২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৭:১৫

পুলিশের 'ক্লোজ ফাইলে' ওরা অজ্ঞাতই থাকে !

পাঁচ বছর আগে ২০১২ সালের ২২ এপ্রিল জাতীয় সংসদের এমপি হোস্টেলের দ্বিতীয় তলার চিলেকোঠা থেকে অজ্ঞাতপরিচয় এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করেছিল পুলিশ। গলায় ওড়না পেঁচানো ওই তরুণীর পেটে ছিল ধারালো অস্ত্রের আঘাত। সর্বোচ্চ নিরাপত্তাবেষ্টিত এমন এলাকা থেকে লাশ উদ্ধারের পর থানা পুলিশ থেকে গোয়েন্দা পুলিশ পর্যন্ত তদন্তে নামে। তথ্য নেওয়া হয় ওই সময়ের অন্তত ১৫ এমপির কাছ থেকে। এত কিছুর পরও খুনি চিহ্নিত হয়নি, এমনকি ওই তরুণীর পরিচয় কী- তাও জানা যায়নি। এমন চাঞ্চল্যকর মামলাটির তদন্ত চলে গেছে পুলিশের 'ক্লোজ ফাইলে'। কেন ওই তরুণীর পরিচয় মিলল না, সে প্রশ্নেরও জবাব নেই।

শুধু এমপি হোস্টেলে পাওয়া তরুণীর ওই লাশটিই নয়, গত আড়াই বছরে দেশের বিভিম্ন এলাকায় তিন হাজার ৩১১ অজ্ঞাতপরিচয় লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। চেহারা দেখে বোঝা যায়, এরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক এবং বেশির ভাগের ক্ষেত্রে মিলেছে হত্যার আলামত। পরিচয় মেলেনি বলে এসব ঘটনায় খুনিরা থেকে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

অজ্ঞাতপরিচয় লাশ উদ্ধারের পর পুলিশ নিয়মমতো সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠায়।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, অজ্ঞাতপরিচয় কারও লাশ উদ্ধারের পর প্রাথমিকভাবে অস্বাভাবিক মৃতু্যজনিত মামলা করা হয়। হত্যার আলামত পেলে তা হত্যা মামলায় রূপান্তর হয়। লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্যও মর্গে পাঠানো হয়। এর পর পরিচয় শনাক্তের জন্য সাধারণত তিন দিন মর্গে লাশ রাখার পর বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়। তবে ভবিষ্যতে পরিচয় শনাক্তের জন্য জামাকাপড় ও ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ এবং ছবি তুলে রাখা হয়। এর পরও পরিচয় না মিললে আদালতে মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বেওয়ারিশ দাফন আর পুলিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে লাশের পরিচয়টাও চিরতরে অন্ধকারে চলে যায়। তদন্ত আর সামনের দিকে যায় না। চূড়ান্ত প্রতিবেদনের নামে মামলাটি মূলত তদন্তের ক্লোজ ফাইলে বন্দি হয়ে পড়ে।
কেন পরিচয় মিলছে না? :দীর্ঘদিনেও অজ্ঞাতপরিচয় লাশের কোনো পরিচয় শনাক্ত না হওয়ার বিষয়ে পুলিশ বিভাগের সুনির্দিষ্ট গবেষণা নেই। তবে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশীদ ব্যক্তিগতভাবে এর কারণ উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেছেন। তিনি ওই কলেজ মর্গে ময়নাতদন্ত করা অজ্ঞাতপরিচয় লাশের পরিচয় শনাক্ত না হওয়ার কারণ সম্পর্কে সমকালকে বলেছেন, পরিচয়হীন লাশের অন্তত ৪০ ভাগ ভবঘুরে বা দরিদ্র পরিবারের। এ জন্য তাদের খোঁজ নেওয়ার মতো স্বজন থাকে না। ৪০ বছরের ওপরে বয়স্ক এসব মানুষের বড় একটা অংশ দুর্ঘটনাজনিত কারণে মারা যায়। অন্তত ৩০ ভাগ লাশ নদী থেকে উদ্ধার করা হয়। তাদের বড় একটা অংশ নৌ-দুর্ঘটনায় মারা যায়। বাকিদের বিভিম্ন এলাকায় হত্যার পর লাশ গুম করতে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়, যা ভাসতে ভাসতে বুড়িগঙ্গা বা আশপাশের নদীতে চলে আসে। এ জন্য পরিচয় মেলে না। বাকি ৩০ ভাগ মানুষ সরাসরি হত্যাকান্ডের শিকার হয়, যারা বয়সে প্রায় সবাই তরুণ-তরুণী। হত্যার পর তাদের নির্জন এলাকা বা সড়কের পাশে, ডোবা ও ডাস্টবিনে ফেলে রাখা হয়।

ডা. হারুন অর রশীদ বলেন, অজ্ঞাতপরিচয় লাশের ১০ থেকে ২০ ভাগ শনাক্ত হলেও বাকিদের মুখমন্ডল একেবারে বিকৃত থাকে, পোশাক থাকে না। থাকলেও তার রঙ নষ্ট থাকে। তারা মর্গে ডিএনএ নমুনা রাখলেও এর প্রতিবেদন পাওয়ার আগেই লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হয়ে যায়। তিনি বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্রের সার্ভার থেকে আঙুলের ছাপ মেলালে অজ্ঞাতপরিচয় প্রায় সব লাশের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হলেও তাদের সে সুযোগ নেই।

এ ধরনের কয়েকটি মামলা বিশ্নেষণ এবং পুলিশ, আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেও অজ্ঞাতপরিচয় লাশের পরিচয় শনাক্ত না হওয়ার কারণ সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া গেছে। তারা বলছেন, হত্যাকান্ডের পর স্বজনদের পক্ষ থেকে আসামি গ্রেফতারে পুলিশের প্রতি একটা চাপ থাকে। গণমাধ্যমেও লেখালেখি হয়। তবে পরিচয়হীন লাশের স্বজন না থাকায় পুলিশের ওপর সে চাপটা থাকে না। এ জন্য রহস্য উদ্ঘাটনে পুলিশও তৎপর হয় না। এ ক্ষেত্রে কোনোভাবে লাশ দাফন ও অপমৃতু্য মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে পারলেই যেন পুলিশ দায়মুক্ত হয়। এসব লাশের আলামত সংগ্রহ ব্যবস্থাপনাও উম্নত নয়। কোনো আলোচিত ঘটনা না হলে লাশের পরিচয় শনাক্তে আঙুলের ছাপ নিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের সার্ভারে থাকা তথ্যের সঙ্গেও মেলানো হয় না। সংরক্ষণ করার জায়গা না থাকায় মর্গ কর্তৃপক্ষও দ্রুত লাশ দাফনের ব্যবস্থা করে ফেলে। লাশ দাফনের পর সিটি করপোরেশনও নির্দিষ্ট সময়ের পর এসব কবর সংরক্ষণ করে না। এ জন্য চেষ্টা করেও স্বজনরা আর শেষচিহ্নটুকু পান না। তাছাড়া গণমাধ্যমে কোনো লাশের ছবি বা বিকৃত ছবি প্রকাশ না করায় নিখোঁজের স্বজনের বড় একটা অংশ জানতে পারে না তার স্বজনের শেষ পরিণতি।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক জহিরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, অজ্ঞাতপরিচয় লাশ উদ্ধারের পর পুলিশের মধ্যে একটা প্রবণতা থাকে তা অপমৃতু্য হিসেবে দেখানোর। এতে মূল বিষয়টা আড়াল হয়ে ঘটনাটি হাল্ক্কা হয়ে যায়। পরিচয় শনাক্তে গৎবাঁধা নিয়মের বাইরে তৎপর হয় না পুলিশ।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) সহেলী ফেরদৌস বলেন, দুর্বৃত্তরা এক এলাকায় খুন করে অন্য এলাকায় লাশ ফেলে দেয়। এ জন্য প্রাথমিকভাবে স্থানীয়রা চিনতে পারেন না। তবে অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার হলে সব থানায় বার্তা দেওয়া হয়। পরিচয় শনাক্তে ডিএনএ নমুনাসহ নানা আলামত রাখা হয়। এ ছাড়া অনেক ভবঘুরে মানুষ দুর্ঘটনায় মারা যায়। কেউই তাদের খোঁজ নেয় না।

ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান সমকালকে বলেন, বেওয়ারিশ লাশ সম্পর্কে বেশির ভাগ মানুষ গণমাধ্যমে সহজে তথ্য পায় না। এ জন্য পরিচয়ও শনাক্ত হচ্ছে কম। তবে ডিএমপির ওয়েবসাইট ও অফিসিয়াল ফেসবুকে বেওয়ারিশ লাশের ছবি প্রকাশ করে পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা করা হয়।

অজ্ঞাতপরিচয় লাশের বড় একটা অংশ উদ্ধার হয় রেললাইনের ওপর থেকে বা রেললাইনের পাশ থেকে। জানতে চাইলে ঢাকা রেলওয়ে থানার ওসি ইয়াসিন ফারুক সমকালকে বলেন, রেললাইন মূলত নির্জন এলাকায়। এ জন্য হয়তো দুর্বৃত্তরা খুনের পর লাশ গুম করতে এসব অঞ্চলে ফেলে রাখে। তবে রেল ক্রসিং বা জনসমাগম এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে অনেকে মারা যায়।

পার পাচ্ছে খুনি : অজ্ঞাতপরিচয়ে উদ্ধার হওয়া বেশির ভাগ লাশের শরীরে হত্যার আলামত মিললেও পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় হত্যার কারণ উদ্ঘাটন হয় না। চিহ্নিত করা যায় না হত্যাকারীদের। বিচারেরও মুখোমুখি করা যায় না কাউকে। এতে আড়ালে থেকে পার পেয়ে যাচ্ছে দুর্বৃত্তরা।

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন ও মানবাধিকার কর্মী এলিনা খান সমকালকে বলেন, পরিচয় থাকার পরও হত্যার শিকার হয়ে বেওয়ারিশ হয়ে যাওয়া একজন মানুষের পরিচয় শনাক্ত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সেটা না করে দায় এড়ানোর চেষ্টা করে। নিখোঁজের পর স্বজনরা জিডি করেন। থানায় ছবি দেন। তবে লাশ উদ্ধারের পর পুলিশ সে জিডি বা ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখে না। অজ্ঞাত লাশ উদ্ধারের পর নেপথ্যের কারণ উদ্ঘাটনেও পুলিশের তৎপরতা দেখা যায় না। এতে খুনিরা উৎসাহিত হয়।

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রাস্টের (্ব্নাস্ট) প্যানেল আইনজীবী মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম শামীমও একই রকম কথা বলেন। তার মতে, শুধু পরিচয় না পেয়েই সুনির্দিষ্ট একটি হত্যাকান্ডে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ায় বিচার প্রক্রিয়া আটকে যায়।
অপরাধবিজ্ঞানের শিক্ষক জহিরুল ইসলাম বলেন, গত মাসে টাঙ্গাইলের মধুপুরে উদ্ধার হওয়া অজ্ঞাতপরিচয় তরুণীর লাশ থেকে সবার শিক্ষা নেওয়া উচিত। ওই তরুণীর লাশ অজ্ঞাত হিসেবে দাফন হয়েছিল। পরে রূপা খাতুন নামে পরিচয় পাওয়ার পর বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য- তাকে চলন্ত বাসে গণধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছিল। এর পর পুলিশ হত্যাকারীদের গ্রেফতারও করল। পরিচয় শনাক্ত না হলে এতবড় অপরাধীরা আড়ালেই থেকে যেত।

আড়াই বছরে সাড়ে তিন হাজার পরিচয়হীন লাশ : পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, গত আড়াই বছরে সারাদেশে অজ্ঞাত পরিচয় তিন হাজার ৩১১ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে পুরুষ দুই হাজার ৪৫৪ ও নারী ৮৫৭ জন। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে সাতশ' অজ্ঞাতপরিচয় লাশ উদ্ধার হয়। সে হিসাবে মাসে ১১৬ জনের বেশি এবং দিনে অজ্ঞাতপরিচয় প্রায় চারজনের লাশ উদ্ধার হয়। এর মধ্যে গত দুই বছরে ১৭টি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। ৯০টি মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হলেও ৩৭টি মামলার তদন্ত চলছে।

http://www.samakal.com/bangladesh/article/17091631