২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, বুধবার, ৯:০২

ট্যানারি মালিকরা না কেনায় পাচার হচ্ছে কাঁচা চামড়া

ট্যানারি স্থানান্তর জটিলতায় এখনো বিপুল পরিমাণ চামড়া অবিক্রীত রয়ে গেছে পোস্তার আড়তে। কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের অভিযোগ ট্যানারি মালিকরা বিগত বছরের বকেয়া পাওনাও পরিশোধ করছে না। এমন কি নতুন চামড়াও ক্রয় করছে ন্।া এতে করে চামড়া নিয়ে অনেকটা বিপাকে পড়েছে পোস্তার ব্যবসায়ীরা। কুরবানির প্রায় এক মাস অতিবাহিত হলেও মাত্র ৫ ভাগ চামড়া ক্রয় করেছে ট্যানারি মালিকরা। সংগৃহীত চামড়ার ৯৫% এখনও অবিক্রীত রয়ে গেছে। ট্যানারি মালিকরা চামড়া না কেনার কারণে তা পাচার হচ্ছে। তাই ভবিষ্যতে ব্যবসা নিয়ে উদ্বিগ্ন কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ীরা।
জানা গেছে, পোস্তা, নাটোর, যশোর এবং চট্টগ্রামের কাচা চামড়া ব্যবসায়ীদের নিকট গরু-ছাগল মিলে চামড়া রয়েছে ৮০ লাখের মত। এ চামড়া থেকে মাত্র ৫ ভাগ চামড়া ক্রয় করেছে ট্যানারি মালিকরা। বাকি চামড়া এখনও অবিক্রীত রয়ে গেছে। এ ঈদে গরু ছাগল মিলে প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ পশু কুরবানি হয়েছে। কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ীরা সংগ্রহ করেছে মাত্র ৮০ লাখের মত। প্রশ্ন হলো বাকি চামড়া গেলো কোথায়।

সূত্র জানায় সীমান্ত দিয়ে প্রতি দিনই চামড়া পাচার হচ্ছে। কারন ট্যানারি মালিকরা এখনও চামড়া কিনতে শুরু করেনি। এতে করে বিপাকে কাচা চামড়ার ব্যবসায়ীরা। প্রতি বছর চামড়া পাচার হলেও এবার বেশি চামড়া পাচার হচ্ছে। এজন্য সাভারে ট্যানারি স্থানান্তরকে দায়ী করেন ব্যবসায়ীরা। ট্যানারি মালিকদের কাছে মূলধন না থাকার কারনেই তারা চামড়া কিনতে পারছে না।
ঢাকা কাচা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সেক্রেটারি রবিউল আলম দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, এক কোটি টাকা পনের লক্ষ পশুর চামড়া ট্যানারির মালিকদের পক্ষে রক্ষা করা সম্ভব নয়। তার উপর চলতি বছর ট্যানারি সাভারে স্থনান্তর। ১৫৫টি ট্যানারির মধ্যে মাত্র ৬৮টি ট্যানারি প্রাথমিক উৎপাদনে আছে। মাত্র ১০টি ট্যানারি রপ্তানির উপযুক্ত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন,চামড়া ক্রয়ে সরকার ব্যাংক ঋণ দিলেও সে টাকায় চামড়া ক্রয় না করে উন্নয়ন কাজ করছে। কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের বকেয়া টাকা পরিশোধ করা হয়নি। কুরবানি পশুর ৮০ লাখ চামড়া সংগ্রহ করেছে আড়ৎদাররা। বাকি ৪৫ লাখ চামড়া গেলো কোথায়। সংগ্রহিত এ চামড়া থেকে ট্যানারির মালিকরা ৫ভাগ ক্রয় করেছে।
কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী আশিকুর রহমান বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ এক মাস ধরে সীমান্ত পাহারা দেয়া হচ্ছে। তবুও চামড়ার ট্রাক আমিন বাজার থেকে সিরাজগঞ্জ যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে খুলনা, রাজশাহী, চাপাই নবাবগঞ্জ যাচ্ছে। কি করে কাঁচা চামড়া নিয়ে ট্রাকগুলো পার হচ্ছে জানি না।
তিনি আরও বলেন,চলতি বছর আমরা নিজেদের কোরবানির কাঁচা চামড়া রক্ষা করতে পারছি না। গোটা কয়েক পাচারকারী কাঁচা চামড়া মজুদদারদের ও আড়ৎদারদের সহায়তায় ঘৃণ্য খেলায় মেতে উঠেছে। চামড়া পাচার হচ্ছে ট্যানারির মালিকদের অসহযোগিতার কারণে। চামড়া নিয়ে বিপাকে পড়েছে পোস্তার আড়ৎদাররা।
জানা গেছে,গত কয়েক বছরের বকেয়া টাকা এখনো পরিশোধ করতে পারেননি ট্যানারি মালিকরা। অন্য দিকে সাভারে ট্যানারিগুলো স্থানান্তর হলেও কাঁচা চামড়া যোগানদাতারা কোন প্লট বরাদ্দ পাননি সেখানে। তাই ভবিষ্যতের ব্যবসা নিয়ে উদ্বিগ্ন তারা।
প্রক্রিয়াজাত চামড়া, চামড়াজাত পণ্য আর জুতা রপ্তানি করে বেশ ভালো বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছেন ব্যবসায়ীরা। এবং তৈরি পোষাকের পর রপ্তানিতে শক্ত অবস্থান তৈরির সুযোগ রয়েছে এই শিল্পের। তবে ট্যানারি স্থানান্তর জটিলতায় প্রভাব পড়েছে এই খাতে।
ট্যানারি মালিকরা বলছেন, স্থানান্তর জটিলতা প্রভাব ফেলেছে তাদের ব্যবসায়ে। এজন্য রপ্তানি কমে গেছে তাদের। তাই এবার প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহ করতে সমস্যা হচ্ছে। আর এ সুযোগে প্রতিবেশি দেশে কাঁচা চামড়া পাচার হয়ে যাচ্ছে।
কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীরা আরো বলছেন, সাভারে ট্যানারিগুলো স্থানান্তর হলেও সেখানে কোন প্লট বরাদ্দ পাননি তারা। এতে ব্যবসা নিয়ে উদ্বিগ্ন তারা। তাই এমন পরিস্থিতিতে কয়েক বছরের বকেয়া পরিশোধের পাশাপাশি, ট্যানারিগুলোকে স্থানান্তর প্রক্রিয়া আরো কার্যকর করার দাবি জানিয়েছেন তারা।

ট্যানারি এসোসিয়েশনের সভাপতি শাহিন আহমেদ বলেন,স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও চামড়ায় এত বড় মহা বিপর্যয় দেখা দেখা যায়নি। টাকা অভাবে আমরা এখনও চামড়া ক্রয় করতে পারছি না। অনেকে সাভারে তাদের কারখানা উন্নয়ন কাজ করছে। কারখানা না হলে তারা চামড়া কিনে কি করবে। তাছাড়া এখনও গত বছরের চামড়া অবিক্রীত রয়ে গেছে। আড়ৎদারদের বকেয়া এখনও পরিশোধ করা হয়নি। তাহলে কি করে নতুন চামড়া ট্যানারি মালিকরা কিনবে।
তিনি আরও বলেন,চামড়ার দাম না পেলে তা পাচার হবেই। পাহারা বসিয়ে কোন লাভ হবে না। ঈদের দু মাস আগে সাভারে ট্যানারি স্তনান্তর করা ঠিক হয়নি। সাভারে স্তনান্তরে ট্যানারিতে এ নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে।
কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি দেলোয়ার হোসেন বলেন,আমরা চামড়া কিনে বসে আছি। কিন্তু ট্যানারি মালিকরা চামড়া কিনছে না। মাত্র ৫ ভাগ চামড়া ক্রয় করেছে ট্যানারি মালিকরা। বাকি চামড়া এখনও রয়ে গেছে। এ চামড়া বিক্রি হবে কি না। আর তা বিক্রি করতে কত দিন লাগবে তা জানেনা তিনি।
তিনি আরও বলেন, বিগত কয়েক বছরের বকেয়া টাকাও পাচ্ছি না। এতে করে বিপাকে কাঁচা চামড়ার আড়ৎদাররা। তবে পাচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন,সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে চামড়া পাচার হচ্ছে। ঢাকা থেকে তেমন চামড়া পাচার হয় না। ভারতের সাথে আমাদের দেশের চামড়ার দামে যে পার্থক্য তাতে পাচার হবেই।
তিনি বলেন,পাচার ঠেকাতে আমরা কাজ করলেও কোন লাভ নেই। কত দিন কাঁচা চামড়া নিয়ে মানুষ বসে থাকবে। সারা বছরে আমরা চামড়া বিক্রি করতে পারবো কি না জানিনা। আর টাকা ছাড়া চামড়া বিক্রি করে কি লাভ। সরকার শুধু ঋণ দিয়ে থাকে ট্যানারি মালিকদের। আমাদের কোন ঋণ দেয়া হয় না। তাহলে আমরা ব্যবসা করবো কি দিয়ে।
তিনি অভিযোগ করে বলেন,ট্যানারি মালিকদের প্লট দেয়া হলেও আমাদের সরকার কি দিয়েছে। অথচ আমাদের ওপর নির্ভর করেই তারা ব্যবসা করে থাকেন। তাহলে কেন আমাদের প্লট দেয়া হবে না। এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে আমাদেরও প্লট দিতে হবে।
জানা গেছে, ভারতে প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম (১০৫ রুপি) প্রায় ১৩৫ টাকা। বাংলাদেশে প্রতি ফুটের দাম মাত্র ৫৫-৬০ টাকা। প্রতি ফুট চামড়ায় দামের পার্থক্য ৮০ টাকা। তার পরেও চামড়া বিক্রি করতে হয় বাকিতে। এতে করে বাধ্য হয়ে চামড়া পাচার করছে সীমান্তের ব্যবসায়ীরা। তাহলে চামড়া পাচারের দায় কার। ট্যানারি এসোসিয়েশন চামড়া পাচারের আশঙ্কা করলেও ঋণের টাকায় তৈরি করছেন কারখানা।

জানা গেছে,সারা দেশে প্রায় ৫৫ লাখ গরু আর ৭০-৭৫ লাখ ছাগল কুরবানি করা হয়ে থাকে। সারা দেশের চামড়ার ফরিয়ারা তা সংগ্রহ করে লবন দিয়ে বিক্রি করে থাকেন মজুদ কিংবা আড়তদারের কাছে। এসব আড়তদাররাও ফরিয়াদের কাছ থেকে চামড়া কিনে থাকেন বাকিতে। একই ভাবে সারা বছর তাদের থেকে চামড়া ক্রয় করে থাকেন ট্যানারি মালিকরা। তারাও চামড়া কিনে থাকেন বাকিতে। তারপরেও তারা চামড়ার প্রকৃত মূল্য পায়না। আর এ কারণেই সীমান্তে কোনভাবেই চামড়া পাচার রোধ করা যাচ্ছে না।

ব্যবসাযীদের অভিযোগ যদি চামড়া দাম না পাওয়া যায় তাহলে পাচার হয়ে বাধ্য। সরকার কোণভাবেই পাচার রোধ করতে পারবেনা। সীমান্তে যতই কড়া নজরদারি করা হউক না কেন।
তবে চামড়া পাচারের এই দায় নিতে রাজি নয় ট্যানারি মালিকরা। তারা বলছেন,সরকার কোন কারন ছাড়াই সাভারে ট্যানারি স্তনান্তর করছেন। অনেকে কারখানা তৈরি করতে ব্যাংক ঋণ নিচ্ছেন। অনেকে আবার চামড়া কিনতে পাওয়া ঋণে র টাকায় উন্নয়ন কাজ করছেন। তারা বলেন,এ শিল্পকে বাচাতে হলে সাভারে পুরোদমে উৎপাদনে যেতে হবে। তা না হলে এ শিল্প টিকিয়ে রাখা যাবে না।

http://www.dailysangram.com/post/301226