যাস সংযোগ দেওয়া শুরু হলে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ শুরু করবে। তখন ঋণ চাহিদাও বাড়বে।

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/09/28/547812