২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭, সোমবার, ৬:৪৮

আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর তোড়জোড়

গণশুনানি শুরু আজ * পাইকারিতে ১৫ শতাংশ, গ্রাহক পর্যায়ে ৬ থেকে ১৪ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব * বিশেষজ্ঞরা বলছেন প্রস্তাব কার্যকর হলে শিল্প-কারখানা ধ্বংস হবে * ডিসিসিআইর উদ্বেগ অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে
আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর তোড়জোড় শুরু হয়েছে। এ নিয়ে আজ থেকে শুরু হচ্ছে গণশুনানি। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) এরই মধ্যে কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব যাচাই-বাছাই শেষ করেছে। প্রতি ইউনিট (কিলোওয়াট-ঘণ্টা) বিদ্যুতের দাম পাইকারিতে (বাল্ক) প্রায় ১৫ শতাংশ এবং গ্রাহক পর্যায়ে ৬ থেকে সাড়ে ১৪ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে কোম্পানিগুলো। গণশুনানির পর ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে বিইআরসি সিদ্ধান্ত দেবে।

বিদ্যুৎ খাতের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সরকারের মধ্যে থাকা একটি মহল সরকারকে বিব্রত করার জন্য একের পর এক বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর চক্রান্ত করছে। এবার যে হারে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে, তা কার্যকর করা হলে শিল্পকারখানা ধ্বংস হয়ে যাবে। ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে অনেক কারখানা মালিককে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হবে। এতে লাখ লাখ চাকরিজীবী বেকার হয়ে যাবে। তারা বলেন, বেসরকারি অনেক বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি কম রেটে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব দিলেও সরকার সে প্রস্তাবে সাড়া দিচ্ছে না। উল্টো সরকার বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনছে, যার খেসারত দিতে হচ্ছে গ্রাহকদের। বারবার সরকারকে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হচ্ছে।

বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাবে উদ্বেগ জানিয়ে তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)। রোববার দেয়া এক বিবৃতিতে সংগঠনটি জানায়, বিদ্যুতের মূল্য আবারও বাড়ানো হলে উৎপাদনমুখী শিল্প, বিশেষ করে পোশাক কারখানা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, স্টিল রিরোলিং ও টেক্সটাইল খাতে ৮ থেকে ১০ শতাংশ উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যেতে পারে। এতে প্রতিযোগিতা মূল্যে শিল্প উৎপাদন সক্ষমতা হ্রাস পাবে। ব্যাহত হবে বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন, রফতানি সক্ষমতা, শিল্প বহুমুখীকরণ। পাশাপাশি ব্যবসা পরিচালনায় ব্যয় বাড়বে।

এদিকে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ৫ শতাংশ বাড়তে পারে। অর্থের হিসাবে তা ৩০ থেকে ৩৫ পয়সা। তবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (বিপিডিপি) সরাসরি জ্বালানি তেল আমদানির অনুমতি দিলে দাম না-ও বাড়তে পারে। সম্প্রতি সচিবালয়ে নিজ দফতরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ কথা বলেন তিনি।
নসরুল হামিদ বলেন, বিশ্ববাজারে দাম কম হলেও পিডিবি সরকার নির্ধারিত দামে বিপিসির কাছ থেকে জ্বালানি তেল কিনে। এতে খরচ বেশি হয়। বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়। আয়-ব্যয় সমন্বয় করতে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হয়। কিন্তু পিডিবি সরাসরি তেল আমদানির সুযোগ পেলে জ্বালানি ব্যয় কম হবে। এতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন পড়বে না। কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, দাম বাড়ানোর বর্তমান প্রক্রিয়া অযৌক্তিক। এ নিয়ে আমার বক্তব্য আজ গণশুনানিতে উপস্থাপন করব। তিনি আরও বলেন, সরকার কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পথ অনুসরণ করছে না, বরং বেশি দামের তেলভিত্তিক বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। সব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ফার্নেস তেলের দাম বাজারদর অনুযায়ী করে দিলেও উৎপাদন ব্যয় অনেকখানি কমত, তা-ও করা হচ্ছে না। পদ্ধতিগত লোকসান (সিস্টেম লস) কমিয়ে মুনাফা বাড়ানোর কার্যক্রমও যথেষ্ট সফল নয়। এগুলো করা হলে দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না, বরং কমানো যাবে।

ডিসিসিআইর মতে, এ মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের পরিচালন ও ব্যবস্থাপনা দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা উচিত। সংগঠনটি সরকারি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোসহ সব সরকারি-বেসরকারি স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে নিয়ে একটি ‘জ্বালানি মনিটরিং কমিটি’ গঠনের পরামর্শও দিয়েছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বিদ্যুৎ আধুনিক জীবন ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ। অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ শিল্প, কৃষি ও সেবা খাতের ক্রমবর্ধমান অগ্রগতির মূল চাবিকাঠি। ভোক্তাপর্যায়ে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রস্তাবিত মূল্যবৃদ্ধির উদ্যোগ কার্যকর হলে খুচরা পর্যায়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে ৯ টাকা ১৬ পয়সা থেকে ১০ টাকা, বাণিজ্যিক ব্যবহারকারীদের ক্ষেত্রে ১১ টাকা ৯৮ পয়সা থেকে ১২ টাকা ৯৮ পয়সা, বৃহৎ শিল্পকারখানার ক্ষেত্রে ৯ টাকা ৫২ পয়সা থেকে ১০ টাকা ৩২ পয়সা এবং গৃহস্থালিতে ব্যবহারের ক্ষেত্রে ৫ টাকা ৬৩ পয়সা থেকে বেড়ে ৬ টাকা ১০ পয়সা দাঁড়াবে।

বিইআরসি সূত্র জানায়, এবার বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে পাইকারি বিক্রির ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৭২ পয়সা (প্রায় ১৫ শতাংশ) বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। আর বিভিন্ন বিতরণ কোম্পানি গ্রাহক পর্যায়ে ৬ থেকে সাড়ে ১৪ শতাংশ প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। বিতরণ কোম্পানিগুলোর দাবি, প্রতিবারই পাইকারির তুলনায় খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয়েছে কম। ফলে তাদের পক্ষে কোম্পানি চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
বিইআরসিতে উপস্থাপন করা বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বর্তমানে দেশের ছয়টি বিতরণ কোম্পানির মধ্যে একমাত্র পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) লোকসান দিচ্ছে। চারটি কোম্পানি লাভজনক। এগুলো হচ্ছে- বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) বিতরণ অঞ্চল, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি), ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ডেসকো) এবং পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ওজোপাডিকো)। নতুন গঠিত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (নওজোপাডিকো) এবারই প্রথম বিইআরসির কাছে আসছে।

২০১০ সালের ১ মার্চ থেকে ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয় বছরে পাইকারি পর্যায়ে পাঁচবার এবং গ্রাহক পর্যায়ে সাতবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। ২০১৫ সালে সর্বশেষ গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয় ২ দশমিক ৯ শতাংশ। ওই বছর পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়নি। তবে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাইকারি পর্যায়ে ৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়েছিল।

https://www.jugantor.com/first-page/2017/09/25/158256