২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭, সোমবার, ৬:৫০

ব্যাংকে গোপন সুদের ভয়াবহ ফাঁদ

ঋণগ্রহীতাদের হিসাব থেকে নিয়মবহির্ভূতভাবে গোপনে কেটে নেয়া হচ্ছে বিপুল অঙ্কের অর্থ * এক প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষায় ৭ ব্যাংকের এরকম জালিয়াতি ধরা পড়েছে * এখন পর্যন্ত আদায় ২৫ কোটি টাকা * এটা বড় প্রতারণা, বাংলাদেশ ব্যাংককে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে -খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

ঋণগ্রহীতাদের হিসাব থেকে নিয়মবহির্ভূতভাবে অতিরিক্ত সুদহার বসিয়ে বিপুল অঙ্কের অর্থ গোপনে কেটে নেয়া হচ্ছে, যা কোনো গ্রাহক জানেন না। কল্পনারও বাইরে। অথচ ব্যাংকগুলো গোপনে সুদের এমন ভয়াবহ ফাঁদ বসিয়েছে। দেখা যায়, যে হারে সুদ কাটার কথা, তার চেয়ে বেশি হারে তারা কেটে নিচ্ছে। যুগান্তরের অনুসন্ধানে সম্প্রতি এ রকম চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। একটি বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ কৌতূহলবশত কর্তনকৃত সুদহার যাচাই করতে গিয়ে অতিরিক্ত কোটি কোটি টাকা কেটে নেয়ার তথ্য-প্রমাণ পায়। এখন পর্যন্ত কয়েকটি ব্যাংকের হিসাব যাচাই-বাছাই করে প্রতিষ্ঠানটি অন্তত ২৫ কোটি টাকা আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। এরকম আরও তথ্য বেরিয়ে আসছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এভাবে অসংখ্য গ্রাহকের হিসাব থেকে শত শত কোটি টাকা গোপনে অতিরিক্ত কেটে নিয়েছে সংশ্লিষ্ট বেশিরভাগ ব্যাংক। এ ছাড়া নানা রকম সার্ভিস চার্জ নেয়ার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধিবিধান মানা হচ্ছে না। নির্ধারিত সার্ভিস চার্জের বাইরে গোপনে অতিরিক্ত টাকা কেটে নেয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন তথ্য খুবই উদ্বেগের। বিষয়টি দ্রুত বাংলাদেশ ব্যাংকের গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত। অবশ্যই উচ্চপর্যায়ের তদন্ত হতে হবে এবং যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, গোপনে সুদারোপ করা বড় প্রতারণা। গ্রাহকের সঙ্গে ব্যাংক এ ধরনের আচরণ করতে পারে না। যদি কেউ এমন লক্ষণ বুঝতে পারেন, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ করা উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষকেও তদন্ত করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংকগুলোর সুদহার বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারণ করে না। বাংলাদেশ ব্যাংক শুধু ঋণ ও আমানতের সুদহারের ব্যবধান (স্প্রেড) সীমা নির্ধারণ করে থাকে। তবে ব্যাংক গ্রাহকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ সুদহারের বাইরে টাকা কেটে থাকলে তা গর্হিত অপরাধ। এটা অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংক দেখবে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, একটি বেসরকারি ব্যাংকে ২০১৬ সালে একজন প্রাইম কাস্টমারের ঋণ হিসাবে প্রযোজ্য সুদহার অপেক্ষা অতিরিক্ত প্রায় ৬ কোটি টাকা কেটে নেয়া হয়। যা কৌতূহলবশত প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষায় ধরা পড়ে। এ সময় প্রথমে তারা ভেবেছিলেন কোথাও মনে হয় তাদের হিসাবে ভুল হয়েছে। কিন্তু আবারও যাচাই করে তারা বিষয়টি নিশ্চিত হন। এরপর সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের নজরে আনা হলে প্রথমে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ একেবারে অস্বীকার করে। সাফ জানিয়ে দেয়, তাদের সুদারোপ যথাযথভাবে করা হয়েছে। এ ধরনের কোনো ভুল হতেই পারে না। পরবর্তী সময়ে তথ্য-প্রমাণ হাজির করা হলে কম্পিউটার বিভ্রাট বলে চালিয়ে দেয়া হয়। একপর্যায়ে অতিরিক্ত কেটে নেয়া অর্থ ব্যাংকটি ফেরত দিতে বাধ্য হয়।

এই সন্দেহ থেকে বড় ব্যবসায়ী গ্রুপটি তাদের অন্যান্য ব্যাংকের ঋণ হিসাব যাচাই-বাছাই শুরু করে। কী ভয়াবহ চিত্র! একে একে আরও ৬টি ব্যাংকের ঋণ হিসাবেও একই অবস্থা। প্রযোজ্য বা সময়ে সময়ে নির্ধারিত সুদহারের চেয়ে বেশি হারে সুদ কেটে নেয়া হয়েছে। যার পরিমাণ আরও প্রায় ১৯ কোটি টাকা। যেমন- একটি বেসরকারি ব্যাংক দুটি ঋণ হিসাব থেকে প্রায় ৮ কোটি টাকা অতিরিক্ত সুদ কেটে নিয়েছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের দাবির মুখে জানাজানি হওয়ার পর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ভুল স্বীকারের মাধ্যমে সে অর্থ তড়িঘড়ি করে ফেরত দিয়েছে। এরপর অপর একটি বড় ব্যাংক একই কায়দায় প্রায় ৭ কোটি টাকা বের করে নেয়। পরবর্তী সময়ে তারাও টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হয়। এ ছাড়া আরও ৪টি বেসরকারি ব্যাংক ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রযোজ্য সুদহারের চেয়ে দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৫০ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত সুদ আরোপের মাধ্যমে প্রায় ৪ কোটি টাকা সুদ কেটে নিয়েছে। যা পরবর্তী সময়ে গ্রাহকের দাবির ভিত্তিতে নগদ ফেরত এবং ঋণ হিসাবে সমন্বয় করা হয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে একজন শিল্পোদ্যোক্তা জানিয়েছেন, ব্যাংকের এমন গোপন চেহারা ভাবা যায় না। সত্যিই এটি বড় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার তথ্য। যিনি এরকম তথ্য বের করেছেন তাকে সব ঋণগ্রহীতার পক্ষ থেকে অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে হবে। কারণ এভাবে হয়তো প্রতিটি ঋণ হিসাব থেকে গোপনে টাকা সাবাড় করা হচ্ছে। তিনি বলেন, কেউ তো এমন যাচাই-বাছাইয়ের কথা ভাবেন না। ব্যাংককে বিশ্বাস করেন। কিন্তু এখন তো দেখছি আমার ঋণ হিসাবও যাচাই করে দেখতে হবে। হয়তো এ খবর জানার পর সবাই সচেতন হবেন এবং হওয়া উচিত। আর শুধু টাকা ফেরতই সমাধান নয়। যারা এর সঙ্গে জড়িত অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এটি ফৌজদারি অপরাধের মধ্যে পড়ে। দুর্নীতি দমন কমিশনও এগিয়ে আসতে পারে। তার আশঙ্কা, না জানি সার্ভিস চার্জের নামেও কী করা হচ্ছে। সেখানেও হয়তো এমন কারবার অব্যাহত আছে।

এদিকে বর্তমানে অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ নেয়ার অভিযোগ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সবচেয়ে বেশি আসছে। ব্যাংকগুলোর সিডিউল অব চার্জেস পর্যালোচনায় দেখা যায়, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (এসএমই) শিল্প খাতে ঋণের আবেদন গ্রহণ থেকে শুরু করে ঋণ মঞ্জুরি পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে গ্রাহকের কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্ন নামে ও হারে চার্জ বা ফি বা কমিশন আদায় করছে ব্যাংকগুলো। ফলে ঋণের প্রকৃত ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এ পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এক সার্কুলার জারি করা হয়। এতে ঋণ আবেদন ফি’সহ বিভিন্ন খাতে চার্জের সীমা বেঁধে দেয়া হয়। বলা হয়েছে, কটেজ, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে ঋণ আবেদন ফি হিসাবে কোনোক্রমেই ২০০ টাকার বেশি আদায় করা যাবে না। ডকুমেন্ট ফি, সিআইবি চার্জ, স্ট্যাম্প চার্জ এবং আইনি ও জামানত মূল্যায়ন ফি প্রকৃত ব্যয়ের ভিত্তিতে নির্ধারিত করতে হবে। কটেজ ও মাইক্রো খাতে প্রদত্ত ঋণ মেয়াদপূর্তির আগে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে আরলি সেটেলমেন্ট ফি আদায় করা যাবে না। এর অতিরিক্ত কোনো চার্জ বা ফি বা কমিশন এসব খাতে প্রদত্ত ঋণ হিসাব থেকে আদায় করা যাবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, বেসরকারি ব্যাংকে প্রতিবছর একটি হিসাবের বিপরীতে সার্ভিস চার্জ বাবদ ব্যয় হচ্ছে প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। এর মধ্যে হিসাব পরিচালন ফি ৫০০ টাকা ও এটিএম কার্ড ফি ৫০০ টাকা। বিভিন্ন সময় এসএমএস পাঠানো ও ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের জন্যও বছরে ৫৭৫ টাকা কেটে রাখছে। কোনো গ্রাহক এসএমএস পেতে আগ্রহী না হলেও এ চার্জ নেয়া হচ্ছে। ইন্টারনেট ব্যাংকিং সুবিধা না দিলেও গ্রাহকের কাছ থেকে গণহারে এ ফি নেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে কিছু ক্ষেত্রে তফসিলি ব্যাংকের বিভিন্ন সেবার সর্বোচ্চ চার্জ আদায়ের সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংক এ সীমার বাইরে গিয়ে তাদের গ্রাহকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে আছে দেশে পরিচালিত বিদেশি ব্যাংকগুলো। তারা বিভিন্ন সেবার বিনিময়ে গলাকাটা অর্থ গ্রাহকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে। আর বাস্তবতা হল, এভাবে গোপনে টাকা নেয়ার কথা কোনো গ্রাহক জানেন না।
প্রসঙ্গত, ব্যাংকিং খাতে প্রধানত তিন ধরনের ঋণ চালু রয়েছে। স্বল্প মেয়াদি ঋণ, দীর্ঘ মেয়াদি ঋণ ও বৈদেশিক ঋণ। স্বল্প মেয়াদি ঋণের মধ্যে রয়েছে ভোক্তা ঋণ, সিসি (হাইপো), ওডি, ক্রেডিট কার্ড ঋণ, কৃষি এবং এসএমই ঋণ। দীর্ঘ মেয়াদি ঋণ হল- প্রকল্প ঋণ, পরিবহন ঋণ ও হাউস বিল্ডিং লোন। এ ছাড়া বৈদেশিক ঋণের মধ্যে রয়েছে এলসি, লিম, এলটিআর, পিএডি, এফবিপি ইত্যাদি। সূত্র বলছে, গোপনে কম-বেশি সুদহার কেটে নেয়ার ঘটনা প্রতিটি ক্ষেত্রেই হচ্ছে। তবে বড় ঋণের ক্ষেত্রে এ ধরনের সুদ কর্তন বেশি ঘটছে।

 

https://www.jugantor.com/first-page/2017/09/25/158253