২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৭:১৪

গণশুনানির প্রথম দিনে ভোক্তা প্রতিনিধিরা

বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব অযৌক্তিক

না বাড়িয়ে ৫ পয়সা কমানোর পক্ষে ক্যাব * বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটিও পিডিবির প্রস্তাবে একমত হতে পারেনি * বামপন্থীদের বিক্ষোভ
বিদ্যুতের পাইকারি দাম প্রতি ইউনিটে ৭২ পয়সা বৃদ্ধির প্রস্তাবকে অযৌক্তিক মনে করছেন ভোক্তা ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা। তাদের মতে, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) যেসব ব্যয় বিবেচনা করে দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে সেগুলোর কোনো যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি নেই। বরং বাড়তি ও অযাচিত ব্যয় বাদ দিলে বৃদ্ধির পরিবর্তে উল্টো দাম কমবে।
সোমবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে টিসিবি মিলনায়তনে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির জন্য আয়োজিত ধারাবাহিক গণশুনানির প্রথম দিনে দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের বিরুদ্ধে জোরালো যুক্তি উত্থাপিত হয়। ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, ‘ইউনিটপ্রতি ৭২ পয়সা দাম বৃদ্ধির যে প্রস্তাব করা হয়েছে সেটি অযৌক্তিক। উল্টো এ দাম ইউনিটপ্রতি ৫ পয়সা কমানো উচিত।’ এদিকে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কারিগরি মূল্যায়ন কমিটিও পিডিবির প্রস্তাবে একমত হতে পারেনি। তারা পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ৭২ পয়সা না বাড়িয়ে তা কমিয়ে ৫৭ পয়সা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে।

শুনানিতে পিডিবির উত্থাপিত প্রস্তাবে বলা হয়, বর্তমানে প্রতি ইউনিট পাইকারি বিদ্যুতের গড় সরবরাহ ব্যয় ৫ টাকা ৫৯ পয়সা। অথচ ২০১৬-১৭ অর্থবছরের হিসাবে পিডিবি পাইকারি পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ৪ টাকা ৮৭ পয়সায় বিক্রি করে। এতে দেশের একক পাইকারি বিদ্যুৎ ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান পিডিবির ইউনিটপ্রতি আর্থিক লোকসান হয় ৭২ পয়সা। চলতি অর্থবছরে পিডিবি পাইকারি বিদ্যুতের প্রাক্কলিত সরবরাহ ব্যয় ধরেছে ইউনিট প্রতি ৫ টাকা ৯৯ পয়সা। এ হিসাবে ইউনিটপ্রতি লোকসান হবে ১ টাকা ৯ পয়সা। এই বিপুল আর্থিক ক্ষতি সমন্বয় করার জন্যই পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়ানো উচিত। পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী খালেদ মাহমুদ শুনানিতে প্রস্তাব তুলে ধরেন। ২০১৬-১৭ বছরের হিসাবকে ভিত্তি ধরে পিডিবির প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করে বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি চলতি বছরের জন্য পাইকারি বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ৫৭ পয়সা বাড়ানোর সুপারিশ করেছে।

তবে স্বাধীন গবেষক ও ভোক্তা অধিকার সংগঠনগুলোর দাবি- অনেক তথ্য পিডিবি গোপন রেখে পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম গণশুনানিতে বলেন, ‘অন্য বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো যেভাবে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তেল আমদানি করে থাকে, পিডিবিকে সরকার সে অনুমতি দেয়নি। ফলে বিপিসির (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন) বেঁধে দেয়া বেশি দামে তাকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জ্বালানি তেল কিনতে হচ্ছে। এটি বিদ্যুতের দাম বাড়ার অন্যতম কারণ। এম শামসুল আলমের এ বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া গেছে খোদ কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির দেয়া প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়, ‘বেসরকারি উৎপাদন কেন্দ্রকে ফার্নেস অয়েলের ওপর আরোপিত সমুদয় শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর থেকে অব্যাহতি দিয়ে তেল আমদানির অনুমতি দিয়েছে সরকার। এতে তারা প্রতি লিটার ফার্নেস অয়েল পাচ্ছে ৩০ টাকায়। এ অনুমতি পিডিবির নেই। যদি পিডিবি তেল আমদানির অনুমতি পেত, তাহলে ডিজেল লিটারপ্রতি মূল্য হতো ৫০ টাকা এবং ফার্নেস অয়েলের দাম হতো ৩০ টাকা। এতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতে উৎপাদন ব্যয় কমত ৩২ পয়সা। বর্তমানে বিপিসির কাছ থেকে পিডিবি ফার্নেস অয়েল ৪২ টাকা লিটার ও ডিজেল ৬৫ টাকা দরে কেনে। বিইআরসির মূল্যায়ন কমিটির হিসেবে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় হলে বছরে পিডিবির ব্যয় কমবে ১ হাজার ৮৭১ কোটি টাকা।’
গণশুনানিতে এম শামসুল আলম আরও বলেন, ‘মেঘনাঘাট বিদ্যুৎ কেন্দ্রে চুক্তি অনুসারে ফার্নেস অয়েলের পরিবর্তে ডিজেল ব্যবহার করায় ৯ পয়সা এবং পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড পিক ও অফ-পিক মিটার ব্যবহার না করায় ৫ পয়সা ঘাটতি হয়েছে। দাম বৃদ্ধির জন্য ভর্তুকিকে লোন হিসেবে বিবেচনা নেয়ায় ব্যয় বৃদ্ধি দেখানো হয়েছে ২১ পয়সা। এ ছাড়া বিদ্যুৎ রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন তহবিলের জন্য অতিরিক্ত ২৬ পয়সা চাওয়া হয়েছে। এই বাড়তি ও অযাচিত ব্যয়গুলো হিসাবে নিলে দেখা যায় বিদ্যুতের দাম না বেড়ে বরং কমবে।’

বিইআরসির মূল্যায়ন কমিটিও তাদের সুপারিশে বলেছে, সামিটের ৩০৫ মেগাওয়াটের মেঘনাঘাট ও আরপিসিএলের ১৪৯ মেগাওয়াটের ডুয়েল ফুয়েল বিদ্যুৎ কেন্দ্র তেলের পরিবর্তে গ্যাসে চালালে প্রতি ইউনিটে ১৩ টাকা ব্যয় সাশ্রয় হবে। কমিটি পিডিবির ডিজেলচালিত ১৪০ মেগাওয়াটের প্রায় ৪০ বছর পুরনো কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধের সুপারিশ করেছে। কারণ এই কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ব্যয় প্রতি ইউনিটে ৩৭ টাকা ৪৮ পয়সা।

শুনানিতে অংশ নিয়ে সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, ‘সরকার দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠীকে বিদ্যুতের সুবিধায় আনতে চাইছে। তাই অযৌক্তিকভাবে দাম বৃদ্ধি করা হলে এ উদ্দেশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ তিনি বলেন, বন্যার কারণে জনগণের একটি বড় অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ সময় বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করা যৌক্তিক নয়। সিপিবি নেতা রুহিন হেসেন প্রিন্স বলেন, ‘ব্যয়বহুল রেন্টাল-কুইক রেন্টাল প্রকল্প বন্ধ করার কথা থাকলেও সরকার তা করছে না। এতে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে, যা মেটাতে হচ্ছে ভোক্তাদের।’
বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি করা হলে অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)। সংগঠনটির মতে, এ মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি না করে সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের পরিচালন ও ব্যবস্থাপনা দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা উচিত। গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে সংগঠনটির পক্ষ থেকে এ আহ্বান জানানো হয়।

গণশুনানিতে অংশ নেয়া বক্তারা মনে করেন, ‘বিদ্যুতের পুনরায় মূল্য বৃদ্ধি করা হলে উৎপাদনমুখী শিল্প বিশেষ করে গার্মেন্ট কারখানা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, স্টিল রি-রোলিং, টেক্সটাইল খাতে প্রায় ৮ থেকে ১০ শতাংশ উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যেতে পারে। মূল্য বৃদ্ধির এ প্রস্তাবে ইতিমধ্যে ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সংগঠন উদ্বেগ প্রকাশ করছে। যদি আবারও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করা হয়, তাহলে প্রতিযোগী মূল্যে শিল্প উৎপাদন সক্ষমতা ব্যাহত হবে। এ ছাড়া বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পগুলো, রফতানি সক্ষমতা, শিল্প বহুমুখীকরণ ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি ব্যবসা পরিচালনা ব্যয় বৃদ্ধি পাবে।

বিদ্যুতের ট্যারিফ বাড়ানোর প্রস্তাব প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে তারা সরকারি সংশ্লিষ্ট সংস্থাসহ সব সরকারি-বেসরকারি স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে নিয়ে একটি ‘জ্বালানি মনিটরিং কমিটি’ গঠনের পরামর্শ দেন। বক্তারা বলেন, ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি আধুনিক জীবন ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ। অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ শিল্প, কৃষি ও সেবা খাতের ক্রমবর্ধমান অগ্রগতির মূল চাবিকাঠি। ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রস্তাবিত মূল্য বৃদ্ধির উদ্যোগ খুচরা পর্যায়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে ৯ টাকা ১৬ পয়সা থেকে ১০ টাকা, বাণিজ্যিক ব্যবহারকারীদের ক্ষেত্রে ১১ টাকা ৯৮ পয়সা থেকে ১২ টাকা ৯৮ পয়সা, বৃহৎ শিল্পকারখানার ক্ষেত্রে ৯ টাকা ৫২ পয়সা থেকে ১০ টাকা ৩২ পয়সা এবং গৃহস্থালিতে ব্যবহারের ক্ষেত্রে ৫ টাকা ৬৩ পয়সা থেকে ৬ টাকা ১০ পয়সা হারে বৃদ্ধি পাবে।
গণশুনানিতে সভাপতিত্ব করেন বিইআরসির চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম। উপস্থিত ছিলেন কমিশন সদস্য রহমান মুরশেদ, মাহমুদউল হক ভুঁইয়া, আবদুল আজিজ খান ও মিজানুর রহমান। বক্তব্য দেন মূল্যায়ন কমিটির আহ্বায়ক এ কে মাহমুদ, সদস্য কামারুজ্জামান, গণসংহতির জুনায়েদ সাকী, সিএনজি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের যগ্ম মহাসচিব হাসিন পারভেজসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও ভোক্তা প্রতিনিধিরা।

https://www.jugantor.com/first-page/2017/09/26/158509