২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭, সোমবার, ৬:৪৬

সুদহার তলানিতে : তবুও বিনিয়োগ হচ্ছে না

পরিচালন ব্যয় মেটাতে ঝুঁকি পূর্ণখাতে বিনিয়োগ করছে অনেক ব্যাংক

ব্যাংকিং খাতে গড় ঋণের সুদহার কমে নেমেছে সাড়ে ৯ শতাংশ। এটা দেশের যেকোনো সময়ের চেয়ে কম বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা। কিন্তু এর পরেও কাক্সিক্ষত হারে বিনিয়োগ হচ্ছে না। বরং গুণগত বিনিয়োগ পেতে যেন দিশেহারা ব্যাংকিং খাত। এমনই পরিস্থিতিতে কোনো কোনো ব্যাংক পরিচালন ব্যয় মেটাতে ঝুঁকিপূর্ণ খাতেও বিনিয়োগ করছে। ঋণের অর্থ ২০১০ সালের মতো পুঁজিবাজারসহ ঝুঁকিপূর্ণ খাতে যাচ্ছে কি না তা নিয়ে স্বয়ং সংশয় প্রকাশ করেছেন ব্যাংকাররা।

গড় সুদহার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত বছরের জানুয়ারিতে ঋণের গড় সুদহার ছিল ১১ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ, চলতি বছরের জানুয়ারিতে তা নেমে এসেছে ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে ১০ দশমিক ৯১ শতাংশ থেকে ৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ, মার্চে ১০ দশমিক ৭৮ শতাংশ থেকে ৯ দশমিক ৭০ শতাংশ, এপ্রিলে ১০ দশমিক ৬৪ শতাংশ থেকে ৯ দশমিক ৬২ শতাংশে, মেতে ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ থেকে ৯ দশমিক ৬৬ শতাংশে, জুনে ১০ দশমিক ৩৯ শতাংশ থেকে ৯ দশমিক ৫৬ শতাংশে, জুলাইয়ে ১০ দশমিক ৩৯ শতাংশ থেকে ৯ দশমিক ৫১ শতাংশে এবং আগস্টে ১০ দশমিক ৩২ শতাংশ থেকে কমে ৯ দশমিক ৪৩ শতাংশে নেমেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংক ঋণের এ গড় সুদহার দেশের যেকোনো সময়ের চেয়ে কম। কিন্তু এর পরও ব্যাংকগুলো থেকে বলা হচ্ছে তাদের গুণগত বিনিয়োগ নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, জুলাইতে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ হার ছিল ১৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ। বেসরকারি খাতের এ বিনিয়োগ হার নিয়ে সংশয় রয়েছে তাদের। কারণ দৃশ্যমান কোনো বিনিয়োগ নেই। সাধারণত বিনিয়োগ হার নিয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় কোনো বিনিয়োগ না হলেও আপনা আপনিই ১১ থেকে ১২ শতাংশ বিনিয়োগ হয় সুদহারের কারণে। কারণ বিদ্যমান যে পরিমাণ বিনিয়োগ রয়েছে, তার গড় সুদহার ১২ শতাংশ হলে পুরনো ঋণের সাথে বছর শেষে সুদ যুক্ত হওয়ায় আপনা আপনিই বিনিয়োগ ১০ শতাংশ বেড়ে যায়। সেই হিসাবে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ হার সন্তোষজনক নয়।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, নতুন ঋণ তুলনামূলক কম রয়েছে। গুণগত বিনিয়োগ নেই। ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ বিনিয়োগ দেখাচ্ছে, তার একটি উল্লেখযোগ্য হলো কাগুজে ঋণ। যেমন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে খেলাপি ঋণ কমাতে একই গ্রাহককে নতুন করে ঋণ দিয়ে পুরনো ঋণ পরিশোধ করা হচ্ছে। এতে ব্যাংকের যেমন ঋণ পরিশোধ হার বাড়ছে, তেমনি নতুন ঋণও বাড়ছে। দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গতকাল নয়া দিগন্তকে জানান, বর্তমান বাস্তবতায় ব্যাংকগুলো এ পথে না গেলে তাদের বছর শেষে পরিচালন ব্যয় ওঠানোই মুশকিল হবে। এ ছাড়া ব্যাংকের এমডিরা উচ্চ বেতন পেয়ে থাকেন। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এমডিদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে বেশি মুনাফা দেখানো। বেশি মুনাফা দেখালে বছর শেষে লভ্যাংশ নিতে পারবেন তারা। এ বাস্তবতায় এমডিদের কিছু করার থাকে না। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে শক্ত ভূমিকা না রাখলে ব্যাংকগুলোর বর্তমান অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না বলে ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, ২০১০ সালেও তারা বিনিয়োগখরায় ভুগছিলেন। ওই সময় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বল তদারকির কারণে ব্যাংক ঋণের একটি বড় অংশ পুঁজিবাজারে চলে গিয়েছিল। এটিই পরে পুঁজিবাজার ও ব্যাংকের জন্য কাল হয়ে গিয়েছিল। পুঁজিবাজারের সূচক আকাশমুখী ছিল। একপর্যায়ে ব্যাংকগুলোকে রক্ষা করতে তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। ফলে পুঁজিবাজারের বড় দরপতন হয়, যার ক্ষত আজো শুকায়নি। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মতো কোনো কোনো ব্যাংক আজো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। যে মূল্যে শেয়ার কিনেছিল তা আজো তুলতে পারেনি। অনেক ব্যাংকের মূলধন অর্ধেকে নেমে গিয়েছিল। এবার দৃশ্যমান কোনো বিনিয়োগ না হলেও বেসরকারি খাতে কেন বিনিয়োগ বাড়ছে, যেসব ঋণ বিতরণ হচ্ছে তার কোনো অংশ পুঁজিবাজারে চলে যাচ্ছে কি না তা দ্রুত তদারকি করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংককেই অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/254636