২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, রবিবার, ৯:০৮

ঝুঁকির মুখে অর্থনীতি

পরিশোধযোগ্য স্থিতি ১৬ বছরে প্রথমবারের মতো নেতিবাচক

আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও রপ্তানি আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি ব্যাপক অর্থপাচারের কারণে কমে গেছে দেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্ট (বিওপি)। ব্যালেন্স অব পেমেন্টের হিসাবে টান পড়ার কারণ আমদানি বৃদ্ধি না অর্থপাচারÑ তা খোলাসা করছেন না কেউ। সরকারি কর্তাব্যক্তিরা আমদানি বাড়ার কথা বললেও বিশ্লেষকরা বলছেন ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থপাচারের কথা। গত কয়েকমাসে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে কিছুটা অনিশ্চয়তা দেখা দেওয়ায় হঠাৎ করে ব্যাপক অর্থপাচার হয়েছে বলে ধারণা তাদের। যে কারণে ১৬ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট বা পরিশোধযোগ্য স্থিতির পরিমাণ নেতিবাচক দিকে ধাবিত হয়েছে। আর এতে ঝুঁকিতে পড়েছে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, ট্রেড অব ব্যালেন্স সব সময়ই নেগেটিভ। এখন একটু বেশি। যার প্রভাব পড়েছে ব্যালেন্স অব পেমেন্টে। একই সঙ্গে কারেন্ট অ্যাকউন্ট ব্যালেন্স গত কয়েক বছর থেকে কমতির দিকে। এরসাথে যোগ হয়েছে রেমিট্যান্স। তাই রিজার্ভ কিছুটা কমেছে। তবে ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট (এফডিআই) বেড়েছে। রিজার্ভও বাড়তে শুরু করেছে তাই ব্যালেন্স অব পেডমেন্ট কমলেও উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। ব্যালেন্স অব পেমেন্ট টান পড়ার কারণ অর্থপাচার কি না জানতে চাইলে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান পরোক্ষ প্রভাবের কথা স্বীকার করেন। বলেন, আমদানি করলে তাতে ওভার ইনভয়েসিংয়ের সুযোগ থাকে। এর বাইরে গিয়ে অর্থপাচার হলে তা ব্যালেন্স অব পেমেন্টের হিসেবে আসবে না। তাই শুধু অর্থপাচারের কারণেই ব্যালেন্স অব পেমেন্টে টান পড়েছে, বিষয়টি ঠিক নয়।

দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব সম্পর্কে তিনি বলেন, ফরেন কারেন্সী রিজার্ভ কিছুটা কমেছে। ডলারে দামে কিছুটা প্রভাব পড়েছে। তারপরও এটা সাময়িক সমস্যা, খুব শিগগিরই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
গত আর্থিক বছরে যেখানে ব্যালেন্স অফ পেমেন্টে উদ্বৃত্ত ছিল ৪৮০ মিলিয়ন ডলার, চলতি অর্থ বছরে (২০১৭-১৮) তা কমে ১৭৯ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। রফতানি আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় অনেক বেড়ে যাচ্ছে। এরফলে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে বড় ধরণের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক আশা করছে, চলতি অর্থ বছরের শেষে সার্বিক ব্যালেন্স ২ দশমিক ৩৫ বিলিয়িন ডলারে পৌঁছবে। কিন্তু তারপরও কারেন্ট অ্যাকাউন্ট বা চলতি হিসাবে ২ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার ঘাটতি থাকবে বলে ধরা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত ব্যালেন্স অব পেমেন্টের সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য বিশ্লেষণে এটি ধরা পড়েছে।
অর্থনীতিবিদের মতে, কোনো দেশের বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের হিসাবে যদি উদ্বৃত্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়, তাহলে বুঝতে হবে নিয়মিত লেনদেনের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারকে কোনো ঋণ করতে হয় না। তাদের মতে, ব্যালান্স অফ পেমেন্ট কমে যাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে, আমদানি বৃদ্ধি এবং রপ্তানি হ্রাস পাওয়া। আয়-ব্যয়ের এই চলতি হিসাবে ঘাটতি দেখা দিলে অর্থাৎ আমদানি ব্যয়ের বাড়তি হলে চাহিদাজানিত অর্থের যোগান দিতে সরকারকে ঋণ করতে হয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এই ভারসাম্যহীন পরিস্থিতি দেশকে ঋণ নির্ভরতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। রপ্তানি থেকে শুরু করে সার্বিক অর্থনীতিতে চরম মন্দাবস্থা বিরাজ করছে। তাদের মতে, এ পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে না পারলে, দেশে ভয়াবহ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেছেন, আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। এর মূল কারণ সার্বিকভাবে আমদানি যে হারে হয়েছে সেই হারে রফতানির প্রবৃদ্ধি বাড়েনি। গত বছরের তুলনায় রফতানি প্রবৃদ্ধি ৮ থেকে ৯ শতাংশে কমেছে। যে কারণে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে।
বাংলাদেশ রফতানিকারক সমিতির (ইএবি) সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী বলেন, বড় মেগা প্রকল্পের কাজ কিছু শেষ হয়েছে, কিছু চলছে। এক্ষেত্রে প্রকল্পের কাজে মেশিনারিজ আমদানিতে ব্যয়টা বেড়েছে। একই সঙ্গে চাল ও মূলধনী মেশিনারির আমদানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যালেন্স অফ পেমেন্টে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি গত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনি¤œও ছিল কিছুদিন আগে। এটা বাড়তে শুরু করেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হলো নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়। সে হিসাবে উন্নয়নশীল দেশের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকা ভালো। কিন্তু গত কয়েক বছর উদ্বৃত্তের ধারা অব্যাহত থাকলেও গেল অর্থবছর থেকে ঋণাত্মক ধারায় চলে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ বছর জুলাইয়ে আমদানি বেড়েছে শতকরা ৪৭ ভাগ, যা গত বছর এ সময়ে ছিল মাত্র ২ দশমিক ৯৯ ভাগ। অন্যদিকে জুলাইয়ে রপ্তানি বৃদ্ধি পায় শতকরা ১৮ দশমিক ৫০ ভাগ। অর্থাৎ রপ্তানির তুলনায় আমদানির হার ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে।

সূত্র মতে, দীর্ঘদিন ধরে অর্থনীতিতে মন্দাবস্থা বিরাজ করছে। বিনিয়োগ খাতে নেতিবাচক পরিস্থিতি বিরাজমান। অর্থনীতিকে উন্নত করতে যেভাবে বিনিয়োগ বৃদ্ধি প্রয়োজন, তা নেই বললেই চলে। দেখা যাচ্ছে, আভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং রপ্তানির পরিবর্তে আমদানির হার দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। আমদানি-রপ্তানিতে কোনো ভারসাম্য নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, খাদ্য, মূলধনী মেশিনারি, তুলার আমদানি ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি অর্থ বছরের প্রথম মাসে চাল ও মূলধনী মেশিনারির আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ৬১ ভাগ। গত বছর জুলাইয়ে যেখানে খাদ্য আমদানি করা হয়েছে মাত্র শূণ্য দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলারের, সেখানে এ বছর করা হয়েছে ১০১ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলারের। দুধ, এডিবল অয়েল, চিনির আমদানি বেড়েছে শতকরা ২৬ ভাগ থেকে ১১৪ ভাগ পর্যন্ত। অন্যদিকে জুলাইয়ে রপ্তানি সামান্য বৃদ্ধি পেলেও আমদানির সাথে এর পার্থক্য এক বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।

আমদানি ও রপ্তানির মধ্যকার এই বিপুল পার্থক্য থেকে বোঝা যায়, দেশের অর্থনীতি ভাল অবস্থায় নেই। সরকার বৈদেশিক মুদ্রার যে রেকর্ড রিজার্ভ নিয়ে গর্ববোধ করে, তাতেও টান ধরেছে। চলতি বছরের ৩০ জুন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেখানে ছিল ৩৩ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার, সেখানে সেপ্টেম্বরের ১৩ তারিখ তা কমে হয়েছে ৩২ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার। আমদানি-রপ্তানির মধ্যকার ভারসাম্যহীনতার কারণে টাকারও অবমূল্যায়ন হয়েছে। গত বছর সেপ্টেম্বরে এক ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৭৮ দশমিক ৪ টাকা, এ বছর তা বেড়ে হয়েছে ৮০ দশমিক ৭ টাকা। অর্থাৎ সার্বিকভাবে অর্থনীতির গতিপ্রবাহ ঋণাত্মক দিকে ধাবিত। প্রতিবেশি দেশগুলো তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে শুরু করে আমদানির চেয়ে রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বলা যায়, প্রতিবেশি দেশের তুলনায় অর্থনৈতিক দিক থেকে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি।
বিশেষজ্ঞরা জানান, একটি দেশে আমদানি তখনই বৃদ্ধি পায়, যখন দেশটির উৎপাদন সক্ষমতা হ্রাস পায়। উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে তা দেশের প্রয়োজনীয়তা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা হয়। যে চাল উৎপাদনে আমরা বছরের পর বছর ধরে রেকর্ড করে আসছি এবং রপ্তানিও করেছি, সে চাল এখন বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। চালের দাম দরিদ্র মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। মানুষের জীবনযাপনে টানাপড়েন চলছে। সরকারের তরফ থেকে যেভাবে উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে, বাস্তবে তার বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট সর্বশেষ কমেছিল ২০০০-০১ অর্থবছরে। তখন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ছিল।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন-দেশের সার্বিক অর্থনীতি গতিশীল করার ক্ষেত্রে এটি অন্যতম ব্যর্থতা। তাদের মতে, দেশে বেশ কয়েক বছর ধরে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সত্তে¡ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে না পারা দুঃখজনক। একই সঙ্গে দেশ দ্রæত গতিতে আমদানি নির্ভর হয়ে পড়ছে। সরকারের এ বিষয়ে মনোযোগ আছে বলে মনে হচ্ছে না। তাই দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হলে বিনিয়োগ, উৎপাদন এবং রপ্তানি বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই বলে মত দেন তারা।

https://www.dailyinqilab.com/article/97002