২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৭:১৩

কোরবানির চামড়া পাচার হচ্ছে!

ঈদ-পরবর্তী ২০ দিনে ২০ ভাগ চামড়াও কিনেনি ট্যানারি মালিকরা * বেশি দাম ও নগদ দিয়ে কিনে নিচ্ছে পাচারকারীরা * চামড়া কিনতে বিপুল অঙ্কের অর্থ লগ্নি ভারতীয় আমদানিকারকদের
কোরবানির চামড়া পাচার হচ্ছে। লবণযুক্ত চামড়ার স্তূপ ভাঙা শুরু হওয়ার পরই এ প্রবণতা বেড়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্বল নজরদারি অথবা যোগসাজশে তা পাচার হচ্ছে। চামড়া ব্যবসায়ী ও ট্যানারি মালিকসংশ্লিষ্টদের দাবি, দেশীয় কিছু মজুদদার এবং পাচারকারী চক্রের সহায়তায় এ চামড়া ভারতে পাচার হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চামড়া কিনে নিতে ভারতীয় আমদানিকারকরা দেশে বিরাট অঙ্কের অর্থ লগ্নি করেছে। এর উদ্দেশ্যই হচ্ছে দেশীয় মজুদদার ও পাচারকারীদের দিয়ে কোরবানি-পরবর্তী ভালোমানের লবণযুক্ত চামড়া বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নগদ অর্থে কিনে নেয়া। এরই মধ্যে সহায়ক চক্রটি ভারতীয় আমদানিকারকদের উদ্দেশ্য পূরণে অনেক দূর এগিয়েছে।

এ কারণে কোরবানির ২০ দিন পার না হতেই কয়েকদিন ধরে চামড়াবাহী অনেক ট্রাক বিনা বাধায় যমুনা সেতু, মেঘনা সেতু, ভৈরব ব্রিজ এবং আরিচা ফেরিঘাট পার হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। অথচ দেশীয় চামড়া রক্ষায় বাণিজ্য, স্বরাষ্ট্র, শিল্প, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ঈদ-পূর্ববর্তী যৌথ বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, কমপক্ষে এক মাস ঢাকার চামড়া বিভিন্ন সীমান্ত পার হতে পারবে না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, রাজধানীসহ উত্তরবঙ্গ ও পূর্বাঞ্চলের সীমান্তবর্তী বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও ভারতীয় আমদানিকারকদের দেশীয় চক্রটি নগদ অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ চামড়া কিনে নিয়েছে। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, ট্যানারি মালিকরা ২০ দিনে কোরবানিতে সংগ্রহ হওয়া চামড়ার ২০ ভাগও এখন পর্যন্ত কিনতে পারেননি। চামড়া বিক্রি করে নগদ অর্থ না পাওয়া এবং বকেয়া পরিশোধ না করায় ক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীরাও কোনো চামড়া দিচ্ছেন না ট্যানারি মালিকদের। এ পরিস্থিতিতে দেশে চামড়া সংরক্ষণ ও লবণজাতের সবচেয়ে বড় আড়ত পোস্তা ও আমিনবাজারের বড় ব্যবসায়ীদের চামড়াও নগদ অর্থের বিনিময়ে চলে যাচ্ছে পাচারকারীদের হাতে। একই প্রলোভনে গোপনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন মোকামের বড় বেপারিরাও এ পাচারকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. সাখাওয়াত উল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, আমরা চামড়া কেনা শুরু করেছি। ভালোমানের চামড়া ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেশি দাম দিয়ে কিনছি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমাদের নগদ টাকার বিরাট সংকট চলছে। আর নগদ টাকা দিতে না পারায় চামড়া ব্যবসায়ীরাও ট্যানারি মালিকদের চামড়া দিতে চাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে চামড়াবাহী ট্রাক রাজধানী থেকে উত্তরবঙ্গ ও পূর্বাঞ্চলসহ বিভিন্ন সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় যাচ্ছে বলে শুনেছি। তিনি এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সদস্যদের দেশের চামড়া রক্ষায় দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ব্যাংকগুলো ট্যানারি মালিকদের নগদ অর্থের সংকট কাটাতে কোনো সহায়তা দিচ্ছে না। আবার কাস্টমসও নগদ অর্থপ্রবাহে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রফতানি পণ্যের বিপরীতে প্রদেয় ডিউটি ড্র ব্যাংকের টাকা ৬ মাস ধরে ফেরত দিচ্ছে না। পাশাপাশি ট্যানারিতে যে সলিড ওয়াস্ট চামড়া (স্পি¬ট লেদার) তৈরি হয়, সব ট্যানারি মালিকই তা রফতানি করে থাকে। কিন্তু গত মাস থেকে কাস্টমস এ স্পি¬ট লেদার রফতানি করতে দিচ্ছে না। সাভারের ট্যানারি পুরোপুরি প্রস্তুত না হওয়ায় সেখান থেকেও রফতানি প্রক্রিয়ায় যেতে পারেনি বেশিরভাগ ট্যানারি। মূলত এসব কারণেই ট্যানারি মালিকরা নগদ টাকার সংকটে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. রবিউল আলম বলেন, কোরবানির চামড়া সাভার বিসিক চামড়া শিল্পনগরীতে তা কেনার কথা ট্যানারি মালিকদের; কিন্তু যতদূর জেনেছি ট্যানারি মালিকরা নিজেদের সংগ্রহের বাইরে এখন পর্যন্ত ২০ শতাংশ চামড়াও কিনতে পারেনি। নগদ টাকা না পাওয়ায় তারা ট্যানারিওয়ালাদের চামড়া দিচ্ছে না। আবার বেপারিদের কাছে মজুদ চামড়াও ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। তাহলে ওই চামড়া কারা কিনে নিচ্ছে? কোথায় যাচ্ছে? কোন অঞ্চল দিয়ে যাচ্ছে? এখনও তো কোরবানির এক মাস পেরোয়নি। চামড়াবাহী ট্রাক ওয়ার্নিং পয়েন্ট (যমুনা সেতু, ভৈরব ব্রিজ, মেঘনা সেতু, আরিচাঘাট) পার হচ্ছে কীভাবে? বিষয়টি রহস্যজনক বলেও দাবি করেন তিনি। ঈদের আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আশ্বস্ত করে বলা হয়েছিল, দেশের যে কোনো সীমান্ত দিয়ে কোরবানির চামড়া পাচার ঠেকাতে সতর্ক অবস্থানে থাকবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ লক্ষ্যে সীমান্ত এলাকাগুলোয় বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশের (বিজিবি) টহল জোরদার এবং বিভিন্ন পয়েন্টে বিজিবির লোকবল বাড়ানোর কথা বলা হয়। পাশাপাশি চামড়াবোঝাই কোনো ট্রাক সীমান্ত অভিমুখে যাতে না যেতে পারে, সে লক্ষ্যে বন্দর এলাকাসহ স্থল, জল ও রেলপথে কঠোর নজরদারি বাড়ানোর বিষয়েও আশ্বস্ত করা হয়। এছাড়া চামড়া চোরাচালানের সঙ্গে জড়িতদের তালিকা তৈরি করে তাদেরও কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখার কথা বলা হয়েছে। ঈদের দিন সকাল থেকে পরবর্তী এক মাস এ সতর্কতা থাকবে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানানো হয়েছিল। রবিউল আলম বলেন, ট্যানারি শিল্প সাভারে সরিয়ে নেয়ার পর দেশে-বিদেশে এ শিল্পের সম্ভাবনার কথা জানান দিচ্ছিল। কারণ সেখানে সবক’টি শিল্প ইউনিটের উৎপাদন হাজারীবাগ থেকে দ্বিগুণ সক্ষমতা নিয়ে শুরু হয়েছে। এ শিল্প চালু রাখতে হলে প্রচুর পরিমাণ চামড়া দরকার। এখন সেই চামড়াই যদি না থাকে, তাহলে ট্যানারি সরিয়ে নিয়ে কী হবে? এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ট্যানারি মালিকদের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থতা এবং সিন্ডিকেট ও মজুদদারদের অব্যাহত কারসাজি আজ দেশের মূল্যবান চামড়া নিয়ে এ শঙ্কাময় পরিস্থিতি তৈরি করেছে। তিনি দাবি করেন, যে কোনো মূল্যে পাচার ঠেকাতে হবে। দেশের চামড়া দেশে রাখতে হবে। এর জন্য ট্যানারি মালিকদেরই সদিচ্ছার মনোভাব দেখাতে হবে। লবণযুক্ত চামড়ার ন্যায্যমূল্য দিতে হবে। নয় তো এবার এমনিতেই সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়নি। তদুপরি ভালো দাম না পেলে ওই চামড়া রক্ষায় যতই বাঁধ দেয়া হোক, তাতে পাচার ঠেকানো যাবে না বলে মনে করেন তিনি।

https://www.jugantor.com/last-page/2017/09/26/158516