২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, বুধবার, ৮:৫৭

জাতিগত নতুন পরিকল্পনা থেকেই রোহিঙ্গা মুসলিম নিধন

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে নতুন জাতিগত ভারসাম্য তৈরির যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে তার মানে হলো বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী আর দেশে ফিরবে না। সম্প্রতি বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়া এসব শরণার্থীদের ফেরত নেয়ার প্রশ্নে মিয়ানমারের কার্যত নেত্রী অং সাং সুচি বলেছেন যে জাতীয়তা যাচাইয়ের ভিত্তিতে এদের ফেরত নেয়া হবে। ১৯ সেপ্টেম্বর দেয়া ভাষণে সুচি আরো বলেন, যে কোন সময় ‘প্রত্যাবর্তন’ শুরু হতে পারে। আগস্টের শেষ দিকে সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ‘নির্মূল অভিযান’ শুরু করার পর এটাই ছিলো সুচি’র প্রথম বক্তব্য।
ওই অভিযানের পর থেকে বাংলাদেশে চার লাখ বিশ হাজারের বেশি মুসলিম রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রয় নেয়। এই জনগোষ্ঠী নিজেদেরকে মিয়ানমারের নাগরিক দাবি করে দেশে ফেরার সুযোগ দানের আহ্বান জানায়। অন্যদিকে সুচি ‘যাচাইকৃত’ শরণার্থীদের ফেরত নিতে চেয়ে দৃশ্যত আন্তর্জাতিক সমালোচনা বন্ধ করার চেষ্টা চালান। মিয়ানমার বাহিনীর দমন অভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে আখ্যায়িত করে জাতিসংঘ। তাড়িয়ে দেয়া রোহিঙ্গাদের কিভাবে ক্ষমতাধর সেনাবাহিনী ফেরত নেবে তা অস্পষ্ট।

রাখাইনে আসলে কত সংখ্যক রোহিঙ্গার বাস তার কোনো বিশ্বাসযোগ্য হিসাব নেই। কারণ মিয়ানমার সরকারের আদমশুমারিতে রোহিঙ্গাদের গণনা করা হয় না। এদেরকে নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না দেশটি। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে এদের সংখ্যা ১১ থেকে ১৫ লাখ বলে উল্লেখ করা হয়। এরও কোনো বিশ্বাসযোগ্য সূত্র নেই। রাখাইনে রোহিঙ্গা ছাড়াও কামান ও অন্যান্য মুসলিম জনগোষ্ঠী রয়েছে। তাই ওই রাজ্যে জনসংখ্যা গণনা করা হলে কতজন নিজেদেরকে রোহিঙ্গা হিসেবে পরিচয় দিতে রাজি হবে তাও পরিষ্কার নয়। রাখাইনের তিনটি টাউনশিপ মংডু, ভুথিদং ও রাথেদং মূলত রোহিঙ্গা অধ্যুষিত অঞ্চল। জাতিসংঘের হিসাব মতে এই তিনটি টাউনশিপের জনসংখ্যা সাড়ে নয় লাখের মতো। যার ৮০% থেকে ৯০% মুসলমান। রাখাইন রাজ্যের মোট জনসংখ্যা ৩২ লাখ, এবং বৌদ্ধরা সংখ্যাগুরু। তবে, সংখ্যা যাই হোক না কেন, সেনাবাহিনীর সর্বশেষ রোহিঙ্গা খেদাও অভিযানে এই তিনটি টাউনশিপ থেকে অর্ধেক মানুষ বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। শুদ্ধি অভিযান চালাতে রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর ৭০ ব্যাটালিয়ন সেনা পাঠানো হয়। বিদ্রোহীদের কথা বলা হলেও মূলত বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে এই অভিযান। সেখানে নিয়মিত ও লাইট ইনফেন্ট্রি ব্যাটালিয়ন মোতায়েন করা হয়। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের হিসেবে রাখাইন রাজ্যে এই মুহূর্তে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার সেনা অবস্থান করছে।

এই বিপুল সংখ্যক সেনার উপস্থিতি দেখে মনে হয় তাদের উদ্দেশ্য যতটা না আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ) দমন, তারচেয়ে বেশি অন্য কোনো কৌশলগত উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য। এই রহস্যজনক ক্ষুদ্র বিদ্রোহী দলটি দেশী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। তাই সামরিক বাহিনীর ভেতরের সূত্র থেকে জানা যায় যে, এই অতিমাত্রায় বলপ্রয়োগের উদ্দেশ্য হলো মুসলিম সংখ্যাগুরু টাউনশিপগুলোতে জনসংখ্যাগত নতুন ভারসাম্য তৈরি। ইয়াংগুনের নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা যায়, সেনাবাহিনীর লক্ষ্য হলো উত্তরপশ্চিমাঞ্চলের টাউনশিপগুলোতে মুসলমানদের সংখ্যা যেন ৬০%-এর বেশি না হয়। বাকি ৪০% হবে বৌদ্ধ। তাই সেনাবাহিনী এখন রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা বাড়িঘরে জাতিগত রাখাইন ও অন্য বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীগুলোকে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়েছে। শেষ পর্যন্ত যেসব মুসলমানকে ফেরত আসার অনুমতি দেয়া হবে তাদেরকেও ইচ্ছাকৃতভাবে একটি নির্যাতনমূলক প্রক্রিয়ার মধ্যে ঠেলে দেয়া হবে। এই দেশটিকে ঐতিহাসিক কাল থেকেই জাতিগত বিদ্বেষ তীব্র।
সূচি’র ‘যাচাই’ প্রক্রিয়ার প্রস্তাব মূলত আগের মতোই রোহিঙ্গাদের অস্বীকার করার নামান্তর। এটা অনেকের কাছে যৌক্তিক দাবি বলে মনে হবে। কিন্তু, যে জনগোষ্ঠীর সদস্যদের নাগরিক হিসেবে স্বীকারই করা হয় না তাদেরকে কিভাবে যাচাই করা হবে? সর্বশেষ যে ৪ লাখ ২০ হাজার শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে তাদের কতজনকে মিয়ানমার ফেরত নিতে রাজি হবে তাও অস্পষ্ট এবং এ জন্য কতটা আন্তর্জাতিক চাপ আসবে তাও বুঝা যাচ্ছে না।

তবে এটা স্পষ্ট যে মিয়ানমারের যে সেনাবাহিনী বাংলাদেশের সীমান্ত জুড়ে নৃশংস শুদ্ধি অভিযান চালিয়েছে তাদের ইচ্ছে হবে না শরণার্থীদের ফেরত নেয়ার। তাছাড়া কৌশলগত পরিকল্পনাকারীরা ওই অঞ্চলে নতুন জনসংখ্যাগত ভারসাম্য তৈরির চেষ্টাতেই এ কাজ করেছেন।
একদা মুসলিম সংখ্যাগুরু রাখাইন রাজ্য ইতোমধ্যে ব্যাপকভাবে সামরিকীকরণ করা হয়েছে। এআরএসএ’র হামলা ঠেকানো বা তাড়িয়ে দেয়া মুসলমানদের ফিরতে না দেয়াÑ সব বিবেচনায় এটা করা হয়েছে। নতুন কোনো দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হোক বা না হোক, সর্বশেষ ঘটনা রাখাইন রাজ্যে একটি নতুন জাতিগত ভারসাম্য সৃষ্টিতে লিভারেজ হিসেবে কাজ করবে। যেখানে মুসলমানরা আর সংখ্যাগুরু থাকবে না, থাকবে বৌদ্ধদের আধিপত্য, আর থাকবে মায়ানমার সেনাবাহিনীর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ।
গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার মিয়ানমারের

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধন ও গণহত্যা চালানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছে মিয়ানমার। তাদের দাবি, বিশ্বের মনযোগ আকর্ষণের জন্য বিদ্রোহীরা মুসলিম নারী, পুরুষ ও শিশুদেরকে আতঙ্কিত করে তাদেরকে বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। জাতিগত অস্তিত্ব অস্বীকার করতে গিয়ে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার করে না মিয়ানমার। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষকে তারা ‘বাঙালি জঙ্গি’ বলে প্রচারণা চালিয়ে থাকে।
গত সোমবার সাধারণ পরিষদের বিতর্ক পর্বের শেষ দিনে মিয়ানমারে নিয়োজিত জাতিসংঘের দূত হাউ দো সুয়ান বলেন, ‘আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, ওখানে কোনও জাতিগত নিধনযজ্ঞ চলছে না; গণহত্যা হচ্ছে না।’ সুয়ানের দাবি, তার দেশের ব্যাপারে দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করা হচ্ছে।
রাখাইন পরস্থিতি নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের প্রথম আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় আগস্টের শেষ সপ্তাহে। রুদ্ধদ্বার বৈঠকে রাখাইন ও রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। পরিষদের সদস্যরা মিয়ানমারের এই দুইপক্ষের মধ্যে সহিংসতা বন্ধ, মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখা ও রাখাইন পরামর্শক কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব পরিষদের দ্বিতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় চলতি বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর।
জাতিসংঘ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এই অভিযানকে জাতিগত নিধন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।

http://www.dailysangram.com/post/301205