২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭, সোমবার, ৬:৩০

নির্বাচনী আলোচনায় ভাটা

দেখা অদেখা

সালাহউদ্দিন বাবর

বিভিন্ন এলাকায় ভোটপ্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারকাজ শুরু হয়েছে। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে মাঠপর্যায়ে নির্বাচনে বিভিন্ন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের তৎপরতা, তাদের অবস্থান ও সম্ভাবনাসহ ভোট পরিস্থিতির হাল-হকিকত নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। অবশ্য গোটা দেশের চেহারা এমন নয়। বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষ নিয়ত জীবন বাঁচানোর সংগ্রামে লিপ্ত। যারা আগামীতে যেসব এলাকা থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, সেখানে তাদের উপস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে না। কারণ এখন ভোট চাওয়ার সময় নয়, ত্রাণসামগ্রী নিয়ে দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সময়। কিন্তু যারা ভোটপ্রার্থী, তারা গণমানুষের দুঃখের সময় কখনোই পাশে থাকেন না; তবে সুযোগমতো ভোটের আগে গিয়ে হাজির হন। ভোটের পর আবার উধাও হয়ে যান। এটাই তাদের অধিকাংশের বরাবরের ভূমিকা। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের রাজনীতির স্বরূপ এমন যে, রাজনীতিকদের বেশির ভাগই নিজের ভাগ্য আর ক্ষমতা অর্জনের জন্য রাজনীতিকে বেছে নেন। দূর অতীতে রাজনীতির লক্ষ্য শুধু ক্ষমতা ছিল না; সাথে ছিল জনসেবা। এখন আর তা নেই। যা হোক, ভোটপ্রার্থীদের উৎসাহের কথা পত্রিকার প্রতিবেদনে এলেও বন্যাপ্লাবিত অঞ্চলের বাইরেও সাধারণ মানুষের মধ্যে ভোটের ব্যাপারে কোনো আগ্রহ-ঔৎসুক্যের আভাস নেই। অথচ বাংলাদেশের মানুষ ভোটকে উৎসব হিসেবেই নিয়ে থাকে। কিন্তু এখন সেটা তেমন লক্ষ করা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, ভোট নিয়ে এখন মানুষের মধ্যে এক ধরনের অজানা শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। অবাক করার বিষয়, কিছু দিন আগে রাজনৈতিক অঙ্গনে ভোট নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছিল। এখন সে আলোচনায় ভাটা পড়েছে।
পক্ষান্তরে আদালতসংক্রান্ত ব্যাপার নিয়ে এখনো চলছে নানা আলোচনা ও হিসাব-নিকাশ। নির্বাচন নিয়ে জনসাধারণের এই মনোভাবের পাশাপাশি বিজ্ঞজনদের পর্যবেক্ষণও খুব স্পষ্ট নয়। হঠাৎ করেই যেন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে একটা ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। অথচ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আর মাত্র এক বছরের সামান্য বেশি বাকি। নির্বাচন কমিশন নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যে সংলাপ শুরু করেছে, তাতে কিছুটা নির্বাচনী আমেজ এসেছিল বটে; কিন্তু সেটা এখন আর নেই। সংলাপের প্রয়োজন নিয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই। এতে নানা দৃষ্টিভঙ্গি, ভাবনা ও পরামর্শ পাওয়া যাবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এত মেহনতের ফল কতটা কার্যকর হবে? পরামর্শ ও ভাবনা কতটা গ্রহণ করা হবে? এ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের যে মনোভাব তা খুবই রক্ষণশীল ও নিছক দায় এড়ানো গোছের। নির্বাচন কমিশন দৃঢ়তার সাথে নির্বাচন পরিচালনা করবেÑ এখনো তেমন ভরসা জনগণের মধ্যে তারা জাগাতে পারেননি। সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে নির্বাচনকালে ক্ষমতাসীনদের ইতিবাচক ভূমিকা পালনের ব্যাপারে কারো আস্থা সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তো শর্ত দিয়েই রেখেছে, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ নির্বাচন সহায়ক সরকারের অধীনেই তা হতে হবে। এ দাবি শুধু বিএনপির নয়, নির্বাচন কমিশনের সংলাপ অনুষ্ঠানে এই দাবি সুশীলসমাজও উচ্চারণ করেছে। বিভিন্ন দলও এই দাবি জানিয়েছে, কিন্তু নির্বাচন কমিশন এ প্রসঙ্গে এখনো নীরব।

নির্বাচন সহায়ক সরকারের বিষয়টি এ মুহূর্তের একটি মৌলিক ইস্যু। অবিলম্বে এর সুরাহা হওয়া উচিত। দেশে ও দেশের বাইরে বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলা হচ্ছে। তাই বিষয়টি এখন আর এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। তবে এ বিষয়টি নিয়ে একমত হওয়া জরুরি। কিন্তু ক্ষমতাসীন সরকার এ পর্যন্ত তাদের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে দৃঢ়তার সাথে বলছে। পক্ষান্তরে বিএনপিসহ কিছু দল নির্বাচন সহায়ক সরকারের অধীনে ভোটগ্রহণের বিষয়ে দৃঢ় মনোভাব পোষণ করছে। তাই সবার যে মত একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান, তার বাস্তবায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে যাচ্ছে। অতীতের সংসদ নির্বাচনগুলো যদি পর্যালোচনা করা যায়, তবে দেখা যাবে, দলীয় সরকারের অধীনে অতীতে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে তার কোনোটিই সুষ্ঠু হয়নি। পক্ষান্তরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যতগুলো নির্বাচন এ দেশে হয়েছে, সেগুলো তুলনামূলকভাবে অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে। আগামীতে যদি একটি প্রশ্নমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানের আশা করা হয়, তবে
নির্বাচন সহায়ক সরকারের বিষয়ে কারো দ্বিমত করার অবকাশ থাকে না। দেশ যাতে কোনো ক্রান্তিকালের মধ্যে গিয়ে না পড়ে, সে জন্য কারো কোনো ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত স্বার্থ বিঘিœত হলেও সহায়ক সরকারকে মেনে নিতে কুণ্ঠাবোধ করা উচিত নয়। নির্বাচন একটি নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের অধীনে হওয়াই সঙ্গত। মনে রাখতে হবে, দলবিশেষ ক্ষমতায় যাবে-আসবে; কিন্তু রাষ্ট্র স্থায়ী প্রতিষ্ঠান। তাই এর স্বার্থে সবাইকে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করতে হবে।

এই প্রেক্ষাপটে এবারে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা ও জাতীয় ঐকমত্যে পৌঁছা খুব জরুরি। ২০১৪ সালে যে নির্বাচন হয়েছে, তা নিছক একটি প্রহসন। সেই প্রহসনের নির্বাচনে যারা নিজেদের বিজয়ী মনে করছেন, তাদের হয়তো আইনকানুনের মারপ্যাঁচে সিদ্ধ বলা যেতে পারে; কিন্তু তারা আসলে কতটা তৃপ্ত তা প্রশ্নসাপেক্ষ। ‘বিজয়ী’দের বিরোধিতাকারীরা নির্বাচন নিয়ে ক্ষুব্ধ। আর সর্বস্তরের জনগণ ভোটব্যবস্থার হাল দেখে হতাশ। বোদ্ধারা ভাবছেনÑ গণতন্ত্র বিপন্ন হয়েছে, দেশে নির্বাচন ব্যতিরেকে একটি অসামরিক শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়েছে। আন্তর্জাতিক সমাজ এ দেশে গণতন্ত্রকে বিপর্যস্ত দেখে উদ্বিগ্ন। আর দেশে সৃষ্টি হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। এর পরিণতিতে অপশাসন সৃষ্টিকারীরা হয়ে উঠেছে তৎপর। দেশে দুর্নীতি, অনিয়ম, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত চলছে। বেড়েছে নিরীহ নারী ও শিশু নির্যাতন। শিক্ষাঙ্গনে লেখাপড়ার পরিবর্তে শুরু হয়েছে মাস্তানি। এতসব অনিয়ম নিয়ে দেশ এগিয়ে যাবে কিভাবে, তা ভেবে দেখতে হবে। বাংলাদেশকে একটি সুখী সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করার যে স্বপ্ন অতীতে আমাদের নেতারা দেখেছিলেন, তার পরিণতি কী হবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন।

ক্ষমতাসীন সরকারের একটি বক্তব্য নিয়ে এখন ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্ক হচ্ছে। তা হলো ‘উন্নয়ন’। আমাদের কথা হলো, দেশে উন্নয়ন হচ্ছে কি হচ্ছে না, তা নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, উন্নয়নের আর যে উপাত্তগুলো রয়েছে তার হাল অবস্থা কী, সেটাই আমাদের জানার বিষয়। আর এটা বোঝারও প্রয়োজন রয়েছে যে, উন্নয়ন কি সবাইকে স্পর্শ করছে? না মুষ্টিমেয় কিছু ভাগ্যবানের কপাল খুলছে? উন্নয়নের সাথে সমান্তরালভাবে চলতে হয় গণতন্ত্রকে। এ দুটোর মাঝে ভারসাম্য না থাকলে দেশ-জাতির প্রকৃত উন্নয়ন হয় না। উন্নয়নের স্বার্থে যেমন গণতন্ত্র অপরিহার্য, তেমনি গণতন্ত্র উন্নয়ন ছাড়া সফলতা পায় না। প্রকৃত উন্নয়নের গতিপথ মসৃণ করতে গণতন্ত্র অপরিহার্য। উন্নয়নের জন্য শান্তিপূর্ণ পরিবেশ দরকার; তা গণতন্ত্র ব্যতিরেকে সম্ভব নয়। প্রকৃত অর্থে, উন্নয়ন একটি সমন্বিত বিষয়। গণতন্ত্র না থাকলে সুশাসন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। গণতন্ত্র একটি জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রযন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে। উন্নয়নের কারণে দেশে অর্থপ্রবাহ বাড়ে, বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয়ের জন্য টাকা আসে। এই বিপুল অর্থের অপচয় থেকে দুর্নীতি-অনিয়ম বিস্তৃত হয়, যা বর্তমানে ব্যাপকভাবে বেড়েছে। যেহেতু এখন দেশে জবাবদিহিমূলক প্রশাসন নেই, তাই গণতন্ত্র অকার্যকর। সরকারের বা নির্বাহী বিভাগের সব কর্মকাণ্ডের জবাবদিহি করবেন সংসদ সদস্যরা। কিন্তু এখন যেহেতু সংসদ বাস্তবে কার্যকর নেই, তাই জবাবদিহিমূলক কোনো প্রশাসনব্যবস্থাও নেই। ফলে উন্নয়নের ধারা হোঁচট খাচ্ছে। আরেকটি পথ রয়েছে উন্নয়ন ও দুর্নীতির হাল-হকিকত জানার। সেটা হলো সংবাদপত্র। যদি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকে, তবে তা সমাজের দর্পণ হিসেবে দেশের প্রকৃত চিত্র ফুটিয়ে তোলে। কিন্তু এখন সংবাদপত্র বিভিন্ন চাপের সম্মুখীন। তাই তাদের পক্ষে সব কিছুতে সোচ্চার হওয়া সম্ভব হচ্ছে না। স্বাধীন সংবাদমাধ্যম গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান শর্ত। বাকস্বাধীনতা গণতন্ত্রের একটি মৌলিক উপাদান। এটা বাধাগ্রস্ত হলে গণতন্ত্র অসম্পূর্ণ থাকে। এখন যেখানে প্রশাসনের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেয়ার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নেই, সংসদ সে ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করছে না; তখন সরকারেরই উচিত দেশের হাল-হকিকত জানার জন্য সংবাদপত্রকে মুক্ত স্বাধীন ভূমিকা পালন করতে দেয়া। সংবাদপত্রের সমালোচনা ও মতামত সরকারকে সঠিক পথে চলতে সাহায্য করে। সরকারকে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সহায়তা দেয়। পশ্চিমের উন্নত দেশগুলোতে সংবাদমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে মনে করা হয়। ভালো উদাহরণ অনুসরণ তো দোষনীয় নয়, বরং কল্যাণকর। যেখানে স্বাধীন গণমাধ্যমের অস্তিত্ব নেই, সেখানে স্বৈরাচার কায়েম হয়। স্বৈরাচার না দেশের মানুষের কল্যাণ করে, না যারা ক্ষমতায় থাকেন তাদের কোনো স্থায়ী সহায়তা দিতে পারে। মানবাধিকারের সাথে স্বাধীন গণমাধ্যম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানবাধিকার সংবিধানে লেখা থাকলেই চলবে না; এর সুষ্ঠু চর্চা হতে হবে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না করলে মানবাধিকার মূল্যহীন হয়ে পড়ে।

গণতন্ত্রের আরো একটি বৈশিষ্ট্য হলো পরমতসহিষ্ণুতা, যা এখন বহাল নেই। ক্ষমতাসীনদের দায়িত্ব এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু রাষ্ট্রক্ষমতা তাদের হাতেই, তাই ক্ষমতার চর্চা তারাই করে থাকেন। সহিষ্ণুতা সেখান থেকেই শুরু হতে হবে। কিন্তু প্রতিপক্ষদের সাথে সম্প্রতি যে আচরণ রাষ্ট্রযন্ত্র করছে তাতে সহিষ্ণুতা নয়, বরং হিংসাবিদ্বেষ সৃষ্টি হচ্ছে। আর তা ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকবে এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরে পৌঁছে যাবে। এখন এই বিদ্বেষ শুধু প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধেই নয়; নিজ দল ও বলয়ের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। ক্ষমতার প্রতিপত্তি ও স্বার্থ নিয়ে এখন ক্ষমতাসীনেরাই পরস্পর সংঘর্ষ ও হাঙ্গামায় জড়িয়ে পড়েছে। অন্যত্র এর ছিটেফোঁটা নেই তা নয়। তবে তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে শাসক দলের বলয়ে। এই আত্মকলহে পরস্পর শুধু লাঠিসোটা নিয়েই নয়, আগ্নেয়াস্ত্র পর্যন্ত ব্যবহার করছে। নিজ আদর্শের মানুষের হাতে তার অপর সহযাত্রী হতাহত হচ্ছে। এসব সঙ্ঘাতে যেসব অস্ত্রপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে তার সবই বেআইনি। এভাবে জনপদের শান্তিশৃঙ্খলা বিনষ্টকারীরা আইন নিজের হাতে তুলে নিলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যেন চোখ বন্ধ করে আছেন। ওপরের নির্দেশেই তারা এ ক্ষেত্রে নীরব। এটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শুধু অসহায়ত্ব নয়, রাষ্ট্রযন্ত্রের নিদারুণ ব্যর্থতাকেই তুলে ধরছে। এখানেই দলপ্রীতির ভয়াবহ চিত্র লক্ষ করা যাচ্ছে। সরকারের হাত যদি এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কেঁপে ওঠে, তবে অন্যত্র কোন নৈতিক বলে তারা এগিয়ে গিয়ে ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগী হবেন?

আগামী নির্বাচন এ দেশে গণতন্ত্রের জন্য একটি বিরাট পরীক্ষা। সেই সাথে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে কোন পথে অগ্রসর হবে তার একটা নমুনা চিত্রও ভেসে উঠবে। ১৬ কোটি মানুষের এ দেশ স্থিতিশীলতার দিকে অগ্রসর হবে, না অস্থিতিশীলতার ঘূর্ণিপাকে নিমজ্জিত হবে; তার একটা আভাস লক্ষ করা যাবে। যদি নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হয় এবং যদি সবাইকে এভাবে আশ্বস্ত করা যায় যে, নির্বাচনের মাধ্যমে যে রায় এসেছে তা জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন, তাহলে দেশ স্থিতিশীলতার দিকে অগ্রসর হতে কোনো বাধা থাকবে না। দেশের সব কিছু একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহ করার পরিবেশ পাবে এবং ১৬ কোটি মানুষের হাজার সমস্যা নিয়ে বিরাট চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার তখন এগিয়ে যেতে পারবে। যারা আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পাবেন, তাদের স্কন্ধে বহু দায়িত্ব চাপবে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রায় অর্ধশতাব্দী হতে চলেছে। জাতীয় নেতৃত্ব অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা আর শ্রমের বিনিময়ে আমাদের একটি সার্বভৌম ভূখণ্ড এনে দিয়েছেন। তার পর আর কিছু গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জিত হয়নি। রাষ্ট্রযন্ত্রের কাঠামো তৈরি হতে পারেনি। রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ নিজ বলয়ে প্রত্যাশামাফিক উঠে দাঁড়াতে পারেনি। এসব বিভাগ এখনো নিজ নিজ সীমার মধ্যে অবস্থান না করায় অস্থিরতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না।

এ দিকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ক্রমাগত জটিল হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ নানা সমস্যার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। রোহিঙ্গা ইস্যু সবে শুরু হলো। এর বিস্তার কিভাবে ঘটে তা এখনো কারো কাছে পরিষ্কার নয়। তবে সহজে এ কথা বলা যেতে পারে, একটা বাড়তি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ বাংলাদেশের ঘাড়ে এসে পড়েছে। এই সমস্যার সমাধান কোন পথে হবে তা বলার সময় আসেনি। কয়েকটি মুসলিম দেশ ছাড়া গোটা বিশ্ব এখনো এ নিয়ে কোনো কিছু বলছে না। আন্তর্জাতিক সমাজ এ ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর ব্যাপারে সরকার এখনো কিছু করতে পারেনি। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ ভারতকে সব ক্ষেত্রে বন্ধুত্ব দেখিয়েছে। অথচ ভারত এখন রোহিঙ্গা ইস্যুতে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে মিয়ানমারের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা সরকারের পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে একটি বড় ব্যর্থতা। এমনকি সব মুসলিম দেশসহ পশ্চিমের বিভিন্ন দেশকে এখনো বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে পাওয়া যায়নি। আর একা তো বাংলাদেশের পক্ষে শরণার্থীদের বিরাট বোঝা বহন কিংবা সমস্যার সমাধান করা অসম্ভব। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যেমন একটি অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়েছে, তেমনি দেশের ভেতরে সরকার এই ইস্যুতে গোটা জাতিকে এক করার প্রয়াস পায়নি। এত বড় একটি সমস্যায় দেশ পড়েছে, কিন্তু তা নিরসনের জন্য সব রাজনৈতিক দলকে তার পাশে পাচ্ছে না। কারণ সরকারের সাথে বিরোধী দলের সম্পর্ক শুধু মতপার্থক্যের নয়, বলতে গেলে বৈরিতার। সরকারের সাথে বিপক্ষ শক্তির অবশ্যই মতপার্থক্য থাকবে, কিন্তু সে সম্পর্ক কখনো বৈরিতায় যাওয়া ঠিক নয়। পরস্পর সৌজন্যমূলক ও সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখা সব পক্ষেরই উচিত। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, বাংলাদেশে এই ঐতিহ্য গড়ে ওঠেনি। নীতি-আদর্শ ও দলের দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতায় আন্তঃদলকলহ কত ব্যাপক তা দেশের পত্রপত্রিকার পাতায় চোখ রাখলেই বোঝা যায়। বিশেষ করে সাম্প্রতিককালে ক্ষমতাসীনেরা তাদের প্রতিপক্ষের প্রতি যেভাবে বিষোদগার করে হুমকি দিয়ে আসছেন, তাতে স্বাভাবিক সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখা আসলেই কঠিন। সব বিষয়েই যদি এখন ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয়ে থাকে তবে আগামী নির্বাচনের সময় তারা কী করবেন তা সহজেই অনুমেয়। আর এমন পরিবেশে নির্বাচনে যাওয়া সরকারের প্রতিপক্ষের জন্য কঠিন হবে। সবচেয়ে বড় ভয় হচ্ছে, বর্তমানে জনমত কিন্তু সরকারের অনুকূল নয়। তবুও তারা আবারো ক্ষমতায় ফিরে আসবেনই এমন প্রত্যয় বারবার ঘোষণা করা হচ্ছে। অথচ নির্বাচনের ফলাফল জানার আগে কারো পক্ষেই এ কথা বলা সম্ভব নয় যে, তারা ক্ষমতায় আসবেন কি না। তাদের এই মনোভাবের তাৎপর্য কি এটাই যে, গণরায় নয়, পেশিশক্তিই তাদের বিজয়ী করবে। যদি তাই বোঝানোর প্রয়াস হয়ে থাকে, তবে আগামী নির্বাচনের ভাগ্য তো ভালো হওয়ার কোনো হেতু নেই। শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্ব অবশ্য আগে বলেছেন তারা একটি ‘প্রশ্নমুক্ত’ নির্বাচন চান। তাদের এই বক্তব্য কতটা আন্তরিক, তা ভবিষ্যতে প্রমাণিত হবে।
২০১৮ সালের শেষ দিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সে সময় জাতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর আগ্রহ থাকবে। নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে কোনো ফাঁকফোকর থাকলে সেদিকে তারা নজর দেবেন। আগামী নির্বাচন যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, তার জন্য সমাজে যার যার অবস্থান থেকে যথাযথ ভূমিকা রাখা উচিত। যেহেতু নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের, তাই এ সম্পর্কে কমিশনের রয়েছে ঐতিহাসিক দায়। নির্বাচন যাতে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে হতে পারে, জনগণ যাতে নিরাপদে নির্বিঘেœ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে, তা পূর্ণভাবে নিশ্চিত করতে হবে কমিশনকে। নির্বাচনে শান্তিপূর্ণভাবে ভোট প্রয়োগের স্বার্থে সেনা মোতায়েন করার বিষয়টি এখন জাতীয় দাবি হয়ে ওঠার পথে। কিন্তু কমিশনের এ সম্পর্কিত মতামত একেবারেই স্পষ্ট নয়।

নির্বাচনে যদি ভোটাররা নির্বিঘেœ ভোট দিতে না পারেন তবে গণতন্ত্র থাকে কোথায়? তাহলে তো বিগত নির্বাচন কমিশনের মতো এ কমিশনকেও ব্যর্থতার দায় নিয়েই বিদায় নিতে হবে। সেই সাথে নির্বাচন ভণ্ডুল হলে যে জাতীয় দুর্যোগ নেমে আসবে, তার দায় থেকেও তারা রেহাই পাবেন না। এই কমিশনের ওপর কত বড় দায়িত্ব এবার এসেছে, সেটা তাদের উপলব্ধি করতে হবে। তাই যেকোনো মূল্যে আগামী নির্বাচন অর্থবহ করে তোলার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে জাতির দিকে তাকিয়ে যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নিতে হবে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/254565