২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭, সোমবার, ৬:৫২

মজুদদারিতে ব্যাংকের হাত

ধান-চাল কেনায় ঋণ সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা * মজুদে খেলাপি ১২শ’ কোটি টাকা
চালের অবৈধ মজুদ কারসাজিতে জড়িয়ে পড়েছে দেশের ব্যাংক খাত। স্থানীয় ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপকদের সহায়তায় রাইস মিলাররা মজুদ কারসাজির কর্মটি চালিয়ে যাচ্ছেন। দীর্ঘদিন ধরে এটি চললেও এবার নানা কারণে বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। ব্যবস্থাপকদের ম্যানেজ ফর্মুলা নিয়ে মিলাররা ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য এ মজুদ গড়ে তুলছেন। মৌসুম এলেই মিলাররা ঋণের টাকায় কম দামে কৃষকের কাছ থেকে ধান-চাল কিনে যত্রতত্র গড়ে তুলছেন মজুদ। মৌসুম শেষ হওয়ার পরও নানা কৌশলে মজুদ ধরে রেখে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বড় অংকের মুনাফা তুলে নিচ্ছে। ব্যাংকের সুদসহ আসল পরিশোধের পরও ব্যাংক কর্মকর্তাদের খুশি রাখতে দেয়া হচ্ছে নজরানাও।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, ব্যাংকের টাকায় এবং স্বল্পকালীন ব্যবসা করেই আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন শত শত মিলার। বর্তমানে ১৭ হাজার চাতাল ও হাস্কিং মিল এবং উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সোয়া তিনশ’ অটো রাইস মিল সক্রিয় রয়েছে। এদের নিজস্ব পুঁজিও কম। মৌসুম এলেই এরা হাত পাতেন ব্যাংকের কাছে। মাঝারি মানের চাতাল মালিকরা প্রতি মৌসুমে গড়ে ৫০ লাখ থেকে কোটি টাকা এবং বড়রা ৫ কোটি থেকে আড়াইশ’ কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যাংক ঋণ নিচ্ছেন। শাখা পর্যায়ে ব্যাংক ঋণের হিসাবে ভিন্নতা থাকায় এবং তা কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়মিত মনিটরিংয়ে না রাখায় ধান-চাল কেনায় কি পরিমাণ ঋণ ছাড় করা হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই বাণিজ্যিক ব্যাংক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে। তবে চাতাল মালিকরা বলছেন, ব্যাংক দুই হাত খুলে ঋণ দিচ্ছে। বছরে ধান-চাল সংগ্রহের তিনটি মৌসুমে গড়ে একজন মিলার কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে থাকেন। ফলে এ খাতে বছরে ব্যাংক ঋণ সরবরাহের হার ৯ হাজার কোটি টাকার কম হবে না।

কথা হয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, অস্বাভাবিক এই ব্যাংক ঋণ বন্ধ না করা পর্যন্ত কোনো অবস্থাতেই ধান ও চালের মজুদ ঠেকানো যাবে না। এ কারণেই এখন সারা দেশের বিভিন্ন রাইস মিলে অভিযান চলছে এবং অতিরিক্ত মজুদ বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে। এছাড়া ব্যাংক সিসি ঋণের মেয়াদ যাতে যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনে তার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকেও চিঠি দেয়া হয়েছে।

এ খাতে ব্যাংক ঋণে অনিয়মের বিষয়টি প্রথম ধরা পড়ে ২০১০ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে। পরবর্তীকালে ২০১৩ ও ২০১৫ সালেও শাখা পর্যায়ে তদন্ত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একই অনিয়ম দেখতে পেয়েছে। তখন বেশকিছু ব্যাংক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া হয়। ওইসব প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের ৮০ শতাংশই বিতরণ করা হয় চাতাল মালিকদের। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তৈরি করা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে- চাতাল খাতে বিতরণ করা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ১২শ’ কোটি টাকা খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। এ বছর এ সংখ্যা আরও বেশি হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা যুগান্তরকে বলেছেন, ধান-চাল স্পর্শকাতর একটি পণ্য। এটা অবৈধভাবে মজুদ রাখলে বাজারে সংকট তৈরি হতে বাধ্য। তাই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ঋণ দেয়ার সময় গভীর বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে। ব্যাংকের টাকায় সীমাহীনভাবে কেউ যাতে ধান-চাল মজুদ করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যেসব ব্যাংক বিধিভঙ্গ করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। অন্যদিকে যারা আইনভঙ্গ করবেন সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। এতে কৃত্রিম মজুদের প্রবণতা কমে আসবে। তিনি আরও বলেন, এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোর কাছে তথ্য চাওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন টিম ব্যাংকগুলোর শাখা পর্যায়েও তদন্ত করবে। এর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা কার্যকর করতে ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগ, বৈদেশিক মুদ্রা পরিদর্শন ও ভিজিল্যান্স বিভাগের মাধ্যমে অনসাইট-অফসাইট তদারকি আরও জোরদার করা হবে।

এছাড়া দেশে মজুদবিরোধী আইন নিয়েও কারসাজি রয়েছে। কে কী পরিমাণ মজুদ কত দিন রাখতে পারবেন, তা স্পষ্ট নয় অনেকের কাছেই। তবে মিলাররা দাবি করছেন, তাদের মিলের উৎপাদনক্ষমতা অনুযায়ী ধানের চাহিদার ৫ ভাগ এবং চালের চাহিদার ২ ভাগ মজুদ রাখতে পারবেন। কিন্তু সেটি কতদিন, তা নির্দিষ্ট করা হয়নি। অন্যদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এসআরও নং ১১৩- আইন/২০১১ অনুযায়ী, খাদ্য লাইসেন্স ছাড়া কোনো পাইকারি ব্যবসায়ী ৩০০ টনের বেশি চাল সর্বোচ্চ ১ মাসের বেশি মজুদ রাখতে পারবেন না। কিন্তু সেটা কোথাও মানা হচ্ছে না। যার কারণে সরকারকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হচ্ছে।

ধান-চাল মজুদে ব্যাংকের সহযোগিতা নিয়ে কথা হয় নওগাঁ জেলা ধান-চাল আড়তদার সমিতির সভাপতি নিরোধ চন্দ্র সাহার সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, মিল সচল রাখতে সবাই মজুদ করছে। তবে কেউ কেউ সক্ষমতার বেশি মজুদ করছে না, এটা আমরা বলতে পারব না। তিনি বলেন, সরকারকে ব্যাংক ঋণের একটা লিমিট দিতে হবে। একইসঙ্গে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে চেকের মাধ্যমে সমন্বয় না করে নগদ টাকা পরিশোধের পদ্ধতি চালু করতে হবে। কেননা এখানেও কারসাজি রয়েছে। পাশাপাশি ওই টাকা অন্তত এক সপ্তাহ ব্যাংকে বাধ্যতামূলকভাবে জমা থাকতে হবে- এমন নির্দেশনা দিলে মজুদপ্রবণতা কমে আসবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রাইস মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি জাকির হোসেন রনি যুগান্তরকে বলেন, সিসি ঋণ দিয়ে এখানকার ব্যাংকগুলো মজুদকে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করছে। কারণ মজুদদাররা ব্যাংক থেকে যে ঋণ নেন, সেটা বেশিরভাগ সময়ই নিয়ম মেনে পরিশোধ করেন না। শুধু বছরে একটা চেক দিয়ে সমন্বয় করে নেন। অন্যদিকে ব্যাংকগুলোও লভ্যাংশে বেশি আগ্রহী।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কেএম লায়েক আলী বলেন, বড় পরিসরে ব্যবসা করতে হলে ব্যাংক ঋণ নিয়েই করতে হয়। এর জন্য সুদ ও আয়কর দুটিই দেন ব্যবসায়ীরা। আর ঋণের টাকা যে ধান-চাল কেনেন, তা সরকারই অনুমোদন করেন। কারণ মিলাররা মজুদ না করলে বিপুল উৎপাদনক্ষমতাসম্পন্ন এত মিল চলবে কী করে। তবে সক্ষমতার অতিরিক্ত মজুদের পক্ষে নই। এখন বাজারে যে ক্রাইসিস, সেটা ধানের কারণেই হয়েছে। ধান সরবরাহ বাড়লে এবং দাম কমলে চালের সরবরাহ এবং দাম দুটিই কমবে।

সূত্র জানায়, সম্প্রতি সিসি ঋণ নিয়ে বিভিন্ন মিলারের বিপুল পরিমাণ চাল মজুদ করার তথ্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে রয়েছে। সিসি ঋণ নেয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের আগে টাকা পরিশোধ করতে হয় না। ফলে ব্যাংক থেকে সিসি ঋণ নিয়ে উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিপুল পরিমাণ মজুদ গড়ে তোলা হচ্ছে।

এ পরিস্থিতিতে এ ঋণে কেনা চাল যাতে বেশিদিন মজুদ রাখতে না পারে, সে লক্ষ্যে আবারও চাতাল খাতে ঋণের সীমা পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সম্প্রতি জারি করা এক সার্কুলারে নতুন সময়সীমা আগের ৪৫ দিন থেকে কমিয়ে এখন ৩০ দিন করা হয়েছে। নতুনভাবে নির্ধারণ করা এ সীমা চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, ধান-চাল সংগ্রহ মৌসুমে এ খাতে ব্যবসায়ীদের ঋণ দেয়া এখন একটা রীতিতে পরিণত হয়েছে। ঋণ নিয়েই তারা ব্যবসা করবে। যে টাকায় ঋণ নেবে সে টাকায় মজুদও করতে পারবে। কিন্তু সেটি অবশ্যই ঋণের শর্ত সীমা মেনে। এর বাইরে অতিরিক্ত সময় মজুদ ধরে রাখলে সেটি অনৈতিক এবং কারসাজির মধ্যেই পড়ে, যা দণ্ডনীয়।

বাংলাদেশ রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি এবং চাল আমদানিকারক কাওসার আলম খান যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংকগুলোর ব্যাপক ঋণ প্রদানই ধান-চালের বাজারে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। শুধু তা-ই নয়, এখন বাংলাদেশ ব্যাংক ৩০ দিনের মধ্যে ঋণ পরিশোধের যে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, তাতে আরেকটা অনিয়ম করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। ৩০ দিনের এ বাধ্যবাধকতার কারণে এখন অনেকেই নামে-বেনামে ঋণ নিচ্ছে। অন্য খাতে নেয়া ঋণের টাকা খাটানো হচ্ছে ধান-চালের মজুদ গড়তে।

ব্যাংকগুলো কৃষিপণ্যের ক্রয় ও মজুদের ক্ষেত্রে দু’ধরনের ঋণ দিচ্ছে। এর একটি হচ্ছে সিসি লোন। অন্যটি হচ্ছে প্লেজ লোন। এ দুুই স্কিমের পার্থক্য হচ্ছে- ব্যাংকের টাকায় ধান-চাল কেনার পর প্লেজ লোনধারীদের ব্যাংকের নজরধারীতে থাকতে হয়। কী পরিমাণ কেনা হল, কত দামে কেনা, তা ব্যাংককে অবহিত করতে হয়। একইভাবে মজুদ থেকে যখন বাজারে ছাড়া হয় তার পরিমাণ এবং বাজারমূল্যও ব্যাংকের তদারিকে থাকে। এ প্রক্রিয়ায় ব্যাংকের বিনিয়োগ থাকায় মিলার এখানে একটা সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ফলে ব্যাংক এবং মিলার দু’পক্ষই মুনাফা ভাগাভাগি করে। অন্যদিকে সিসি লোন হচ্ছে অনেকটা বন্ধকী ঋণের মতো। এ স্কিমের আওতায় অনেক বড় ধরনের লোনও মিলাররা নিতে পারেন। এক্ষেত্রে কার মিলে কত ক্যাপাসিটি এবং ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা আছে কিনা, তা বিবেচনা করা হয়।

https://www.jugantor.com/first-page/2017/09/25/158252