ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকে নিয়ে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী রাশেক রহমানের পক্ষে ক্যাম্পেইন করছেন রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ
২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, রবিবার, ৮:৩৬

এমপিপুত্র রাশেক রহমানের অনুষ্ঠানে রোকেয়া ভার্সিটির অর্থব্যয় নিয়ে তোলপাড়

সরকার মাজহারুল মান্নান রংপুর অফিস


রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কোষাধ্যক্ষ এইচ এন আশিকুর রহমান এমপির ছেলে রাশেক রহমানের আহ্বানে বিশ্বসেরা অল রাউন্ডার সাকিব আল হাসানকে নিয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থব্যয় নিয়ে তোলপাড় চলছে। ওই অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে সরাসরি ওই মেয়র প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় অংশ নেয়ারও অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন নীল দল এবং মনোনয়নপ্রত্যাশী আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে অনুষ্ঠানটি বাইরে থেকে স্পন্সর থাকলেও অভ্যন্তরীণ ব্যয় মিটিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। যে টাকা তোলা হয়েছিল তার সব খরচ হয়নি বলেও জানিয়েছে অনুষ্ঠানের সমন্বয়ক।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সাবেক সহ-সম্পাদক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কোষাধ্যক্ষ রংপুরের মিঠাপুকুরের এমপি এইচ এন আশিকুর রহমানের ছেলে রাশেক রহমার রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী হতে চান। এজন্য তিনি নগরবাসী বিশেষ করে নগরীর তরুণ ভোটারদের কাছাকাছি আসতে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন করছেন। এরই মধ্যে রংপুর স্টেডিয়ামে তিনি কণ্ঠশিল্পী মমতাজকে এনে বিশাল প্রচারণা চালিয়ে সঙ্গিতানুষ্ঠান করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় নির্বাচনী কৌশল হিসেবে অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানকে ব্যবহার করে তিনি গত ১৩ সেপ্টেম্বর রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এবং রংপুর ক্রিকেট গার্ডেনে দু’টি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এজন্য রাশেক রহমান ও সাকিব আল হাসানের যৌথ ছবি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসহ পুরো নগরীতে ফেস্টুন টাঙ্গানো হয়।
এ দিকে রাশেক রহমান তার নির্বাচনী প্রচারণার অংশ হিসেবে সাকিব আল হাসানকে কাজে লাগাতে রংপুরে ১৩ সেপ্টেম্বর যে দু’টি কর্মসূচি পালন করেন তাতে ছিল তরুণদের উপচে পড়া ভিড়। অনুষ্ঠানে আসতে আগের দিন ১২ সেপ্টেম্বর বিকেলে সাকিব আল হাসানের বহনকারী বেসরকারি হেলিকপ্টারেই রংপুর আসেন রাশেক রহমান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ। ওই দিন রাতেই মিঠাপুকুরে রাশেক রহমানের নিজ বাড়িতে স্পেশাল পার্টিতে যোগ দেন সাকিবের সাথে ভিসি কলিমউল্লাহ।

এ দিকে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সেদিন বিপুল উপস্থিতি সামাল দিতে লাঠিচার্জও করতে হয় পুলিশকে। তবে নির্ধারিত ক্রিকেট কর্মশালা অনুষ্ঠিত না হলেও যুব সমাবেশে দাঁড়িয়ে সাকিব সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘আপনারা আমাকে এত ভালোবাসেন তা আমি জানতাম না। আমার জন্য দোয়া করবেন। এই অনুষ্ঠানের আয়োজক রাশেক রহমান ভালো মানুষ। তার সাথে থাকবেন। রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তাকে ভোট দিবেন। তাহলে তিনি আপনাদের অনেক উন্নয়ন করবেন। এ সময় রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিও রাশেক রহমানের পক্ষে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট চান।’
এরপর রাশেক রহমান তার নির্বাচনী প্রচারণার অংশ হিসেবে ভিসি ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ ও ক্রিকেটার সাকিবকে নিয়ে একটি খোলা পিকআপে নগরী পরিদর্শন করে নগরবাসীকে হাত নেড়ে অভিবাদন জানান। এ সময় ভিসি নিজেও হাত নেড়ে রাশেক রহমানের পক্ষে নগরবাসীকে শুভেচ্ছা জানান।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর নিয়োগের ব্যাপারে রাশেক রহমানের তদবির থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাশেক রহমান একটু বাড়তি সুবিধা পান। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১০০ দিনে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন ধরনের সাতটি অনুষ্ঠানে রাশেক রহমান প্রধান অতিথি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি সভাপতি অথবা বিশেষ অতিথি হন, যা সরকারি গেজেটের প্রটোকল বিরোধী।

অভিযোগ উঠেছে, রাশেক রহমানকে খুশি করতেই সাকিবকে ঘিরে রাশেকের নির্বাচনী প্রচারণার কৌশলে পা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। শুধু তা-ই নয়, অনুষ্ঠানটির প্রচার-প্রচারণা ও ব্যয়ে রাশেক রহমান নিজে থাকলেও ক্যাম্পাসের অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আগ বাড়িয়ে খরচা বাবদ ১১ সেপ্টেম্বর দেড় লাখ টাকা কোষাগার থেকে উত্তোলন করে। অগ্রীম তোলা ওই টাকার খরচের খাত দেখানো হয়েছে মাঠ পরিষ্কার বাবদ ১০ হাজার, খেলোয়াড়দের ড্রেস বাবদ ২৮ হাজার, সম্মাননা ক্রেস্ট বাবদ ৪০ হাজার, ডেকোরেটর খরচ ৩০ হাজার, আপ্যায়ন বাবদ ১৫ হাজার এবং অন্যান্য খরচ ২৭ হাজার টাকা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে ওইদিন কাউকেই কোনো সম্মাননা ক্রেস্ট দেয়া হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ওই অগ্রীম টাকা কোষাগার থেকে গণ যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তাবিউর রহমান প্রধানের নামে প্রদান করে।
বিশ্ববিদ্যালয় উদ্যোগ নিয়ে একজন রাজনীতিবিদের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেয়া এবং তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ খরচ করার বিষয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন নীল দলের সাধারণ সম্পাদক আপেল মাহমুদ। তিনি নয়া দিগন্তকে জানান, সাকিব আল হাসান একজন রাজনীতিবিদের পক্ষ হয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে প্রার্থীর খরচে রংপুরে এসেছিলেন। সেই অনুষ্ঠান আগবাড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অর্থ খচর করার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদ অপচয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে আমি মনে করি। এ ধরনের আয়োজন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমর্যাদা দারুণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আমরা কারো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছি না।

অপর দিকে এ ঘটনায় উষ্মা প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম রব্বানী নয়া দিগন্তকে জানান, রাশেক রহমানের আমন্ত্রণে ও খরচায় সাকিব ক্যাম্পাসে আসেন বিষয়টি ব্যানার-ফেস্টুনেই উল্লেখ আছে। আর ক্যাম্পাসে কোনো কর্মশালা হয়নি। হয়েছে রাজনৈতিক বক্তৃতা, দোয়া ও ভোট চাওয়া হয়েছে নির্বাচনের জন্য। তাহলে সেই অনুষ্ঠান বাবদ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কিভাবে দেড় লাখ টাকা খরচ করে তা আমাদের বোধগম্য নয়। এ ঘটনায় এ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
এ দিকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. তুহিন ওয়াদুদ নয়া দিগন্তকে জানান, অনুষ্ঠানটির আগে আমরা কয়েক দিন ধরে মাইকিং ও বিলবোর্ড, ফেস্টুনের মাধ্যমে জানতে পারি একজন রাজনৈতিক ব্যক্তির উদ্যোগে একজন ক্রিকেটার ক্যাম্পাসে আসবেন। কিন্তু তাকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আনছে কি না বিষয়টি আমি শিক্ষক সমিতির সভাপতি হিসেবে ও অন্য শিক্ষকেরা জ্ঞাত ছিলেন না। এ ব্যাপারে অফিসিয়ালি জ্ঞাত নই। কিন্তু সেই অনুষ্ঠানে যা হয়েছে তা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ করতে পারে কি না তা নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আবার সেই অনুষ্ঠানে টাকা খরচ করার বিষয়টিও বিশ্ববিদ্যালয়ের এখতিয়ার আছে কি না তা নিয়েও কথা হচ্ছে। এ ধরনের একটি অনুষ্ঠান যদি কর্তৃপক্ষ করে থাকে তাহলে তাতে কেন শিক্ষক সমিতি ও কিংবা শিক্ষকেরা জানলেন না সেটাও বড় প্রশ্ন।

এ ব্যাপারে রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র ও আওয়ামী লীগের অন্যতম সম্ভাব্য প্রার্থী সরফুদ্দীন আহম্মেদ ঝন্টু সাংবাদিকদের বলেন, সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে নিয়োগ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় চালানোর জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকা খরচ করে কারো নির্বাচনী প্রচারণা করার জন্য নয়। তিনি প্রশ্ন রাখেন আর যদি তিনি সেটা করতে চান, তাহলে আমিও যদি সেখানে নির্বাচনী প্রচারণা অনুষ্ঠান করতে চাই, তাহলেও কি তিনি আমার অনুষ্ঠানের আয়োজন ও এ ক্ষেত্রে খরচ করবেন?
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের খ কালীন রেজিস্ট্রার ইবরাহিম কবীর জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিকেটের কর্মশালায় যোগদানের জন্য সাকিবকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সে মোতাবেক তিনি এসেছিলেন। এ জন্য দেড় লাখ টাকা অগ্রীম দেয়া হয়েছে। তবে কিভাবে, কার মাধ্যমে সাকিবকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল এ বিষয়ে কোনো উত্তর দিতে পারেননি তিনি।
এ ব্যাপারে অনুষ্ঠানটির সমন্বয়ক এবং গণ যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তাবিউর রহমান প্রধান নয়া দিগন্তকে জানান, সাকিব আল হাসানের সফরটি বাইরে থেকে স্পন্সর ছিল। কিন্তু তিনি যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এসেছিলেন। সেহেতু অভ্যন্তরীণ খরচ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ করেছে। এজন্য দেড় লাখ টাকা অগ্রীম উত্তোলন করা হয়েছিল। খরচগুলো এখনো সমন্বয় করা হয়নি। তবে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা উদ্বৃত্ত থাকতে পারে। তা কোষাগারে জমা দেয়া হবে। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এটি প্রথম ঘটনা যে, খরচের টাকা উত্তোলনের পর সব খরচ না হওয়ায় তা জমার দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর সাথে গতকাল মোবাইলে কথা বলার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/254372