২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭, সোমবার, ৬:৪০

চালের ডিও পদ্ধতির প্রবর্তন বাজার উসকে দেয়

চিনি ও ভোজ্যতেলের মতো নিত্যপণ্য বেচাকেনায় ডিও (সরবরাহ আদেশ) প্রথার পর এবার নতুন করে চালু হলো চালে। চালের ক্ষেত্রে কখনই পদ্ধতিটি ছিল না। সংকট পুঁজি করে চাল বেচাকেনায়ও এ বছর ডিও চালু করেন ব্যবসায়ীরা। এতে আকস্মিকভাবে চাহিদা অনেক বেড়ে যায়, যা বাজারকে আরো উসকে দিয়েছে। ডিও বদল হয়েছে আর চালের দাম বেড়েছে কিন্তু গ্রাহক চাল পায়নি। চালের ডিও পদ্ধতি চালু হয়েছে অথচ জানে না সরকার। মনিটরিং না থাকায় কোথাও বেশি আবার কোথাও কম দামে চাল বিক্রি হচ্ছে। চালের বাজার হ-য-ব-র-ল অবস্থা।

বড় আমদানি কারকরা কোন পণ্য আনার পূর্বে তা ডিও আকারে লট বিক্রি করে থাকেন। এতে করে আমদানিকারক পণ্য বিক্রির পূর্বেই টাকা পেয়ে থাকেন। আমদানির পরে পণ্য মূল্যের ওপর দাম নিয়ন্ত্রণে তার কোন ক্ষমতাই থাকে না। কারণ পণ্য মূল্যের সব টাকাই মাল আসার পূর্বেই আদায় হয়েছে। ফড়িয়ারা নিজেদের ইচ্ছামত পণ্যের মূল্য বাড়াতে পারে। তাই অতিমুনাফার আশায় চিনি, ভোজ্যতেল ছেড়ে অনেকে চালের ডিও সংগ্রহ করেন।

প্রতি রমযানেই চিনি তেল নিয়ে এমন তেলেসমাতি কাজ হলেও ডিও প্রথা বাতিল হচ্ছে না। সরকার এ পদ্ধতি বাতিল নিয়ে কথাও বলছে না। তাহলে কিভাবে ব্যবসায়ী (আমদানিকারক) এবং সরকার পণ্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ করবে।
কি কারণে ব্যবসায়ীরা নতুন করে চালের মত একটি নিত্যপণ্যে ডিও পদ্ধতি চালু করলো এ প্রশ্ন অনেকের। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পণ্য আমদানিকারকের গুদামে থাকলেও পণ্যের দাম বাড়ছে। অথচ এ পণ্যের মালিক আমদানিকারকরা। কিন্তু মজার বিষয় হলো সরকার অভিযান পরিচালনা করলে জরিমানা করে থাকেন গুদাম মালিককে। মালিক ডিও বিক্রি করলেও বলতে পারেন না এ পণ্যের মালিক তিনি নন। কারণ পণ্যের গায়ে তার কোম্পানির সিল দেয়া আছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চাল আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার পরই আমদানিকারকরা ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ডিও বিক্রি করে দেন। এসব ডিও আবার ভ্রাম্যমাণ কিংবা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের কাছে নগদ কিংবা বাকিতে বিক্রি করে ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানগুলো। কয়েক সপ্তাহ ধরে খাতুনগঞ্জের ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানগুলো ভোজ্যতেল ও চিনির চেয়ে চালের ডিও নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিল। চালের দাম ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকায় এসব ট্রেডারের উৎসাহে ডিওতে বিনিয়োগ করেন ছোট ব্যবসায়ীরাও। কেউ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে, কেউ আবার মহাজনদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে চালের ডিও কেনেন। অন্য খাতের ডিও ব্যবসায়ীরাও চালের বাজারে প্রবেশ করায় চাহিদায় ব্যাপক উল্লম্ফন ঘটে, যা প্রভাব ফেলে পণ্যটির দামে।
ব্যবসায়ীরা জানান, মোটামুটি সহনীয় দামেই ভারত ও মিয়ানমার থেকে চাল আমদানি করেছেন আমদানিকারকরা। এসব চালের ডিও বস্তাপ্রতি ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি করতে থাকে ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে করে প্রতি কেজি চালের মূল্য দাঁড়ায় ৩৪ টাকা। এ ডিও বিভিন্ন হাত ঘুরে বিক্রি হয়ে থাকে ২২-২৩শ’ টাকায়। এতে প্রতি কেজি চালের মূল্য দাঁড়ায় ৪৬ টাকায়। আর এতে বাজার লাগামহীন হয়ে পড়ে। পাইকারি চাল বিক্রেতারাও বেশি দামে পণ্যটি বিক্রি করেন।
এক দশক ধরে ভোজ্যতেল ও চিনির ডিও কেনাবেচার সঙ্গে যুক্ত খাতুনগঞ্জের এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করে বলেন, মাসখানেক আগেও আমার কাছে একাধিক আমদানিকারক ও পরিশোধন কোম্পানির ভোজ্যতেলের ডিও ছিল। কিন্তু চালের বাজার ক্রমাগত বাড়তে থাকায় কয়েকটি ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে চালের ১০টি ডিও কিনি। চলতি মাসের মাঝামাঝি ওই ডিও বিক্রি করে কয়েক লাখ টাকা লাভও হয়। গত সপ্তাহের বিভিন্ন সময় আরো ১০টি চালের ডিও ক্রয় করি বিভিন্ন দামে। প্রতিটি ডিওতে চালের গড় দাম বস্তা প্রতি ১ হাজার ৭৭০ টাকা হলেও বর্তমানে ১ হাজার ৬৫০ টাকায় নেমে এসেছে। মৌলভীবাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ী ডিও কেনার আশ্বাস দিলেও দাম কমায় এখন আর আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঊর্ধ্বমুখী বাজারে ডিওতে বিক্রি করা আতপ চালের দাম বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ১ হাজার ৯০০ টাকা পর্যন্ত উঠে যায়। সর্বশেষ গতকাল একই ডিও বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৬৫০ থেকে ১ হাজার ৬৬০ টাকায়। দাম আরো কমার আশঙ্কায় অধিকাংশ ব্যবসায়ীই ডিও ছেড়ে দিতে চাইছেন।
এদিকে ঢাকার বেগমগঞ্জ থেকে ডিও কিনেছিলেন গেন্ডারিয়ার বেলাল হোসেন। তিনি বলেন, এক মাস ধরে প্রতি সপ্তাহে দুটি করে ডিও (প্রতি ডিওতে ১৮ টন) ক্রয় করি। এখন ক্রেতা সংকটে পড়েছি। চলতি সপ্তাহের শুরুতে আরো একটি ডিওর চাল গুদাম থেকে উত্তোলনের কথা থাকলেও তা না করে ডিও বিক্রি করে দেয়ার কথা ভাবছি।

দেশে ভোগ্যপণ্যের প্রধান প্রধান ব্যবসাকেন্দ্রে ডিও প্রথার প্রচলন ছিল। ২০১১ সালের অক্টোবরে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন আইন জারির মাধ্যমে ডিও প্রথা বন্ধ করে দেয়া হয়। এর পরিবর্তে এসও (সাপ্লাই অর্ডার) পদ্ধতি চালু করলেও ডিও-ই মূলত বেচাকেনা হচ্ছে। ক্যাশমেমো বা রসিদে ক্রয়ের তারিখ, পরিমাণ ও দাম লিখে একটি সিল ও স্বাক্ষর দিয়েই পণ্য বিক্রি হয় এ পদ্ধতিতে। বিভিন্ন হাত ঘুরে বাড়তে থাকে পণ্যের দামও।

বাড়তি চাহিদাকে পুঁজি করে চাল বেচাকেনায় এ বছর প্রথা শুরু হয় বলে জানান চাক্তাইয়ের ব্রাহ্মণবাড়িয়া অটো রাইস মিলের স্বত্বাধিকারী মো. ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, গত কয়েক মাসে সংকটকালে চাল আমদানি বেড়ে যাওয়ায় ডিওর মাধ্যমে লেনদেন করছিলেন ব্যবসায়ীরা। এক সপ্তাহ আগেও ডিও পর্যায়ে চালের দাম বস্তা প্রতি ১ হাজার ৮০০ টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গতকাল ডিওতে তা ১ হাজার ৬৫০ টাকায় নেমে আসে। ডিওর দাম কমে যাওয়ায় নগদে বিক্রি হওয়া চালের দামও কমছে।

সম্প্রতি চালের মজুদবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ডিও সংগ্রহকারীদের মধ্যেও চালের বিক্রয়চাপ দেখা দিয়েছে। এর প্রভাব পড়ছে দামে। তারা ডিও মালিকদের বলেন, দু-এক দিনের মধ্যেই চাল গুদাম থেকে সরাতে হবে। বিক্রি করা চাল তারা আর কোনভাবেই রাখতে চান না। আর এ কারনেই বাজারে ডিও’র দাম কমে যায়। আর এর প্রভাব পড়ে বাজারে। কমতে থাকে চালের দাম।
যদি চালের বাজারে ডিও পদ্ধতি চালু না হতো তাহলে হয়তো দাম এত লাগামহীন হতো না। কিন্তু কার স্বার্থে কে এই ডিও পদ্ধতি চালু করলো তার কোন হদিস খোজে পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারের উচিত হবে এদের খোঁজে বের করা। এদের আইনের আওতায় আনতে পারলেই বাজার সরকারের নিয়ন্ত্রনে থাকবে।
কাওরান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী জনতা ট্রেডার্সের মো. রাসেল বলেন, চালের বাজার নিয়ন্ত্রন করতে হলে এখন থেকে ডিও পদ্ধতি বাতিল করতে হবে। তা না হলে যে কোন সময় বাজার আবারও অস্তির হতে পারে।

http://www.dailysangram.com/post/300969