২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, বুধবার, ৯:০৯

প্রাথমিক শিক্ষা খাতে দুর্নীতির মচ্ছব

প্রশিক্ষণের অর্থ লুটে খাচ্ছেন কিছু কর্মকর্তা * তদন্তে অসহযোগিতা বড় কর্তাদের নাম আসায় নেয়া হয় না ব্যবস্থা * ল্যাপটপসহ সব কেনাকাটায় অনিয়ম
প্রাথমিক শিক্ষা খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির মচ্ছব চলছে। প্রশিক্ষণের অর্থ দু’হাতে লুটপাট করছেন কিছু কর্মকর্তা। হালনাগাদ মডেলের অর্থে কেনা হচ্ছে পুরনো মডেলের ল্যাপটপ। আসবাবসহ বিভিন্ন কেনাকাটা, শিক্ষা কর্মকর্তা ও প্রধান শিক্ষক পদে চলতি দায়িত্ব দেয়া- প্রতি ক্ষেত্রেই অনিয়ম হয়েছে। কেন্দ্র থেকে মাঠপর্যায়ের শিক্ষা অফিসে সেবাপ্রার্থীদের হয়রানি ও দুর্ভোগের অভিযোগও বিস্তর। বিভিন্ন তদন্ত প্রতিবেদন, সরেজমিন অনুসন্ধান এবং শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

এ বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী অ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বিভিন্ন কেনাকাটায় দাতা সংস্থা, বুয়েটসহ দেশি-বিদেশি প্রতিনিধি জড়িত থাকেন। তারা যেটা ভালো মনে করেছেন, সেটাই কেনা হয়েছে। তারপরও ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে দূর করা হবে।’ তিনি বলেন, ‘টিইও বা প্রধান শিক্ষকের অনেক পদ শূন্য। দায়িত্বশীলের অভাবে কাজ চালিয়ে নেয়া কঠিন হয়ে পড়েছিল। পদ আপগ্রেড হওয়ায় এ দুই ক্যাটাগরিতে এখন পিএসসির মাধ্যমে পদোন্নতি ও নিয়োগ দিতে হয়। কিন্তু সেটা সময়সাপেক্ষ। এ কারণে যারা পদোন্নতি পাবেন, তাদের মধ্য থেকেই চলতি দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।’

আর মাঠপ্রশাসনে দুর্নীতি সম্পর্কে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের (ডিপিই) মহাপরিচালক ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল যুগান্তরকে বলেন, এ ব্যাপারে ডিপিইতে একটি সেল খোলা হয়েছে। যখনই কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আসে, তখন তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হয়। ব্যক্তি পর্যায়ের অনিয়ম-দুর্নীতির ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রশিক্ষণে বিধিবহির্ভূতভাবে অর্থ নেয়ার অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে।

ডিপিই’র মাধ্যমে শিক্ষক, শিক্ষা কর্মকর্তাদের বছরে অন্তত ১৪ ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এ নিয়ে অভিযোগ উঠলে সম্প্রতি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্তে অধিদফতরের প্রশিক্ষণ বিভাগের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে মাঠপর্যায়ের একশ্রেণীর কর্মকর্তার আর্থিক অনিয়মের ভয়াবহ তথ্য বেরিয়ে আসে। প্রতিবেদনে কমিটি ৯ ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম তুলে ধরে। এর মধ্যে আছে- একই ব্যক্তির একই তারিখে একাধিক স্থানে প্রশিক্ষণে যোগ দেয়ার নামে আলাদা সম্মানী, পরিবহন ও দৈনন্দিন ভাতা উত্তোলন। এক্ষেত্রে একটি যাত্রা থাকলেও একইপথে একাধিক বিমান ভ্রমণের ভাতা উত্তোলন। সম্মানীসহ অন্য ভাতার নামে প্রাপ্যতার বেশি বা বরাদ্দ থাকা সব অর্থই উত্তোলন। ভ্রমণে বিভিন্ন বিমান রুটে আলাদা ভাড়া থাকলেও একই অঙ্কের অর্থ উত্তোলন। অনুষ্ঠানে না গিয়ে অথবা অনুষ্ঠান শুরুর আগে ভাতা-বিল উত্তোলন। কোনো সময়সূচি উল্লেখ না করে ভ্রমণ আদেশ জারি ও ভ্রমণ আদেশ ছাড়া পরিদর্শন ও ভ্রমণ বিল উত্তোলন। মোট ১৮ জন কর্মকর্তা এসব অপকর্মে জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। তাদের মধ্যে সংস্থাটির একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তার নাম আছে। এ কারণে প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পরে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের মাঠপর্যায়ের অনেক অফিস (যেখান থেকে অবৈধ সুবিধা বেশি দেয়া হয়েছে বলে অনুমান করা হয়) কমিটিকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করেনি। এমনকি ডিপিই’র ভেতরে বিভিন্ন শাখা থেকেও সহায়তা পায়নি তদন্ত কমিটি। এতে ধারণা করা হয়, অধিদফতরের যেসব কর্মকর্তা এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, তাদের সঙ্গে মাঠপর্যায়ের অনেক কর্মকর্তার যোগসাজশ আছে। যেমন- যশোর পিটিআই কোনো তথ্য দেয়নি। সবচেয়ে নিয়মবহির্ভূতভাবে টিএ/ডিএ উত্তোলন করেছেন অধিদফতরের উপরিচালক ও পরিচালক পর্যায়ের কর্মকর্তারা। মাঠপর্যায়ের সব অফিস থেকে তথ্য পাওয়া গেলে চিত্র আরও ভয়াবহ হতো।

এ প্রসঙ্গে মহাপরিচালক ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, ‘আমি যেহেতু এ ধরনের বিষয় পছন্দ করি না, তাই কারও বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ বরদাশত করা হবে না।’

সূত্র জানায়, এরপরও সর্বশেষ ২২ সেপ্টেম্বর প্রশিক্ষণের ভ্রমণে গিয়ে চার উপজেলা থেকে অর্থ গ্রহণের অভিযোগ পাওয়া গেছে এক পরিচালকের বিরুদ্ধে।

বিভিন্ন কেনাকাটা : সারা দেশের সরকারি প্রাথমিক স্কুলে মাল্টিমিডিয়া সামগ্রী দেয়ার লক্ষ্যে ল্যাপটপ দেয়া শুরু করে ডিপিই। এর অংশ হিসেবে সম্প্রতি ৩ হাজার ৯৩০টি স্কুলে ল্যাপটপ দেয়া হয়। কিন্তু এতে ব্যবহৃত সফটওয়্যার ‘জাল’ হিসেবে আপত্তি ওঠে। কিন্তু সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ওইসব ল্যাপটপের প্রায় সব নষ্ট অবস্থায় স্কুলগুলোয় পড়ে আছে।

সম্প্রতি আরও ৫০ হাজার স্কুলে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরসহ ল্যাপটপ দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু এগুলোয় যে ৫০ হাজার ল্যাপটপ দেয়া হচ্ছে, তা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। দরদাতাদের একজন টেন্ডার প্রক্রিয়ায় ঘাপলার অভিযোগে আদালতে মামলা করেছেন। আরও অভিযোগ, বর্তমানে কোরআই-৭ মডেলের ল্যাপটপ বাজারে চলছে। কিন্তু ডিপিই কোরআই-৩ মডেল কিনছে। অথচ ২ বছর আগে বিতরণ করা প্রায় ৪ হাজার ল্যাপটপও কোরআই-৫ মডেলের ছিল।

স্কুলের জন্য আসবাবপত্র কেনার টেন্ডারেও সর্বনিন্ম দরদাতার পরিবর্তে অন্যদের কাজ দেয়ার পাঁয়তারার অভিযোগ উঠেছে। এতে সরকারের অন্তত ২০ কোটি টাকা গচ্চা যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। সর্বনিন্ম দরদাতার পরিবর্তে বেশি দরদাতাকে কাজ দেয়ার ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকে পর্যন্ত অভিযোগ পড়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সংস্থাটি ডিপিইর কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে।

এ ব্যাপারে ডিপিই মহাপরিচালক বলেন, ‘বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে কেনাকাটার টেন্ডার সম্পন্ন হয়। আর আগে এটি সরকারি বিভিন্ন কমিটি থেকে অনুমোদন নিতে হয়। সুতরাং নজরদারির ব্যবস্থা আছে। তারপরও আসবাব কেনা সংক্রান্ত ফাইল এখন পর্যন্ত আমার কাছে আসেনি। এলে অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে।’ তিনি দাবি করেন, যথাযথ প্রক্রিয়ায়ই ল্যাপটপ কেনা হচ্ছে।

বদলি-পদায়ন : বিধি অনুযায়ী, সরকারের প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা বদলি-পদায়নের কাজ করবে মন্ত্রণালয়। দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত কর্মচারী বদলি-পদায়ন করবে অধিদফতর। কিন্তু অধিদফতরের ক্ষমতা নিয়ে গেছে মন্ত্রণালয়। ১১ মে ১২৩ জন এটিইওকে চলতি দায়িত্বের টিইও বানিয়ে আদেশ জারি করে মন্ত্রণালয়। ১০ সেপ্টেম্বর চলতি দায়িত্বের ৪৪ জন এটিইওকে টিইও পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। সংবাদ সম্মেলন করে ২৩ মে ১৭ হাজারের বেশি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘চলতি দায়িত্বের’ প্রধান শিক্ষক নিয়োগের ঘোষণা দেয়া হয়। ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মন্ত্রণালয় থেকে ৮৭ জনকে ঢাকা মহানগর ও পার্শ্ববর্তী এলাকার বিভিন্ন স্কুলে চলতি দায়িত্বের প্রধান শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। এছাড়া উচ্চমান সহকারীদের এটিইও পদে নিয়োগের উদাহরণ আছে।

https://www.jugantor.com/last-page/2017/09/27/158835