২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, বুধবার, ৯:১৩

সাড়ে ৬ বছরে নিহত ৭১২

‘পাবলিক কোর্টে মৃত্যুদণ্ড’ বাড়ছে

কখনো ডাকাত, চোর, ছিনতাইকারী আখ্যা দিয়ে, কখনো নিছক সন্দেহপ্রবণ হয়ে, আবার কখনো প্রতিহিংসাবশত। সহিংস, উন্মত্ত মানুষ। নির্দয় নির্মমভাবে পিটিয়ে মারছে মানুষকে। এমন ঘটনা ঘটছে নিয়মিত। বাড়ছে লাশের মিছিল। এ যেন পাবলিক কোর্টে মৃত্যুদণ্ড। এ ধরনের ঘটনা বাড়াকে উদ্বেগজনক বলছেন আইন বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মীরা। তারা বলছেন, সমাজে আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হলে, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা তৈরি হলে এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটে। তাই বর্বর এসব ঘটনা রোধে আইন প্রয়োগে সমতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আস্থার সঙ্গে কাজ করতে হবে।
নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার চরবুজলি ইউনিয়ন। গেল কোরবানির ঈদের আগে ওই এলাকায় গরুচুরি বেড়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও ওই চুরি ঠেকাতে পারছিল না। ফলে গ্রামের লোকজন নিজেরাই পালাক্রমে রাত জেগে গ্রাম পাহারা দিতে থাকেন। এর মধ্যেই ঘটে এক মর্মান্তিক ঘটনা। সেদিন ছিল ৯ই আগস্ট। মধ্যরাত। উত্তর কচ্ছপিয়া গ্রাম। এদিন রাতে পাহারার সময় একটি পিকআপ ভ্যান গ্রামে ঢুকতে দেখেন পাহারাদাররা। সঙ্গে সঙ্গে এ খবর ছড়িয়ে দেন গ্রামজুড়ে। গ্রামের প্রবেশমুখে গাছ ফেলে পিকআপ ভ্যান আটকে দেয় গ্রামবাসী। চারদিক থেকে লোকজন আসতে দেখে পিকআপে থাকা ব্যক্তিরা পালানোর চেষ্টা করে। এ সময় ছয়জনের মধ্যে তিনজন পালিয়ে যান। অন্য তিনজনকে উত্তেজিত জনতা ‘গরু চোর’ সন্দেহে গণপিটুনি দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান তারা। পরে ভোরের দিকে গ্রামের একটি কাছারিঘরে লুকিয়ে থাকা আরো এক ব্যক্তিকে গণপিটুনি দিলে তিনিও মারা যান। গ্রামবাসী জানায়, এলাকায় গরু চুরি বেড়ে যাওয়ায় লোকজন অতিষ্ঠ হয়ে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। গত ৯ই সেপ্টেম্বর রাজধানীর ওয়ারীতে গণপিটুনিতে নিহত হন ৩৫ বছরের এক যুবক। স্থানীয়রা ছিনতাইকারী সন্দেহে তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। ২০১৫ সালে ১০ই ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের আড়াই হাজারে ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনিতে মারা যান ৮ ব্যক্তি। তবে সন্দেহের বশে গণপিটুনি দেয়া সকলেই যে অপরাধী তা নয়। পরিসংখ্যান বলছে, গড়ে প্রতিমাসে গণপিটুনিতে নিহত হচ্ছে কমপক্ষে ১৩ জন। আহত হচ্ছে আরো অনেকেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার কারণে জনগণ আইন হাতে তুলে নেয়। আবার জনগণের অসহিঞ্চু মনোভাবের কারণেও এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সার্বিক উন্নয়নের ওপর জোর দেন তারা।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেয়া তথ্যমতে, ২০১১ সাল থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ৭১২ জন ব্যক্তি গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ২০১১ সালে ১৩৪ জন, ২০১২ সালে ১২৬ জন, ২০১৩ সালে ১২৮ জন, ২০১৪ সালে ১২৭ জন গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গণপিটুনিতে নিহতের ঘটনা ঘটেছে ২০১৫ সালে। ওই বছর নিহত হয়েছেন ১৩৫ জন। এ ছাড়া ২০১৬ সালে নিহত হয়েছে ৫১ জন এবং চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত একইভাবে নিহত হয়েছেন আরো ১১ জন। তবে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা (বিএমবিএস) নামে একটি প্রতিষ্ঠানের দেয়া তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম ৮ মাসে নিহত হয়েছে ৩৯ জন। এই সময়ে আহত হয়েছে আরো ৫২ জন। এ ছাড়া বিভাগওয়ারী দেখা যায়, গত সাড়ে ৬ বছরে গণপিটুনিতে সবচেয়ে বেশি নিহতের ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে। এ তথ্য দিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র। তাদের দেয়া পরিসংখ্যান মতে, এই সময়ে ঢাকা বিভাগে ৩১৭ জন গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা চট্টগ্রাম বিভাগে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ১৭৪ জন। এ ছাড়া রাজশাহী বিভাগে ৭১ জন, খুলনা বিভাগে ৮৬ জন, বরিশাল বিভাগে ২৫ জন, সিলেট বিভাগে ১৯ জন এবং রংপুর বিভাগে ২০জন গণপিটুনির শিকার হয়ে মারা গেছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গণপিটুনিতে নিহতদের সকলেই যে অপরাধী তা নয়। বরং অনেক নিরপরাধ ব্যক্তিও শুধুমাত্র সন্দেহেরে বশবর্তী হয়ে গণপিটুনির শিকার হচ্ছে। মারা যাচ্ছে। ২০১৫ সালের ২৫শে আগস্ট পাবনায় অপহরণকারী সন্দেহে গণপিটুনিতে তিন ব্যক্তি নিহত হন। পরবর্তীতে জানা যায়, ওই তিনজনই ছিলেন ব্যবসায়ী। অপহরণকারীর গুজব রটিয়ে একটি মহল এ ঘটনা ঘটায়। ওই ঘটনায় নিহত নাটোর সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়িয়া গ্রামের সুরুজ মিয়ার ছেলে সাবেক ইউপি সদস্য আলাউদ্দিন ওরফে আলাল (৫০), দিনাজপুর সদর উপজেলার নয়নপুর কোতোয়ালি গ্রামের মৃত আবদুল জলিলের ছেলে আসলাম হোসেন (৪৫) ও পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার কড়ইতলা গ্রামের সোনাই সরদারের ছেলে বগুড়ার বিহারি কলোনির বাসিন্দা আবু বক্কর সিদ্দিকী (৫০)। তারা পেশায় ব্যবসায়ী ও একে অপরের আত্মীয়।

অভিযোগ রয়েছে, অনেক সময় হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকেও গণপিটুনি বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। এমনই একটি ঘটনা ঘটে ২০১৬ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি। এদিন রাজধানীর কাজিপাড়া এলাকায় তিন তরুণ গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে বলে পুলিশ দাবি করে। তবে পরবর্তীতে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে যে, ওই এলাকায় কোনো গণপিটুনির ঘটনা ওইদিন ঘটেনি। তাছাড়া পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নিহত তিন তরুণের শরীরে মোট ৫৪টি গুলির দাগ ছিলা
তবে গণপিটুনির শিকার হয়ে শুধু অপরাধী, সাধারণ মানুষই মারা যাচ্ছে তা নয়। অনেক সময় খোদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও গণপিটুনির শিকার হচ্ছেন। প্রাণ হারাচ্ছেন। গত ৩রা আগস্ট নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে পানিতে পড়ে মতিন নামের এক যুবকের মৃত্যু হয়। এই ঘটনার জেরে স্থানীয়রা গণপিটুনি দেয় আরিফ নামে এক পুলিশ সদস্যকে। এতে তিনি মারা যান।

২০১১ সালের ১৭ই জুলাই। পবিত্র শবেবরাত। ওই রাতে সাভারের আমিনবাজারের বড়দেশী গ্রামের কেবলারচরে বেড়াতে গিয়েছিল কলেজপড়ুয়া ছয় বন্ধু। কিন্তু তাদেরকে ডাকাত আখ্যা দিয়ে মাইকে ঘোষণা দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় অকুস্থলে। পবিত্র ওই রাতে এ ধরনের নৃশংস ঘটনায় শিউরে ওঠে দেশবাসী। আদালত সূত্রে জানা গেছে, মামলাটি এখন সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে। তবে, ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও নির্মম ওই ঘটনার বিচার শেষ না হওয়ায় নিহতদের পরিবার হতাশ হয়ে পড়েছে। ২০১৫ সালের ১০ই ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে পিটিয়ে হত্যা করা হয় আটজনকে। স্থানীয়দের অভিযোগ ছিল নিহতরা ওই এলাকায় ডাকাতি করছিল। হাতেনাতে ধরে ফেলায় তাদেরকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তবে, ডাকাতির অভিযোগে এভাবে মানুষ পিটিয়ে মারা কতটুকু নৈতিক তা নিয়ে সেসময় প্রশ্ন তুলেছিলেন সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ।
সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক মানবজমিনকে বলেন, আমাদের সরকার কিংবা পুলিশ প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর মানুষের আস্থাহীনতা থেকে এটি হচ্ছে। আর রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সমাজে বিভিন্ন ধরনের বিভাজন থেকেও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। কারণ বিভাজন সহিংসতাকে উসকে দেয়। বিচারবহির্ভূত হত্যার কারণে গণপিটুনিতে মানুষ উৎসাহী হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মানুষ দেখছে যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অহরহ মানুষ মারছে। গণপিটুনির মতো সহিংসতা বাড়ার এটাও একটা কারণ। ড. শাহদীন মালিক বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন কোনো মানুষকে বিচারে সোপর্দ না করে ক্রসফায়ার ও গুমের নামে সহিংসতা চালায় তখন জনগণের মধ্যেও কাউকে বিচারে সোপর্দ করার প্রবণতাটা কমতে বাধ্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন নিজেরাই বিচার করে সেটার দেখাদেখি জনগণও নিজেরা বিচার করতে শুরু করে। তিনি বলেন, এ ধরনের সমস্যা সমাধানের জন্য পুলিশকে বেতন ভাতা দিয়ে রাখা হয়েছে। তারাই সমাধান করবে। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন ও প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান মানবজমিনকে বলেন, আমাদের দেশের কিছু মানুষের মনোভাব এমন যে সবকিছু ‘ম্যানেজ’ করা যাবে। আর যখন মানুষের মধ্যে ম্যনেজ করার প্রবণতা কাজ করে তখন আইনের প্রতি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাটা থাকে না। তিনি বলেন, নিত্যনৈমিত্তিক কিছু অপরাধ যেমন চুরি, ডাকাতি এসব ক্ষেত্রে মানুষ মনে করে যে ধৃত ব্যক্তিকে যদি থানা পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয় তাহলে তারা টাকা খরচ করে বের হয়ে যাবে। কিংবা যারা পিটুনি দেয় তাদের ক্ষতি করবে। এ ধরনের চিন্তা থেকেই কিছু মানুষ এ রকম ঘটনা ঘটায়। গণপিটুনি দিয়ে মানুষ মেরে ফেলে। এলিনা খান বলেন, আইন যদি সঠিকভাবে প্রয়োগ, বাস্তবায়ন ও পরিচালিত হয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি আরো সতর্ক থাকে তাহলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতো না। আর এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য অবশ্যই আইনের সঠিক প্রয়োগ এবং বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের স্বচ্ছতা থাকতে হবে।

 

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=84939