২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৭:০৬

আমদানি করা সাড়ে ৩ লাখ টন আতপ চাল নিয়ে বিপাকে সরকার

এইচ এম আকতার: আমদানি করা আতপ চাল নিয়ে এবার বিপাকে সরকার। আতপ চালের সংরক্ষণ ক্ষমতা কম থাকায় তা দ্রুত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ চালে ভাত খাওয়ার অভ্যাস না থাকায় বিক্রিও করতে পারছে না সরকার। ওএমএস এ আতপ চাল বিক্রি করছে দ্বিগুণ দামে। আর এ কারণেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ক্রেতারা। এক সপ্তাহে সারা দেশে মোট চাল বিক্রি হয়েছে মাত্র ১৪ হাজার ৪শ ৪৫ টন। আতপ চাল খোলা বাজারে বিক্রি হলেও দাম কমার কোন প্রভাব নেই। চাল আমদানিতে ভর্তুকি দিলেও সুফল পায়নি জনগণ। উল্টো তা চাল ব্যবসায়ীদের পকেটে গেছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ হিসাব বলছে, ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারের কাছে চালের মজুদ আছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মেট্রিক টন। আগের বছর একই সময়ে যা ছিল প্রায় আট লাখ মেট্র্রিক টন। এসবই আতপ চাল বলে জানা গেছে।
জানা গেছে,সিদ্ধ চালের তুলনায় আতপ চালের সংরক্ষণ ক্ষমতা কম থাকায় আমদানি করা চাল বিবর্ণ আকার ধারণ করাসহ নষ্ট হয়ে যেতে পারে- এমন আশঙ্কা করছে খাদ্য অধিদপ্তর। তাই চাল দ্রত বিক্রি করতে জেলা শহরগুলোর খাদ্য নিয়ন্ত্রক অফিসে চিঠি পাঠানো হয়েছে। চাপ দেয়া হচ্ছে ডিলারদের। কিন্তু এসবে কোন কাজ হচ্ছে না। ফলে বিদেশ থেকে আমদানি করা আতপ চাল নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে সরকার। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, প্রথম দিন রাজধানীতে ১০৯টি ট্রাকে চাল বিক্রি করা হলেও মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে বিক্রি করা ট্রাকের সংখ্যা কমে এসেছে ২৩ এর কোটায়। দিন দিনই কমছে চাল বিক্রির পরিমাণ। গত এক সপ্তাহে সারা দেশে মোট চাল বিক্রি হয়েছে মাত্র ১৪ হাজার ৪শ ৪৫ টন। এর বেশিরভাগ চালই বিক্রি হয়েছে রাজধানী ঢাকার বাইরে। ঢাকা শহরে বিক্রি হয়েছে খুবই কম।
ডিলাররা বলছেন, ওএমএসের আতপ চালে তাদের লাভ তো দূরের কথা উল্টো ক্ষতি হচ্ছে। তাই চাল সরবরাহ করতে ইচ্ছুক নয় তারা। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে তাদের চাপ দেয়া হচ্ছে চাল বিক্রি করার জন্য। এই অবস্থায় তারাও পড়ছে বিপাকে।
রাজধানীর আজিমপুরের ডিলার গোলাম মাওলা বলেন, মাত্র একদিন ঢাকায় চাল বিক্রি করেছি। আর ফরিদপুরের সদরপুরেও চাল বিক্রি করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ঢাকায় একদিনে বিক্রি করা গেলেও ফরিদপুরে তাও সম্ভব হয়নি।
তিনি বলেন, এমন চাল আমদানি করা হয়েছে যার খুদ (ভাঙ্গা চাল) গরুও খেতে চায় না। এই চাল নিয়ে মানুষ কী করবে। মানুষ ভাতই খেতে পায় না আর পিঠা খাবে কি করে। আতপ চাল দিয়ে আমাদের দেশের লোকরা পিঠা খেয়ে থাকেন। এখন তো আর পিঠা খাওয়ার সময় নয়। তাই এ চাল তেমন বিক্রি হচ্ছে না।

সাধারণত আতপ চালের সংরক্ষণ ক্ষমতা সিদ্ধ চালের তুলনায় ৮ থেকে ১০ গুণ কম। আতপ চাল করতে ধান শুধু রোদে শুকিয়ে সরাসরি রাইস মিলে ভাঙিয়ে তৈরি করা হয়। ফলে অল্প সময়ে এই চাল বাইরের আদ্রতা শুষে নিতে শুরু করে। এরফলে চালে দ্রত পোকা ধরে ও নষ্ট হয়ে যায়। আর সিদ্ধ চাল তৈরি করতে ধানকে শুকিয়ে তা প্রথমে ভাপে গরম করে নিয়ে পানিতে ১৬-২০ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখা হয়। এর পর আবার তা সিদ্ধ করে শুকানো হয়। ফলে তা সহজে নষ্ট হয় না।
জানা গেছে,আতপ চালের ভাত খেতে বেশ মিষ্টি লাগে। আর এ চালও খেতে মিষ্টি লাগে। এতে করে এ চাল পোকায় বেশি খেয়ে থাকে। সিদ্ধ চাল এক বছর সংরক্ষণ করা গেলেও এ চাল ২ মাসও সংরক্ষণ করা যায় না। দু মাসের বেশি এ চাল রাখা হলে তা লাল বর্ণের হয়ে যায়। এর ভাত খেতেও তখন গন্ধ লাগে।
খাদ্য অধিদপ্তরের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, বাজারে আতপ চালের প্রতি ভোক্তাদের অনীহা নিয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। কিভাবে কী করা যায় তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে।
তিনি বলেন, চাল বিক্রির জন্য ডিলারদের চাপ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু তারা চাল নিতে অপরাগতা প্রকাশ করছে। ফলে আমদানি করা আতপ চাল নিয়ে কিছুটা বেকায়দায় রয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
ধোলাইপাড়ে ওএমএস চাল বিক্রেতা আমজাদ বলেন,সারা দিন চাল নিয়ে দাড়িয়ে থাকলেও কেউ চাল ক্রয় করছে না। আসলে সরকার নয় চালের ডিলার নিয়ে আমরা মহা বিপাকে পড়েছি। ক্রেতারা চাল ক্রয় না করলে আমাদের কি করার আছে। প্রতিটি দোকানে দেশীয় আতপ চাল বিক্রি হচ্ছে ৩০-৩২ টাকায়। তাহলে কেন আমদানি করা ভাঙ্গা আতপ চাল ট্রাক থেকে ৩০ টাকায় ক্রয় করবে।

গার্মেন্ট শ্রমিক আলেয়া। মা আর ছোট বোনকে নিয়ে থাকেন পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়া এলাকায়। এখানে একটি গামের্ন্টে চাকরি করেন তিনি। মাসে তার আয় ৮ হাজার টাকা। তার মা একটি বাসায় জিয়ের কাজ করেন। ওএমএস’র চাল কিনতে এলে তার সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি জানান,চাল কিনতে এসে আটা কিনেছি। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন,বাসায় তো গরু নেই। এই চাল নিয়ে কি করবো। গরুও এ চাল খেতে চায় না। তাহলে আমরা এ চাল নিয়ে কি করবো।
প্রশ্ন হলো সরকার কেন ২শ’ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে এ চাল আমদানি করলো। সরকারের মন্ত্রী বলছেন,খাদ্য অভ্যাস পরিবর্তন করতে। মানুষ কেন খাদ্য অভ্যাস পরিবর্তন করবে। মন্ত্রী এমপিরা কি কেউ খাদ্য অভ্যাস পরিবর্তন করেছেন। মানুষ কি চাইলেই তার খাদ্য অভ্যাস পরিবর্তন করতে পারে।
যে চালের ভাত খেতে দেশের নাগরিক অভ্যস্ত নয় সে চাল কেন ভর্তুকি দিয়ে আমদানি করা হলো। এখন সে চাল সংরক্ষণও করা যাচ্ছে না। তাহলে কার স্বার্থে এ চাল আমদানি করা হলো। অথচ সরকার ঢাক ঢোল পিটিয়ে বলছে চাল আমদানি হচ্ছে। বাজার নিয়ন্ত্রণ হবে। চালের দাম কমবে।
সম্প্রতি বিদেশ থেকে যে চাল আমদানি করা হচ্ছে তারও বেশিরভাগ আতপ চাল। ভিয়েতনাম থেকে আড়াই লাখ টন চাল দেশে এসেছে। এর মধ্যে দুই লাখ টনই আতপ। কম্বোডিয়া থেকে যে আড়াই লাখ টন চাল আসছে সেটাও আতপ। এছাড়া মিয়ানমার থেকে যে চাল আমদানি হবে তাও আতপ।
প্রশ্ন হচ্ছে আমদানি করা এসব চাল কি হবে। আর সংরক্ষণই হবে কোথায়। তাহলে কি পোকার জন্যই এ চাল আমদানি হচ্ছে। আর এত পোকা সরকার পাবেই বা কোথায়।

এদিকে চালের দাম সহনীয় রাখতে গেলো তিন মাসে সরকার প্রায় দুইশো কোটি টাকার রাজস্ব ছাড় দিয়েছে। অথচ এর সুফল পায়নি ভোক্তারা। উল্টো বাড়তি দামেই চাল কিনতে হয়েছে তাদের। বিশ্লেষকরা বলছেন, সাধারণ মানুষের জন্য এ সুবিধা দেয়া হলেও বাস্তবে তা গেছে মিল মালিক ও আমদানিকারকদের পকেটে। সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবির হিসাবে, এখনো সরু চাল বিক্রি হচ্ছে আগের দামেই। কেজি প্রতি এক থেকে দুই টাকা কমেছে মোটা চালের দাম।
আগাম বন্যা, হাওরে ফসলহানি এবং সরকারের মজুদ কমে যাওয়ায় বাজার নিয়ন্ত্রণে গত ২০ জুন চালের আমদানি শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এরপরও বাজার স্বাভাবিক না হওয়ায় ঠিক একমাস পরই ডিসেম্বর পর্যন্ত বাকিতে চাল আমদানির সুযোগ করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতেও কাজের কাজ কিছু না হলে আগস্ট মাসে ১০ শতাংশ শুল্ক নামিয়ে আনা হয় ২ শতাংশে।

এনবিআর সূত্রে জানা যায়, জুন এবং জুলাই এই দুই মাসেই সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয় ১৩৫ কোটি টাকা। দ্বিতীয় দফায় শুল্ক ছাড়ের ফলে সাময়িক হিসাবে আরো ৬৫ কোটি টাকা রাজস্ব হারায় সরকার। সবমিলে রাজস্ব ক্ষতি প্রায় ২শ কোটি টাকা। কিন্তু বিপরীতে বাজার দাম তো কমেইনি বরং দফায় দফায় তা বেড়েছে। সম্প্রতি মিল মালিকদের সাথে সরকারের বৈঠকের প্রতি কেজিতে এক দুই টাকা কমলেও তা এখনো অস্বাভাবিক বলছেন ক্রেতারা।
সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমাতে চাল আমদানিতে এই সুবিধা দেয়া হলেও বাস্তবে এর সুফল গিয়েছে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের পকেটে।

গবেষণা সংস্থা বিআইডিএসর মহাপরিচালক কে এ এস মুরশেদ বলেন, পদক্ষেপ ঠিক থাকলেও বিলম্বের কারণে সুফল পায়নি ভোক্তরা। চাল আমদানি করার কথা ছিল ফেব্রুয়ারি মার্চে। সে চাল এখন আমদানি করলে তার ফল কি জনগণ পাবে?
তিনি আরও বলেন,আতপ চাল আমদানি না করে সরকার যদি সিদ্ধ চাল আমদানি করতো তাহলে কিছুটা সুফল দেশের জনগণ পেতো। ভর্তুকি জনগণের পকেটে যেতো। এখন সরকার যে শুল্ক ছাড় দিয়েছে তাতে কোন লাভ?সুফল জনগণ পায়নি। তাহলে কেন শুল্ক প্রত্যাহার করা হলো।
সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবির হিসাবে এখনো বিভিন্ন মানের চিকন চাল এক সপ্তাহ আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকায়। আর মোটা স্বর্ণা চাল কেজিতে ২ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে ৪২ থেকে ৫২ টাকায়। এত কিছুর পরেও প্রশ্ন হলো চালের বাজার সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসবে তো?

http://www.dailysangram.com/post/301113