২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:৫২

বিদেশ সফরে ব্যস্ত খাদ্য কর্মকর্তারা

দেশে যখন আগুন দামে চাল বিক্রি হচ্ছে, বিপাকে পড়েছে সাধারণ মানুষ, তখন খাদ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা দলে দলে বিদেশ ভ্রমণে যাচ্ছেন। যেখানে চাল খোলাবাজারে বিক্রির কার্যক্রম তদারকি করার লোকের অভাব, সেখানে কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
নামে এসব সফর প্রশিক্ষণের জন্য হলেও যাঁদের এসব ভ্রমণে সুযোগ পাওয়ার কথা তাঁরা পাচ্ছেন না।
বিদেশ সফরের বিভিন্ন দলে সুযোগ পাওয়ার জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা মাসজুড়েই ব্যস্ত ছিলেন তদবিরে। অথচ এ মাসেই দেশে মোটা চালের দাম রেকর্ড ছুঁয়েছে। সরকারের নীতিনির্ধারকরা যখন চাল নিয়ে চরম উদ্বেগের মধ্যে সময় পার করছেন, তখন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের বিভিন্ন কক্ষে ফিসফাঁস—কে বিদেশ যাচ্ছেন আর কে বাদ পড়ছেন। ১০ সদস্যের একটি দল আজ বৃহস্পতিবার ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন সফরে যাচ্ছে। তারা ফিরতে না ফিরতেই ৯ সদস্যের একটি দল দেশ দুটিতে যাবে। তাদের বাইরে আরো একটি দল যাবে যুক্তরাষ্ট্র। তাদের প্রাথমিক বাছাই হয়ে গেছে। দুই দলে ২০ জন করে মোট ৪০ জনকে বাছাই করা হয়েছে।

তাদের মধ্য থেকে ১০ জনকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হবে। একটি প্রতিনিধিদলের ইতালি সফরেরও কথা রয়েছে।
খাদ্য নিরাপত্তা, নিরাপদ খাদ্য, পরিসঞ্চালন ও ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশ নিতে আজ ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন যাচ্ছে। এই দলটি ৬ অক্টোবর পর্যন্ত বিদেশে অবস্থান করবে। প্রশিক্ষণে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয় থাকলেও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কোনো কর্মকর্তাকে এখানে মনোনীত করা হয়নি। খাদ্য অধিদপ্তরের দুজন কর্মকর্তা মনোনীত হলেও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা রয়েছেন আটজন। প্রশিক্ষণটি খাদ্য নিরাপত্তা, নিরাপদ খাদ্য, সঞ্চালনা ও সংস্থাপন সংক্রান্ত হলেও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্তি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ প্রশাসন ক্যাডারের এসব কর্মকর্তা অস্থায়ীভিত্তিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে কাজ করেন। তাঁদের প্রশিক্ষণে কম গুরুত্ব দিয়ে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, খাদ্য অধিদপ্তর, সরকারি ময়দা কল বা সরকারি খাদ্যগুদাম কর্মকর্তাদের বাছাই করা হলে ভালো ফল পাওয়া যেত।
বিদেশ সফরের জন্য মনোনীত খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা হলেন যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ মোস্তফা ও অনিমা রানী নাথ, উপসচিব মো. সাইফুল ইসলাম ও মো. আয়াতুল ইসলাম, প্রোগ্রামার মো. মোবারক হোসাইন, মন্ত্রীর এপিএস সমর চন্দ্র ভৌমিক ও বাজেট অফিসার ইউনুস পাটোয়ারী। খাদ্য অধিদপ্তরের দুই কর্মকর্তা হলেন সাইলো সুপারিনটেনডেন্ট বিষ্ণু কুমার সরকার ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সালমা চৌধুরী।

একটি দল ৬ অক্টোবর ফিরে আসার ১১ দিন পর আরো একটি দল যাবে ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনে। তারা ১৭ থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত বিদেশে থাকবে। এসব ভ্রমণের সরকারি আদেশ জারি হয়েছে। দ্বিতীয় দলটি ৯ সদস্যের। এ দলটির মধ্যে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা রয়েছেন ছয়জন। দলটিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা রয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে রয়েছেন খাদ্য অধিদপ্তরের দুই কর্মকর্তা। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন অতিরিক্ত সচিব শামীমা সুলতানা, যুগ্ম সচিব শিরিনা দেলহুর, উপসচিব মোহসেনা খান ও আবুল কালাম আজাদ, সিনিয়র সহকারী সচিব মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান, সিনিয়র ইনফরমেশন অফিসার সুমন মেহেদী, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক মোহাম্মদ মোমিনুর রহমান, খাদ্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক সাইফুল কবীর খান ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সুমাইয়া নাজনীন।
দেশের অভ্যন্তরে সমন্বিত খাদ্য নীতি গবেষণাসংক্রান্ত প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অংশগ্রহণের জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য অধিদপ্তর থেকে ২০ জন করে দুটি ব্যাচে মোট ৪০ জন কর্মকর্তা মনোনীত করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহযোগিতায় খাদ্য অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন মডার্ন ফুড স্টোরেজ ফ্যাসিলিটিজ প্রজেক্টের আওতায় তাঁদের যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হবে। খাদ্য গুদামজাতকরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা না থাকার পরও অনেক কর্মকর্তাকে প্রাথমিক দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। গুদামজাতকরণের কাজটি অধিদপ্তর বা মাঠপর্যায়ের হলেও দলে মনোনীত হয়েছেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পাঁচ উপসচিব ও দুই সিনিয়র সহকারী সচিব।
গত ২০ থেকে ২৫ জুলাই পর্যন্ত ভারত সফর করেছে ১০ সদস্যের প্রতিনিধিদল। এই সফরটি ভারতের খাদ্য গুদামজাতকরণ ও বিতরণ ব্যবস্থার ওপর ছিল। বিশেষ করে ভারতের মিলিং, গুদামজাতকরণ, ধান শুকানোসংক্রান্ত হলেও সেই সফরে অংশ নিয়েছিলেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আবুল কালাম আজাদ, প্রধান হিসাব কর্মকর্তা পিয়ারা বেগম ও সহকারী প্রধান কর্মকর্তা মনোয়ারা পারভীন মিতু।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ২০১১ সালে কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণসংক্রান্ত নির্দেশনা জারি করেছে। সেখানে জুনিয়র কর্মকর্তাদের এবং নির্দিষ্ট কাজে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানোর ওপর গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু প্রশিক্ষণে অংশ নিতে আগামী ১৭ অক্টোবর ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন যাবেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শামীমা সুলতানা। অথচ তিনি গত মে মাসেই একই প্রশিক্ষণের আওতায় সিঙ্গাপুর সফর করেছেন। সেই সফরে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহসেনা খান ও আয়াতুল ইসলামও ছিলেন। এই তিন কর্মকর্তা মাত্র চার মাসের ব্যবধানে আবারও বিদেশ যাচ্ছেন। অথচ খাদ্য অধিদপ্তরের শত শত কর্মকর্তা রয়েছেন যাঁরা কখনোই প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশ যেতে পারেননি।
সাবেক খাদ্যসচিব আব্দুল লতিফ মণ্ডল কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশ ভ্রমণের সূচি অনেক আগে থেকে নির্ধারণ করা থাকতে পারে। অনেক সময় এ কারণে জরুরি পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেও বাদ দেওয়া যায় না। তবে এতগুলো কর্মকর্তা বিদেশ গেলে খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থায় এবং খোলাবাজারে চাল বিতরণে কোনো সমস্যা সৃষ্টি হবে না—তা নিশ্চিত করতে হবে। আর যার প্রশিক্ষণ তাকেই পাঠানো উচিত।

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/09/28/547811