নদী রক্ষায় ঢাকঢোল পেটানো হলেও দূষণ-দখল থেমে নেই। কোনোটা শুকিয়ে খাল; আবার কোনোটা ফসলি জমি। যৎসামান্য পানি যেগুলোতে আছে, তাও বিষাক্ত বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে। মানিকগঞ্জের তরা এলাকায় কালীগঙ্গা নদীর করুণ দৃশ্য
২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৭:১২

সঙ্কুচিত হয়ে আসছে নদী

এখনই নিতে হবে কার্যকর পদক্ষেপ

নীরবেই চলে গেল ‘বিশ্ব নদী দিবস’। অথচ নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। নদীই এ দেশের প্রাণ। অর্থনীতির ভিত্তি। দেশের গ্রামীণ জীবন ধারা, জীবিকাসহ কৃষি ও ফসলের সাথে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে বাংলাদেশের সব নদীর।
সেই সব নদী প্রতিদিন একটু একটু করে খুন করা হচ্ছে। দখল করা হচ্ছে নদী, বিষজলে মরে যাচ্ছে মাছ। শিল্পবর্জ্যরে বিষ মিশছে নদীর পানিতে। উজানের বাঁধে হারিয়ে যাচ্ছে নদীর চিহ্ন।

নদী দূষণ, দখল, বিষময় করার সব দায় কিছু ক্ষমতাবানের। জীবন-জীবিকা, কৃষি, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন অনুষঙ্গে নদী মানুষের জীবনে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। দখল-দূষণে প্রায় বিপন্ন বাংলাদেশের নদ-নদী। বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিপাদ্য নিয়ে নানা আয়োজনে গতকাল পালিত হয়েছে বিশ্ব নদী দিবস। প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রোববার বিশ্ব নদী দিবস হিসেবে পালিত হয়। সেই হিসেবে এবার গতকাল রোববার ছিল বিশ্ব নদী দিবস। ১৯৮০ সাল থেকে প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রোববার বিশ্ব নদী দিবস হিসেবে পালন করতে শুরু করে কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া (বিসি) ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি। আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় বিসি রিভারস ডে পালন দিয়ে। ১৯৮০ সালে কানাডার নদীবিষয়ক আইনজীবী মার্ক অ্যাঞ্জেলো দিনটি ‘নদী দিবস’ হিসেবে পালনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বিসি রিভারস ডে পালনের সাফল্যের হাত ধরেই তা আন্তর্জাতিক রূপ পায়। ২০০৫ সালে জাতিসঙ্ঘ নদী রক্ষায় জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে ‘জীবনের জন্য জল দশক’ ঘোষণা করে। সে সময়ই জাতিসঙ্ঘ দিবসটি অনুসমর্থন করে। এরপর থেকেই জাতিসঙ্ঘের বিভিন্ন সহযোগী সংস্থা দিবসটি পালন করছে, যা দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে। ৬০টির বেশি দেশে পালিত হয় বিশ্ব নদী দিবস। বাংলাদেশে ২০১০ সাল থেকে রিভারাইন পিপল নামে একটি সংস্থা দিবসটি পালন করে আসছে।
মানিকগঞ্জে রয়েছে নদ-নদীর আধিপত্য। দেশের বৃহৎ পদ্মা ও যমুনার মতো বড় দু’টি নদী ছাড়াও মানিকগঞ্জে প্রবহমান ছিল ইছামতী, কালীগঙ্গা, কান্তাবতী, মনলোকহানী, গাজীখালী, ক্ষীরাই, মন্দা, ভুবনেশ্বর ও ধলেশ্বরীর মতো ৯টি শাখা নদী। জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এসব নদী শুকিয়ে পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। উজানে ভারতের পানি প্রত্যাহার, ড্রেজিং না করা ও দখলের কারণে ছয়টি নদী, ৪২টি খাল-বিল ও দুই শতাধিক ছোট জলাশয়ের অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়েছে। একসময় যেখানে বছরজুড়ে পানি থাকত, শুকনো মওসুমে সেখানে এখন এক ফোঁটা পানিও মেলে না। নৌকার পরিবর্তে চলে ঘোড়ার গাড়িসহ বিভিন্ন যানবাহন। এ যেন পানির দেশে পানির জন্য হাহাকার।

নদীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল এ অঞ্চলের কৃষি, অর্থনীতি, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও সভ্যতা। নদী কেন্দ্রিক ঐতিহ্য, জীবন-জীবিকা, সংস্কৃতি, সভ্যতা, কৃষি, অর্থনীতি ক্রমেই হয়ে আসছে সঙ্কুচিত। এ ধারা অব্যাহত থাকলে নদ-নদীর অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। সাথে সাথে পাল্টে যাবে নদীকেন্দ্রিক জীবন-জীবিকা ও সংস্কৃতি। মানিকগঞ্জ সীমানায় এর মধ্যে বেশ কয়েকটি নদীর অস্তিত্ব হারিয়ে গেছে। মানিকগঞ্জ জেলা শহর ধলেশ্বরী-কালীগঙ্গা নদীর তীরে। করুণ ও রুগণ এ দু’টি নদী আজ মৃতপ্রায়। ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে ধলেশ্বরী আর কালীগঙ্গা নদী আজ কেবল কাগজে-কলমে; বাস্তবে এই নদীর চিত্র এতটাই করুণ, বোঝার উপায় নেইÑ নদীর বুকে চর না কি চরের বুকে নদী?

এই নদীকে দখল, দূষণমুক্ত ও রক্ষার প্রত্যয় নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করছেন মানিকগঞ্জ ধলেশ্বরী নদী বাঁচাও আন্দোলন ও বেসরকারি উন্নয়ন, গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিকসহ সচেতন ও সুশীল সমাজের নেতারা।
নদী রক্ষায় ঢাকঢোল পেটানো হলেও হন্তারকেরা দূষণ-দখলে থেমে নেই। কোনোটা শুকিয়ে খাল; কোনোটা ফসলি জমি। অল্পস্বল্প পানি যেগুলোতে আছে, তা-ও বিষাক্ত বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে। ভারত উজানে বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশের নদীগুলোর টুঁটি চেপে ধরছে। দিন দিন সঙ্কুচিত হচ্ছে অনেক নদীর সীমানা।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/254909