২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, রবিবার, ৮:২২

মিয়ানমার ইস্যুতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি সম্পূর্ণ ব্যর্থ

বার্মায় রোহিঙ্গা মুসলমান গণহত্যার ঠিক এক মাস অতিক্রান্ত হলো। অথচ এত বড় বর্বর কাজের কোন প্রতিবিধান হলো না। সোয়া ৪ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানকে বিতাড়িত করে বাংলাদেশে পাঠানো হলো। কিন্তু তাদেরকে স্বদেশে অর্থাৎ মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কোন রকম সম্ভাবনা এখনো দৃশ্যমান হলো না। জাতিসংঘের মহাসচিব এ্যান্টনিও গুটট্রেস এই মর্মে কঠোর সতর্ক বাণী উচ্চারণ করেন যে, ‘এটি অং সাং সুচির শেষ সুযোগ। এখনই তাকে নৃশংসতা বন্ধ করতে হবে। অবিলম্বে তিনি যদি পদক্ষেপ গ্রহণ না করেন তাহলে মিয়ানমারের পরিণতি হবে ভয়াবহ, যেখান থেকে ফিরে আসার আর কোন পথ থাকবে না।’ জাতিসংঘ মহাসচিবের এই কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করার পরেও সংকট সমাধানের কোন পথ নির্দেশ দেখা যায়নি। বরং নতুন করে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর নির্যাতন শুরু হয়েছে। নতুন করে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষীবাহিনী অর্থাৎ বিজিবির কঠোর প্রহরার ফলে যে হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান নাফ নদী পার হতে না পেরে গভীর জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিলেন, এখন সীমান্ত প্রহরা শিথিল হওয়ার পরে ঐ হাজার হাজার উদ্বাস্তু এখন বাংলাদেশে প্রবেশ করা শুরু করেছে। সবকিছু মিলিয়ে এখন এই কলাম লেখা পর্যন্ত বিগত এক মাসে সাড়ে ৪ লাখ বর্মী মুসলমান বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এই সাড়ে ৪ লাখ মুসলমানের কেউই আর নিজ দেশ অর্থাৎ বার্মার রাখাইনে ফিরে যেতে চান না। তাদের প্রচণ্ড ভয়, ফিরে গেলেই তাদের ওপর শুরু হবে আবার নৃশংস নির্যাতন। শুরু হবে গণহত্যা, লুণ্ঠন, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং তাদের নারীদেরকে পাইকারী হারে ধর্ষণ। এসব বর্বরতা আর ঘটবে না, তারা নিরাপদে থাকবে, নাগরিকত্ব নিয়ে সম্মান নিয়ে তারা বসবাস করতে পারবে- একমাত্র এইরূপ গ্যারান্টি পেলেই তারা ফিরে যাবে। কিন্তু সেই গ্যারান্টি দেয়া তো দূরের কথা সুচি তার বিগত ভাষণে যা বলেছেন সেটি প্রকারান্তরে সংকট সমাধানের সমস্ত পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। যদিও তার ভাষণটি ছিল নরমে গরমে মেশানো, তবুও বর্মী সামরিক জান্তার মূল অবস্থান থেকে তিনি বিন্দুমাত্রও সরে আসেননি। বরং তিনি তার সেনাবাহিনীর নৃশংসতা সম্পর্কে একটি কথাও বলেননি। সেই কারণেই তিনটি বৃহৎ শক্তি অর্থাৎ রাশিয়া, চীন এবং ভারত ছাড়া সমগ্র বিশ্ব সম্প্রদায় তার ভাষণের নিন্দা করেছেন।

বিশ্ব সম্প্রদায় তার ভাষণের নিন্দা করলে কি হবে, জাতিসংঘ মহাসচিব তার প্রতি কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করলে কি হবে; রোহিঙ্গা সমস্যা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই থেকে গেল। সেই সাথে এই মহাসংকটের মধ্যদিয়ে প্রকট হয়ে ফুটে উঠেছে এই সরকারের সামগ্রিক কূটনৈতিক ব্যর্থতা। রাশিয়া, চীন এবং ভারত সরাসরি মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছে। আমেরিকা রোহিঙ্গা নির্যাতনের সমালোচনা করেছে এবং ত্রাণ সাহায্যও পাঠিয়েছে। কিন্তু এটি সমস্যার কোন স্থায়ী সমাধান নয়। কত দিন ধরে তাদেরকে আমরা আশ্রয় দেব? কত দিন ধরে আমরা তাদেরকে খাওয়াতে পারবো? এভাবে যদি কিছু দিন চলতে থাকে তাহলে তো তারা ধীরে ধীরে বাংলাদেশের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যাবে। ইস্যুটি ধীরে ধীরে যতই পুরাতন হবে ততই দেশের মানুষ এবং বিদেশীরা তাদের কথা ভুলে যাবে। অতীতে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে একমাত্র প্রেসিডেন্ট জিয়ার আমলে তাদের একটি অংশকে স্বদেশে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়েছে। অন্যরা রয়ে গেছে। বলা হচ্ছে, যারা রয়ে গেছে তাদের সংখ্যা ৪ লাখ। এবারও যদি সংকটের একটি গ্রহণযোগ্য এবং কার্যকর ফর্মূলা বেরিয়ে না আসে তাহলে এই সাড়ে ৪ লাখ থেকে যাবে। অর্থাৎ মোট সাড়ে ৮ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশের বাসিন্দা হয়ে যাবে। পত্র-পত্রিকার রিপোর্টে বলা হচ্ছে যে, রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গারা মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ। তাদের মোট সংখ্যা ১১ লাখ। এই ১১ লাখের মধ্যে সাড়ে ৮ লাখ এখন বাংলাদেশে রয়েছে। অবশিষ্ট আড়াই লাখ এখনো রাখাইন তথা মিয়ানমারে রয়ে গেছে।

॥ দুই ॥
এ সবকিছুর সারমর্ম এই দাঁড়ায় যে, বাংলাদেশের এই বর্তমান মহাসংকটে আমাদের পাশে কেউ দাঁড়ায়নি। যে ৫/৬টি মুসলিম দেশ আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে তারা এই সংকট সমাধানে খুব বড় একটা ম্যাটার করে না। যে চারটি বৃহৎ শক্তি রয়েছে তাদের মধ্যে তিনটি শক্তি অর্থাৎ রাশিয়া, চীন এবং ভারত বার্মার পক্ষে। আমেরিকার ভূমিকা ধরি মাছ না ছুঁই পানি। রোহিঙ্গা তথা মিয়ানমার ইস্যুতে এটিই হলো এখন আন্তর্জাতিক দৃশ্যপট। এই দৃশ্যপটের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির সম্পূর্ণ ব্যর্থতা। আজ বিশ্বসভায় বাংলাদেশ সম্পূর্ণ একা এবং একঘরে। যে ৫/৬টি মুসলিম দেশ সাহায্য সামগ্রী পাঠাচ্ছে তারাও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি সমর্থন করে বলে পাঠাচ্ছেন না; পাঠাচ্ছে এই বলে যে রোহিঙ্গারা মুসলমান। তাই মুসলিম ভ্রাতৃত্বের প্রতি সংহতি এবং সমর্থন প্রকাশের জন্যই তারা এই ত্রাণসামগ্রী পাঠাচ্ছে।

প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের এই বিদেশ নীতির সামগ্রিক ব্যর্থতা কেন? কারণটি অত্যন্ত পরিষ্কার এবং স্পষ্ট। সেটি হলো, বাংলাদেশের বিদেশ নীতি একটি মাত্র রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। সেই কেন্দ্রটি হলো নয়াদিল্লী তথা ভারত। এই একটি মাত্র রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা অর্থাৎ ভারতকেন্দ্রিক পররাষ্ট্রনীতি বাংলাদেশকে অবশিষ্ট বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। ভারতের ওপর শতকরা একশত ভাগ নির্ভর করা সত্ত্বেও জাতীয় দুর্যোগের সময় ভারত কিন্তু বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায়নি। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৭ সাল- এই নয় বছরে বাংলাদেশ ভারতকে অনেক কিছু দিয়েছে। ভারত যখন যা চেয়েছে বাংলাদেশ তখন তাই দিয়েছে। কিন্তু বিনিময়ে ভারত বাংলাদেশকে কিছুই দেয়নি। তার সর্বশেষ প্রমাণ হলো এই রোহিঙ্গা ইস্যু। রোহিঙ্গা ইস্যুটি বাংলাদেশের জন্য একটি মহাবিপর্যয়। রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া মিয়ানমারের জন্য মহাঅপরাধ। সারাবিশ্ব বলছে, বর্মী সামরিক জান্তা গণহত্যায় লিপ্ত হয়েছে। সেই গণহত্যাকেও সমর্থন করছে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নামাবলী পরিধানকারী ভারত। বৃটেন ওদের গণহত্যার প্রতিবাদে মিয়ানমারকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে বার্মায় অস্ত্র সরবরাহকারী হিসেবে বৃটেনের স্থান দখল করেছে ভারত। ভারতীয় অস্ত্র দিয়ে মগ সেনারা রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে গুলী করে হত্যা করছে। এইতো কয়েক দিন আগে নরেন্দ্র মোদি যখন মিয়ানমার সফরে যান তখন একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে সুচি এবং মোদি ঘোষণা করেন যে, কাশ্মীর এবং রোহিঙ্গা সমস্যা এক। এক অর্থে তারা দু’জন সঠিক কথাই বলেছেন। ভারতীয়রা কাশ্মীরে নিরস্ত্র কাশ্মীরি মুসলমানদেরকে গুলী করে হত্যা করছে। এ পার্যন্ত অবরুদ্ধ কাশ্মীরে ভারতীয় বিভিন্ন বাহিনীর গুলীতে ১ লক্ষ কাশ্মীরি মুসলমান শাহাদৎ বরণ করেছেন। অন্যদিকে মিয়ানমারেও চলছে রক্তের হোলিখেলা। মগবাহিনী এবং চরমপন্থী বৌদ্ধদের গুলীতে এ পর্যন্ত সাড়ে ৩ হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান শাহাদৎ বরণ করেছে। ২৫৪টি গ্রাম পুড়ে ভষ্মীভূত হয়েছে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ অভিমুখে পলায়নপর রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর হেলিকপ্টার গানশীপ থেকে গুলী করা হয়েছে। সর্বক্ষেত্রেই টার্গেট এক। তারা হলো অসহায় নিরস্ত্র মুসলমান।

॥তিন॥
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রদত্ত ভাষণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ৫ দফা প্রস্তাব পেশ করেছেন। এই ৫ দফার অন্যতম দফা হলো রোহিঙ্গাদের জন্য রাখাইনের অভ্যন্তরে একটি নিরাপদ অঞ্চল সৃষ্টি করা। এই নিরাপদ অঞ্চল সম্পর্কে আজ আমরা সুনির্দিষ্ট কোন মন্তব্য দেবো না। কারণ নিরাপদ অঞ্চল বলতে প্রধানমন্ত্রী কি বুঝিয়েছেন সেটি আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। পৃথিবীতে এই ধরনের কোন রাষ্ট্রের খবর আমাদের কাছে নাই যেখানে সেই রাষ্ট্রের একটি বিশেষ নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর জন্য আলাদা অঞ্চল সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। পৃথিবীতে একটি মাত্র রাষ্ট্র গঠন করে দেয়া হয়েছে। এই ধর্মীয় সম্প্রদায় হলো ইহুদী এবং তাদের জন্য যে আলাদা রাষ্ট্র বানানো হয়েছে সেটির নাম ইসরাইল। ইসরাইল রাষ্ট্রের সজ্ঞার সাথে শেখ হাসিনার নিরাপদ অঞ্চলের ধারণা মেলে না। ইসরাইল একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। তার একটি ভূখ- রয়েছে, একটি সরকার রয়েছে, সেনাবাহিনী রয়েছে এবং জাতীয় পতাকা রয়েছে। রোহিঙ্গাদের নিরাপদ অঞ্চল কি সে রকম হবে? তারা কি মিয়ানমারের নাগরিক হবেন? যদি তারা মিয়ানমারের নাগরিক হন তাহলে সারা মিয়ানমারে তাদের চলাচলের অধিকার থাকে। দুইশত বছর ধরে তারা সাবেক আরাকান এবং বর্তমান রাখাইন প্রদেশ এবং সেই সুবাদে বার্মা মিয়ানমারের অধিবাসী। তাহলে তারা রাখাইনের একটি অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবেন কেন? এক সময় ইহুদীরা ছিল স্টেটলেস বা রাষ্ট্রবিহীন। এখন তারা একটি রাষ্ট্র পেয়েছে। রোহিঙ্গাদের বিষয়টি উল্টো। শত শত বছর ধরে তাদের রাষ্ট্র ছিল। এখন তারা স্টেটলেস বা রাষ্ট্রবিহীন। সুতরাং সর্বাগ্রে যেটি প্রয়োজন সেটি হলো তাদেরকে নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়া এবং সম্মান ও নিরাপত্তার সাথে মিয়ানমারে প্রতিষ্ঠা করা।

http://www.dailysangram.com/post/300844