২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, বুধবার, ৯:০৫

নয় বীমা কোম্পানির ৩৪১ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি

শীর্ষে গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স

সরকারের প্রায় সাড়ে ৩শ’ কোটি টাকার মূসক বা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে ৯টি সাধারণ বীমা কোম্পানি। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে নানা অভিযোগে অভিযুক্ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স। প্রতিষ্ঠানটির ভ্যাট আত্মসাতের পরিমাণ ৩১ কোটি টাকা। অভিযুক্ত অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো হল- সরকারি সাধারণ বীমা কর্পোরেশনসহ বেসরকারি রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্স, প্রগতি ইন্স্যুরেন্স, পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্স, ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্স, ইস্টল্যান্ড ইন্স্যুরেন্স, পূবালী ইন্স্যুরেন্স, রূপালী ইন্স্যুরেন্স। মোটা দাগে অভিযোগ, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলো গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রযোজ্য ভ্যাট আদায় করলেও তা সরকারের কোষাগারে জমা দেয়নি। এমন গুরুতর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় একাধিকবার ভ্যাট আইনে অর্থ দণ্ড আরোপ করা হলেও তা বন্ধ হচ্ছে না। প্রতি বছরই বীমা কোম্পানিগুলোর ভ্যাট ফাঁকি ধরা পড়ছে। সর্বশেষ বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ) ১১০ কোটি ১৪ লাখ টাকার রাজস্ব ফাঁকির জন্য এসব প্রতিষ্ঠানকে অভিযুক্ত করেছে। ফাঁকি দেয়া অর্থ জমা দিতে ভ্যাট আইনে দাবিনামা জারি করে সোমবার ১৫ দিনের সময় দিয়েছে ভ্যাট এলটিইউ কর্তৃপক্ষ। এর আগে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ২৩১ কোটি টাকার ফাঁকি উদঘাটিত হলেও কোনো অর্থ আদায় করা যায়নি। এলটিইউর দাবিনামা অনুযায়ী সরকারি প্রতিষ্ঠান সাধারণ বীমা কর্পোরেশন ফাঁকি দিয়েছে ২৪৩ কোটি ৪২ লাখ টাকা।

ভ্যাট এলটিইউ কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছে, সাধারণ বীমা ব্যবসায় পুনঃবীমা ও এজেন্ট কমিশনের ওপর ১৫ শতাংশ হারে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট ধার্য থাকলেও তা পরিশোধ করছে না বীমা কোম্পানিগুলো। এসব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক প্রতিবেদন ও রিটার্ন পর্যালোচনা করে ভ্যাট পরিশোধ না করে আত্মসাৎ প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে বেসরকারি খাতে দেশের শীর্ষ বীমা কোম্পানি গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের ভ্যাট ফাঁকি শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। প্রতিষ্ঠানটির আরও অনিয়ম উদঘাটনে বিশেষ অডিট চলছে। প্রাথমিকভাবে ৩০ কোটি ৮৮ লাখ টাকার অনিয়ম প্রমাণিত হয়েছে। এ জন্য কেন ভ্যাট আইনে পদক্ষেপ নেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়া হয়েছে। এলটিইউর তথ্য অনুযায়ী এর আগেও এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে ২৩১ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ প্রমাণিত হয়। ভ্যাট আইনে কারণ দর্শানো নোটিশসহ দাবিনামা জারি করা হলে অধিকাংশ কোম্পানিই উচ্চ আদালতে রিট মামলা দায়ের করে, যা এখন বিচারাধীন। গত মাসে বিশেষ নিরীক্ষায় আবারও এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ১১০ কোটি ১৬ লাখ টাকার ফাঁকি উদঘাটিত হয়েছে।

এর মধ্যে পুনঃবীমার কমিশন বাবদ ৬৬ কোটি ৭৩ লাখ ও এজেন্ট কমিশনের ওপর ৪৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা সরকারের কোষাগারে জমা দেয়নি অভিযুক্ত বীমা কোম্পানিগুলো। এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ) বিশেষ নিরীক্ষায় এ অনিয়ম ধরা পড়েছে। মূল্য সংযোজন কর আইন, ১৯৯১-এর ২(ভ) ধারা অনুযায়ী করযোগ্য সেবা প্রদানকারী কর্তৃক প্রদত্ত সেবার বিনিময়ে ভ্যাট ছাড়া কমিশন ও চার্জ কোম্পানির সর্বমোট প্রাপ্তি বা আয় হিসেবে গণ্য। একই আইনের ৫ ধারার ৪ উপধারা অনুযায়ী ওই সেবায় মোট প্রাপ্তির ওপর ভ্যাট ধার্য হবে। অন্যদিকে একই আইনের ১৪ ধারাবলে বিভিন্ন কমিশনকে অব্যাহতি দেয়া হলেও তাতে বীমার এজেন্ট কমিশন ও পুনঃবীমা বাবদ প্রাপ্ত কমিশনকে যুক্ত করা হয়নি। এর ফলে এ ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রযোজ্য হবে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বীমা খাতে অনেক কোম্পানিই ভ্যাট ফাঁকি দেয়। এটা সরাসরি দুর্নীতি। কিন্তু এর বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তাদের মতে, এই প্রবণতা রোধে কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিতে হবে। জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ভ্যাট ফাঁকি দেয়া বড় ধরনের অপরাধ। এটা সরাসরি দুর্নীতি। অবশ্যই কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদকে এর দায়ভার নিতে হবে। তিনি বলেন, অন্যান্য কোম্পানির ক্ষেত্রেও এ ধরনের প্রবণতা রোধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনকেও উদ্যোগ নিতে হবে। মির্জ্জা আজিজ বলেন, দীর্ঘদিন থেকে দেশের বীমা খাতে বিশৃঙ্খলা চলছে। এ অবস্থা উত্তরণে এ খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো জরুরি। এক্ষেত্রে বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ-কে (বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ) উদ্যোগ নিতে হবে।

প্রসঙ্গত, নিয়মানুসারে পলিসির বিপরীতে বীমা কোম্পানিগুলো গ্রাহকের কাছ থেকে ১০০ টাকা প্রিমিয়াম নিলে সরকারকে ১৫ টাকা ভ্যাট দিতে হয়। এই ভ্যাটের টাকা গ্রাহকের কাছ থেকে আদায় করা হয়। অর্থাৎ ১০০ টাকার পলিসির বিপরীতে গ্রাহককে ভ্যাটসহ ১১৫ টাকা দিতে হয়। আবার কোনো এজেন্টের মাধ্যমে এই পলিসি এলে এজেন্টকে ১০০ টাকা থেকে ১৫ টাকা কমিশন দিতে হয়। তবে এজেন্ট কমিশনের টাকা বীমা কোম্পানিগুলো দেয়। আবার এজেন্ট কমিশনের ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। অর্থাৎ কোনো এজেন্ট ১৫ টাকা কমিশন পেলে বীমা কোম্পানিগুলো ৭৫ পয়সা ভ্যাট কেটে রাখে। কিন্তু গ্রাহক এবং এজেন্ট উভয় খাত থেকে ভ্যাট আদায় করলেও কোম্পানিগুলো সরকারের কোষাগারে তা জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করছে। সূত্র জানায়, এই প্রক্রিয়ায় ৯টি কোম্পানির ভ্যাট ফাঁকির তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিরই ফাঁকি ৩০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এই টাকার মধ্যে আবার এজেন্ট কমিশন ১৩ কোটি ২৯ লাখ এবং পুনঃবীমার ১৭ কোটি ৫৯ লাখ। রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্সের ফাঁকি দেয়া ২২ কোটি টাকার মধ্যে এজেন্ট কমিশনে ১০ কোটি ৫৩ লাখ এবং পুনঃবীমার ১১ কোটি ৫২ লাখ। সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের পুনঃবীমার ১৭ কোটি ৪২ লাখ। প্রগতি ইন্স্যুরেন্সের ফাঁকি দেয়া ১২ কোটি ৩৬ লাখ টাকার মধ্যে এজেন্ট কমিশন ৬ কোটি ৬৩ লাখ এবং পুনঃবীমার ৫ কোটি ৭৩ লাখ। পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের ৯ কোটি ২ লাখ টাকার মধ্যে এজেন্ট কমিশন ৫ কোটি ৩২ লাখ এবং পুনঃবীমার ৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা ফাঁকি দিয়েছে। ইস্টল্যান্ড ইন্স্যুরেন্সের ৮ কোটি ২৬ লাখ টাকার মধ্যে ৩ কোটি ৬০ লাখ এবং এজেন্ট কমিশনের ৪ কোটি ৬৬ লাখ। ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্সের ৬ কোটি ৯০ লাখ টাকার মধ্যে এজেন্ট কমিশন ২ কোটি ৭৩ লাখ এবং পুনঃবীমার ৭ কোটি ১৭ লাখ। এছাড়া রূপালী ইন্স্যুরেন্স এজেন্ট কমিশন থেকে ১ কোটি ৩৩ লাখ এবং পূবালী ইন্স্যুরেন্স পুনঃবীমা থেকে ১ কোটি ৯৪ লাখ টাকা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে।

সূত্র মতে, এর আগে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত এলটিইউ ভ্যাটের আওতাধীন বীমা কোম্পানিগুলোর ২৩১ কোটি টাকা ভ্যাট বকেয়া আছে। এলটিইউর নিজস্ব অডিট, স্থানীয় রাজস্ব অডিট অধিদফতর, ভ্যাট নিরীক্ষা ও গোয়েন্দার অডিটে এসব ভ্যাট ফাঁকির চিত্র উঠে আসে। পরে এলটিইউ থেকে ফাঁকি দেয়া ভ্যাট পরিশোধে দাবিনামা জারি করা হলে বীমা কোম্পানিগুলো উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়। বর্তমানে এর বেশির ভাগ মামলা বিচারাধীন আছে। প্রাপ্ত তথ্য মতে, মামলার কারণে বকেয়া ভ্যাট আটকে আছে সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের ২২৬ কোটি টাকা, প্রগতি ইন্স্যুরেন্সের সাড়ে ৩ কোটি টাকা, রূপালী ইন্স্যুরেন্সের ৩৩ লাখ টাকা, পাওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের ৩৯ লাখ টাকা, রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্সের ২৭ লাখ ৭৯ হাজার টাকা এবং ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্সের ১ কোটি ১০ লাখ টাকা ভ্যাট বকেয়া আছে। জানতে চাইলে গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের প্রতিষ্ঠাতা এবং বর্তমান উপদেষ্টা নাসির উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন আমেরিকায় ছিলাম। বিস্তারিত বলতে পারব না। তবে এতটুকু বলতে পারি গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স কখনও কর ফাঁকি দেয় না। এক্ষেত্রে আমরাই অগ্রগামী।’ তিনি দাবি করেন, ‘কেউ ষড়যন্ত্র করে এটি করিয়ে থাকতে পারে।’ তিনি বলেন, কাগজপত্রে কোনো ঝামেলা থাকলে সংশ্লিষ্ট দফতরে কথা বলে তা সমাধান করা হবে। আইডিআরএ সূত্র জানায়, দেশের ৭৮টি বীমা কোম্পানির মধ্যে জীবন বীমা ৩০টি এবং সাধারণ বীমা ৪৮টি। দুই খাত মিলিয়ে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৪৬টি। বর্তমানে এ খাতে সম্পদের পরিমাণ ৩৫ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে জীবন বীমায় ২৯ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা এবং সাধারণ বীমায় ৫ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। তবে প্রতারণার কারণে বিশাল এ খাতের প্রতি মানুষের আস্থা এখন শূন্যের কোঠায়। ২০১০ সালে নতুন বীমা আইন হওয়ার পর পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলেও এখনও ব্যাপক প্রতারণা ও দুর্নীতি অব্যাহত আছে।

https://www.jugantor.com/first-page/2017/09/27/158829