২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭, সোমবার, ৬:৪৩

অনাহারে কঙ্কালসার রোহিঙ্গা নারী ও শিশু

আসার অপেক্ষায় আরো ৫০ হাজার শরণার্থী

না খেয়ে, অর্ধপেট খেয়ে শিশুদের নিয়ে দীর্ঘ পথ হেঁটে বাংলাদেশে প্রবেশ করায় রোহিঙ্গা নারী ও শিশুরা কঙ্কালসার হয়ে গেছেন। এদের অনেকে দুই সপ্তাহে প্রায় ৫০ মাইল পর্যন্ত পথ হেঁটে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন। এ দিকে আরো প্রায় ৫০ হাজার শরণার্থী নাফ নদী পার হয়ে আজ-কালের মধ্যে বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছেন বলে জানা গেছে।
গতকাল রোববার ও আগের দিন শনিবার হাজার খানেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। এদের কয়েকজনের সাথে কথা জানা গেছে, তারা প্রায় সবাই গত দুই সপ্তাহ ধরে পাহাড়ে লুকিয়ে ছিলেন মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও রাখাইন সন্ত্রাসীদের ভয়ে। তারা হাতের কাছে যা ছিল তা নিয়ে বের হয়ে আসায় সাথে তেমন কিছুই সাথে আনতে পারেননি, খাবারতো নয়ই। অনেকেই কিছু চাল ও শুকনো খাবার আনতে পেরেছিলেন। এগুলো দুই-তিন দিনের মধ্যেই শেষ হয়ে গেছে। এরপর গাছের নরম মূল, শেকড়, চিবানো যায় এমন নরম পাতা খেয়ে দিন কাটিয়েছেন। ফলে পুষ্টির ঘাটতি দেখা দেয় শিশু ও নারীদের মধ্যে বেশি।
বুচিডংয়ের পন্ডপ্রয় গ্রামের হামিদা (২২) ছোট তিনটি শিশুসন্তান নিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন বাংলাদেশে। তার স্বামী নুর আলমসহ ১০ জনকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী (তাদের ভাষায় মেলিটারি) ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। এটা দেখে হামিদা আর দেরি না করে শিশুদের নিয়ে বের হয়ে পড়েন। একই সাথে হামিদার বোনের স্বামীকে পুড়িয়ে হত্যা করে সেনাসদস্যরা। এত দিন না খেয়ে থাকায় হামিদা নিজে যেমন শুকিয়ে গেছেন তেমনি তার শিশুসন্তানেরা কঙ্কালসার হয়ে গেছে। হামিদা এত শুকিয়ে গেছেন যে তিনি কথাই বলতে পারছিলেন না।

নিজের চেয়ে একটু কম বয়সের স্বামী যুবাইরকে নিয়ে ইয়াসমিন (২২) তার শিশুসন্তানদের নিয়ে চলে এসেছেন বাংলাদেশে। বুচিডংয়ে মাছ ধরে দিন নির্বাহ করেন যুবাইর। ইয়াসমিনের বুচিডং থেকে বের হওয়ার দুই দিন পর জঙ্গলে তার একটি সন্তানের জন্ম হয়। মিয়ানমারেই যক্ষ্মায় আক্রান্ত ইয়াসমিন জোরে কথা বলতে পারছিলেন না। তার স্বামী যুবাইর শরীরের চেয়ে বড় সাইজের একটি গেঞ্জি গায়ে দেয়ায় তার বুকের হাড়গুলো দেখা যাচ্ছিল। হাতগুলো দেখলে মনে হয় মিয়ানমারে প্রচণ্ড পরিশ্রমের কাজ করতেন। তারা গত শনিবার বাংলাদেশে ঢুকেছেন ছোট একটি দলের সাথে।
ইয়াসমিন ক্ষীণস্বরে জানান, তারা একটি নির্জন দ্বীপে আশ্রয় নিয়েছিলেন দুই সপ্তাহ আগে। প্রায় না খেয়েই কেটেছে দিনগুলো। অনেক কষ্ট করে বাংলাদেশে আসার পরও তেমন খাবার পাননি। তারপরও তাদের ভালো লাগছে। কারণ এখানে পেছনে তাড়া করার কেউ নেই, নেই গুলি খেয়ে মরার ভয়। ইয়াসমিন জানালেন, তারা যেখানে ছিলেন সেখানেই ফিরে যেতে চান। কারণ সেখানে তারা জন্মেছেন, বড় হয়েছেন। বাড়ি ছিল সেখানে, ছিল চেনা পরিবেশ। এখানে মৃত্যু ভয় না থাকলেও রাস্তায় রাত যাপন করতে হচ্ছে। উখিয়ায় আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে পারেন এমন একজনের মাধ্যমে ইয়াসমিনের সাথে কথা হচ্ছিল এ প্রতিবেদকদের সাথে। ইয়াসমিন যেমন শুদ্ধ বাংলা বুঝতে পারেন না তেমনি তার কথাও সবাই বুঝতে পারেন না। কেবল কক্সবাজার অঞ্চলের মানুষ ওদের কথা বুঝতে ও আলাপ করতে বলতে পারেন।

গতকাল রোববার উখিয়ার বালুখালী এলাকায় রাস্তায় অনেক সংগঠনকে দেখা গেল স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করতে। এখানে গণস্বাস্থ্য, ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব মাইগ্রেশনসহ (আইওএম) অনেক সংগঠন এই সেবা দিচ্ছে।

এ দিকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও রাখাইন সন্ত্রাসীদের অত্যাচারে টিকতে না পেরে আরো অন্তত ৫০ হাজার রোহিঙ্গা নারী পুরুষ ও শিশু আজকের মধ্যে বাংলাদেশে প্রবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
নাফ নদীর তীরে অপেক্ষমাণ এ পারের রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, ওপারে থাকা তাদের আত্মীয়স্বজন আজ অথবা কালকের মধ্যে বাংলাদেশে প্রবেশ করবেন বলে তারা জানিয়েছেন। উখিয়া ও টেকনাফে অবস্থান করা আত্মীয়স্বজনরা নাফ নদীর তীরে শনিবার রাত থেকে অপেক্ষা করছেন কখন তাদের স্বজনেরা নিরাপদে এ পারে এসে পৌঁছবেন।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/254619