২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, রবিবার, ৮:৫১

যেখানে এখনো পৌঁছেনি ত্রাণ

শুক্রবার সকাল। উখিয়ার বালুখালী বাজার। বাইশ বছরের যুবক করিম উল্লাহ। হাতে কাপড়ের পুঁটলি। ঘরে অনাহারী বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তান, ভাইবোনের খাবারের জন্য প্রতীক্ষা। তাই পরনের কাপড় বিক্রি করতে বের হয়েছেন। যাবেন উখিয়ার কুতুপালং
ক্যাম্পের কাছে। শনিবার বেলা ১১টায় আরাকান সড়ক থেকে পশ্চিমে কিছু দূর যাওয়ার পর পড়লো বালুখালী শরণার্থী ক্যাম্প। পুরনো ক্যাম্পের ভেতর ও পাশ দিয়ে যাওয়া। এক সময় পুরনো ক্যাম্প পেছনে পড়লো। শুরু হলো নতুন নতুন পলিথিনের কুঁড়েঘর। এ পাহাড় সে পাহাড় হয়ে পুরো এলাকা ছেয়ে গেছে তাঁবুতে। পাহাড়ের পর পাহাড় অতিক্রম করলেও শরণার্থীদের তাঁবু আর শেষ হয় না। পাহাড়ের পর পাহাড়ে হাজার হাজার তাঁবু। উঁচু-নিচু পাহাড়, পাহাড়ি ঢাল ও ঝিরি অতিক্রম করে অনেকটা ভেতরে ও প্রায় শেষ প্রান্তের দিকে একটি পাহাড়ে গেলে সেখানে থাকা রোহিঙ্গারা বলেন, শুক্রবার মারা গেছে মিনারা। ওই দিনই তাকে দাফন করা হয়। তার বয়স হয়েছিল পঞ্চাশ। মিয়ানমার সেনার গুলিতে ছেলে নবী হোসেন (৩৫)কে মরতে দেখেন তিনি। তা ঘটে গত ২৬শে আগস্ট। ওই দিনই বাকিরা ঘর ছাড়েন। প্রাণ বাঁচাতে তারা বার বার দুর্গম পথ ধরেন। অন্তত ১০ দিন পর তারা উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পের পেছনে ওই পাহাড়ে পৌঁছান। তাঁবু গাড়েন। মিয়ানমার থেকে আসার সময় শেষ পাঁচদিন তারা প্রায় অনাহারে পথ পাড়ি দেন বলে জানান নিহত মিনারার মেয়ে সুরত আফজল।

সুরত কান্নাজড়িত কণ্ঠে মানবজমিনকে বলেন, আমরা আসার সময় পাঁচদিন কিছু খেতে পাইনি। পানি খেয়ে ছিলাম। তারপর উপোস থেকে এখানে আসি। কিন্তু আমাদের এই তাঁবু আরাকান সড়ক থেকে অনেক দূরে। তাই কোনো খাবার পৌঁছেনি। দুপুরের দিকে একজনের দেয়া কিছু চাল চুলায় চড়িয়েছে। তাই সকাল থেকেই উপুস সুরতের স্বামী নমি উদ্দিন, তাদের ছেলে নবী হোসেন, ইমাম হোসেন, মেয়ে কিসমত হোসেন ও কসমিদা। সবার চোখ কোটরে ঢুকে গেছে।
পাহাড় চূড়া থেকে কিছুটা নেমে একটি পলিথিনের নিচে দেখা গেল এক বৃদ্ধ বুক চাপড়াচ্ছে। ডানে-বামে কেবলই দুলছে। ঘন ঘন থু থু ফেলছে। কিছুক্ষণ পর পর শুয়ে পড়ছে। একেবারে হাড্ডিসার তিনি। তার নাম সোনা আহমেদ। বাড়ি বুথেডংয়ের সিকদারপাড়া।
তার স্ত্রী দিলদার বেগম বলেন, গত তিন দিন ধরেই আমরা না খেয়ে আছি। স্বামীর বাতে ধরেছে। তাই ছটফট করছে। অনাহারে আরো ছটফট করছে তাদের মেয়ে ছমিদা (১৫), আবদুর রহমান (১০), ফেরদৌস রহমান (৮)। তার পাশে আধমরা হয়ে শুয়ে আছে হামিদা (১৫)। সেও তিন দিন ধরে উপুস। তার আর কেউ নেই। তার পিতা হোছেন আহমদ (৬০) ও ভাই রেজা আহমদ (২০)কে গুলি করে মেরেছে বর্মী বাহিনী। আর তার ভাই নজিমুল্লাহ, ইব্রাহিম, ওসমান গণি, মোহাম্মদ এবং বোন উম্মে খাইর, মহুয়া এখনো নিখোঁজ।

তার অসুখ কিনা জানতে চাইতেই তিনি চোখ খোলেন। মাথা নেড়ে জানান ‘না’। ক্ষুধার্ত কিনা জানতে কিছুটা ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলে জানান। এর বেশি কিছু বলার শক্তি আর তার নেই।
সেখানে যে ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে না তা বুঝা গেল। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ওই এলাকায় কোনো ত্রাণ তৎপরতা চোখে পড়েনি। তাছাড়া নেই কোনো রাস্তা। পাহাড়ি ঝিরি ও পাহাড় বেয়ে যেতে লাগে বেশ সময়। কিন্তু সেই পাহাড়ের পরে আরো বেশ দূরে বেশ কয়েকটি পাহাড়েও তাঁবু গাড়তে দেখা গেছে। কিন্তু সেখানে নেই কোনো নলকূপ। নেই টয়লেটও। এমন পরিস্থিতিতে সেখানে শত শত তাঁবুর নিচে অসহায় রোহিঙ্গাদের অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাতে দেখা গেছে।
শুক্রবার এমন পরিস্থিতি চোখে পড়ে কুতুপালং ক্যাম্পের পেছনে এক থেকে দেড় কিলোমিটার দূরেও। সেখানেও ত্রাণ পৌঁছার নামটি নেই। আরো খারাপ পরিস্থিতি তারও পেছনে মধুছড়া খালের ওপারে পশ্চিমের তাঁবুগুলোতে। সেখানে খাল পার হয়ে যেতে হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নতুন আসা অধিকাংশ রোহিঙ্গা রয়েছেন আরাকান সড়ক থেকে অন্তত পৌনে বা আধ কিংবা এক কিলোমিটার পরে। সেখানে গাড়ি পৌঁছে না। সহজ যোগাযোগের কোনো রাস্তা নেই। সেখানে ত্রাণ না পৌঁছানোয় অসহায় ও নিঃস্ব রোহিঙ্গারা অনাহারে মানবেতর সময় পার করছে।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=84467