২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, বুধবার, ৯:১১

কর্ণফুলী টানেল নিয়ে আর কত আশ্বাস

গত বছরের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফর ছিল সাড়া জাগানো। তখন দুই দেশের বন্ধুত্ব নতুন মাত্রায় উম্নীত হয়, যা 'সহযোগিতার কৌশলগত অংশীদারিত্ব' বলে বর্ণিত। ওই সময় ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্ট্মারক স্বাক্ষরিত হয়। যে ৬টি প্রকল্পের ফলক উন্মোচন করা হয়, তার মধ্যে রয়েছে কর্ণফুলী নদীতে টানেল। বাংলাদেশ সরকারের খরচে নির্মীয়মাণ পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগে ঋণ দিচ্ছে চীন। কিন্তু সময়মতো চীনের অর্থ না আসায় দুটি প্রকল্পই দীর্ঘসূত্রতায় আটকে গেছে। জানাচ্ছেন রাজীব আহাম্মদ


ঋণচুক্তি সইয়ের পর বছর ঘুরে এলেও কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল প্রকল্পে অর্থ ছাড় করেনি চীন। টাকা না পাওয়ায় টানেলের অবকাঠামো নির্মাণ কাজ আটকে আছে। শর্ত পূরণের পরও চীনের এক্সিম ব্যাংক টাকা দিচ্ছে না। ঋণচুক্তি 'ইফেকটিভ' করতে বাংলাদেশের তাগিদে শুধু আশ্বাসই দিচ্ছে চীন। সর্বশেষ গত সপ্তাহে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সঙ্গে বৈঠকে এক্সিম ব্যাংক প্রতিনিধিরা আশ্বাস দিয়েছেন, আগামী নভেম্বরে ঋণের টাকা ছাড় করা হবে।
ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, গত মঙ্গলবার এক্সিম ব্যাংক আবারও 'প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট' চেয়ে ই-মেইল করেছে। ইআরডির অতিরিক্ত সচিব ও এশিয়া উইংয়ের প্রধান জাহিদুল হক ই-মেইলের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি সমকালকে বলেন, গত সপ্তাহে এক্সিম ব্যাংকের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যেসব বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে সেগুলো ডকুমেন্ট আকারে চেয়ে ই-মেইল করেছে চীন।
গত বছরের ১৪ অক্টোবর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরকালে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণে দুই দেশের মধ্যে ঋণচুক্তি হয়। একই দিনে প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা ও শি জিন পিং বহুল প্রতীক্ষিত এই প্রকল্পের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন।

প্রকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ টানেল নির্মাণে ব্যয় হবে আট হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা। এতে চীন ২ শতাংশ সুদে ২০ বছর মেয়াদে ঋণ দেবে প্রায় ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বার্ষিক উম্নয়ন পরিকল্পনায় (এডিপি) এ প্রকল্পে ১ হাজার ৯৮১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ২৪ কোটি টাকা ঋণ বাবদ চীনের কাছ থেকে পাওয়ার কথা। কিন্তু এক টাকাও পাওয়া যায়নি।
চলতি অর্থবছরে এডিপিতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। প্রকল্প সাহায্য হিসেবে চীনের কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার কথা ১ হাজার ৮ কোটি টাকা। অর্থবছরের তিন মাস শেষ হতে চললেও ঋণের টাকার খবর নেই। অথচ প্রতিশ্রুতি ছিল ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতেই ঋণের টাকা মিলবে। বাংলাদেশের কর্মকর্তারা সে কথা বলেছিলেন।

ঋণের টাকা না পাওয়ায় ঠিকাদারকে 'মোবিলাইজেশন মানি' দিতে পারছে না টানেল বাস্তবায়নকারী সেতু কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে গত মে মাসে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান 'চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের-ফোরসি'র সঙ্গে টানাপড়েন সৃষ্টি হয় তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক ইফতেখার কবিরের। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানে পাঠানো তার চিঠির ভাষা ও পেশাদারিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। সম্প্রতি তিনি চাকরি ছেড়েছেন।

প্রকল্প সূত্র ও নথিপত্র থেকে জানা গেছে, ঋণচুক্তি কার্যকর করতে চুক্তির শর্তানুযায়ী ইআরডি থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র গত ২২ জানুয়ারি এক্সিম ব্যাংকে পাঠানো হয়। গত ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি বেইজিংয়ে ইআরডি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে এক্সিম ব্যাংক জানায়, আরও কিছু প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টের ঘাটতি রয়েছে। কী কী ডকুমেন্টের ঘাটতি রয়েছে তা জানাতে দুই মাস সময় নেয় চীনা ব্যাংকটি। মাঝে যোগাযোগও করেনি।
গত মাসে ইআরডির অতিরিক্ত সচিব জাহিদুল হকের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল চীনে যায়। সর্বশেষ গত সপ্তাহে বাংলাদেশে আসে এক্সিম ব্যাংকের প্রতিনিধি দল। ইআরডি প্রতিনিধি জাহিদুল হক সমকালকে বলেন, আগে চীন কখনও সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ বলেনি। এবার তারা একটি সময় বলেছেন। তিনি আশাবাদী, এবার ঋণের টাকা মিলবে।
তিনি জানান, এবার এক্সিম ব্যাংক যেসব 'ডকুমেন্ট' চেয়েছে তার বিবরণ জানিয়ে প্রকল্প পরিচালককে ই-মেইল করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে সেতু বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী ও কর্ণফুলী টানেলের প্রকল্প পরিচালকের চলতি দায়িত্ব পালন করা কবির আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তিনি বিদেশে থাকায় বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

সেতু বিভাগের সিনিয়র সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। প্রকল্প সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
তবে গত মে মাসে তখনকার প্রকল্প পরিচালক সমকালকে জানিয়েছিলেন, আট দফা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চেয়েছে এক্সিম ব্যাংক। প্রতিবারই তাদের চাহিদা অনুযায়ী সব তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে। কিন্তু ঋণচুক্তি কার্যকর (ইফেকটিভ) হয়নি। গত জানুয়ারিতে এক্সিম ব্যাংক প্রতিনিধিরা প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে যাওয়ার পর তিনি সমকালকে জানিয়েছেন, ফেব্রুয়ারিতে ঋণের টাকা ছাড় করা হতে পারে।

প্রকল্পের নথি থেকে জানা গেছে, চুক্তি অনুযায়ী যে দিন ঠিকাদারকে 'মোবিলাইজেশন মানি'র চেক দেওয়া হবে অথবা ইআরডি ঠিকাদারকে টাকা দিতে এক্সিম ব্যাংককে নোটিশ দেবে, সেই দিনকে কাজ শুরুর দিন হিসেবে গণ্য করা হবে। এ যুক্তিতে এখন কাজই শুরু হয়নি বহুল প্রত্যাশিত কর্ণফুলী টানেলের। এ বিলম্বের কারণে ব্যয় বৃদ্ধিরও শঙ্কা রয়েছে। গত মে মাসে সেতু সচিবকে পাঠানো প্রকল্প পরিচালকের চিঠিতে একই আশঙ্কা করা হয়।
নকশা অনুযায়ী কর্ণফুলী টানেলের শহরপ্রান্ত থাকবে পতেঙ্গার নেভাল একাডেমি পয়েন্টে। অন্য প্রান্ত থাকবে নদীর পশ্চিম তীরে আনোয়ারায়। টানেলের পূর্ব প্রান্তে পাঁচ কিলোমিটার ও পশ্চিমে এক কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হবে। নদীর তলদেশ থেকে ১৫০ ফুট গভীরে দুটি টিউবে চার লেনের রাস্তা নির্মাণ করা হবে। এ সড়কে যান চলাচল করবে।
২০১৫ সালের নভেম্বরে কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পায়। ২০২০ সালের জুনের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু ২০১৭ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে অবকাঠামো নির্মাণই শুরু হলো না।

http://www.samakal.com/bangladesh/article/17091709/