২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৮:২৩

৭ কলেজের শিক্ষার্থীদের জটিলতা কাটেনি

চার বছরের স্নাতক শেষ করতে লাগে ৬ বছর। শিক্ষার মান তলানিতে। সেশনজট কমাতে ও শিক্ষার মান বৃদ্ধি করতে সরকারি কলেজগুলোকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলাদা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। এরপর প্রথম ধাপে রাজধানীর সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি করা হয়। এ অবস্থায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া সাত
কলেজের শিক্ষার্থীরা পড়েছে নতুন সংকটে। আটকে গেছে বিভিন্ন বর্ষের পরীক্ষা, ফল প্রকাশ। একই ব্যাচের ফল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশ করলেও পরীক্ষাই নিতে পারেনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পরীক্ষা দিয়েও সাত মাসে ফল পায়নি কয়েকটি ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। মৌখিক ও ব্যবহারিক পরীক্ষা না হওয়ায় দুটি ব্যাচের ফল আটকে আছে ৮ মাস ধরে। অন্যান্য ব্যাচের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে পরীক্ষার টেবিলে বসলেও কবে নাগাদ সেই পরীক্ষার ফল প্রকাশ হবে তা নিয়ে শঙ্কায় শিক্ষার্থীরা। নানা জটিলতার শিক্ষাজীবন নিয়ে নতুন শঙ্কায় পড়েছে ২ লাখ শিক্ষার্থী।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট কাটাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে নতুন সেশনজটে পড়েছি। একই ব্যাচে ভর্তি হয়ে সহপাঠীরা বিসিএসসহ বিভিন্ন চাকরি পরীক্ষায় অংশ নিলেও শুধু ফল প্রকাশের জন্য কোনো চাকরিতে আবেদন করতে পারছি না। ২০১১-২০১২ সেশনের চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা গত ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষা চলাকালে সাত কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের অধিভুক্ত হয়। এতে ফল প্রকাশের দায়িত্ব পড়ে ঢাবির ওপর। আট মাস পরও ফল প্রকাশ করতে পারেনি ঢাবি কর্তৃপক্ষ। দ্রুত ফল প্রকাশের দাবিতে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়ে অনশন করেছে। এ নিয়ে ঢাবির নতুন ভিসির কাছে যাওয়ার পর সন্তোষজনক কিছু জানাতে পারেনি। ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী শারমিন শীল বলেন, গত বছর নভেম্বর মাসে ১ম বর্ষের পরীক্ষা দিলেও আজ পর্যন্ত ফল প্রকাশ হয়নি। লিখিত পরীক্ষা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিলেও ব্যবহারিক পরীক্ষা নিবে ঢাবি। সেই পরীক্ষা নিচ্ছে না ফলও প্রকাশ হচ্ছে না। এদিকে আমার দ্বিতীয় বর্ষের সব কার্যক্রম শেষ। কিন্তু প্রথম বর্ষের রেজাল্টের কারণে দ্বিতীয়বর্ষের পরীক্ষায় বসতে পারছি না।

বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী কানিজ সুলায়মান বলেন, একই সঙ্গে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা দিয়েছি, তারা তিন মাস আগে ফল পেলেও আমাদের কোনো খবর নেই। তারা ৩৮তম বিসিএস থেকে শুরু করে অন্যান্য অনেক নিয়োগ পরীক্ষায় আবেদন করলেও আমরা সেটি পারছি না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনীহার কারণে আমরা হাজার হাজার শিক্ষার্থী আজ ক্ষতিগ্রস্ত। শিক্ষার্থীদের দাবি, দ্রুত ফল না পেলে আমরা ফের কঠোর আন্দোলনে যাবো। সরকারি তিতুমীর কলেজের ছাত্র মো. রাব্বী বলেন, এক আন্দোলন করে পরীক্ষা দিচ্ছি, আরেক আন্দোলন করে রেজাল্ট বের করতে হবে বলে মনে হচ্ছে।

এ ব্যাপারে কবি নজরুল সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর আই কে সেলিম উল্লাহ খন্দকার বলেন, গত ১২ই সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির সঙ্গে বৈঠক করেছি। সেখানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এখনও সম্পূর্ণ তথ্য না পাওয়ায় কয়েকটি বর্ষের কাজ করা যাচ্ছে না। এজন্য ফল প্রকাশে বিলম্ব হচ্ছে। চর্তুথ বর্ষের ফল শিগগিরিই প্রকাশ করা হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি। সনদের ব্যাপারে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের সাময়িক সনদ দেয়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলেছে, অনুমোদন দিলেই সাত কলেজ সনদ দেয়া শুরু করবে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, মে মাসে ২০১৫ সালের স্নাতক (সম্মান) শেষ বর্ষের ফল প্রকাশ করা হয়েছে। ওই ফলাফল অনুযায়ী এক লাখ ১৯ হাজার ৩২৭ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৯৮ হাজার ১২৪ জন উত্তীর্ণ হয়েছেন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হওয়া সাত কলেজ শিক্ষার্থীদের ফল এদিন প্রকাশিত হয়নি। ৪র্থ বর্ষে প্রায় ১৫ হাজার ফলাফল পেতে কমপক্ষে আরো এক বছর অপেক্ষা করতে হবে। যার মধ্যে আট মাস পেরিয়ে গেছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ওদের লিখিত পরীক্ষায় নিলেও ব্যবহারিক এবং মৌখিক পরীক্ষা দিতে পারেননি।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায়, অনার্স (স্নাতক) প্রথম বর্ষের লিখিত পরীক্ষা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে হলেও ব্যবহারিক বাকি থাকে। যে কারণে ওই শিক্ষার্থীদের ফল প্রকাশ হয়নি। ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের নিয়মিত ও প্রাইভেট (নতুন সিলেবাস) এমএ, এমএসএস, এমবিএ, এমএসসি ও এম মিউজ শেষ পর্ব পরীক্ষার রুটিন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা করলেও এই সাত কলেজের রুটিন কবে হবে তা নিয়ে শিক্ষার্থীরা পুরোপুরি অন্ধকারে। ২০১৬ সালের ডিগ্রি পাস ও সার্টিফিকেট কোর্স পরীক্ষার সময়সূচিও ঘোষণা করেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু এই সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা এই পরীক্ষায় অংশ নিতে পারছে না। এ ছাড়া ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের মাস্টার্স শেষ পর্ব পরীক্ষা শেষ করে ফল প্রকাশের অপেক্ষায় সেখানে সাত কলেজ মাত্র রুটিন প্রকাশ করছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের অনেকে এক বা একাধিক বিষয়ে অনুত্তীর্ণ হয়ে পরের বর্ষে উত্তীর্ণ হয়েছেন। চূড়ান্ত বর্ষের পরীক্ষার আগেই পূর্বের বর্ষের অনুত্তীর্ণ বিষয়গুলোতে উত্তীর্ণ না হলে ফল স্থগিত থাকে। এ ধরনের শিক্ষার্থী যারা একাধিক বর্ষে বিভিন্ন বিষয়ে অনুত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা কোথায় এবং কোন সিলেবাসে পরীক্ষা দেবেন তা নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে সহসাই এসব শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানও সম্ভব নয়। এদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিভিন্ন কলেজে স্নাতক ভর্তি প্রক্রিয়া চলছে। এতদিন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এই সাত কলেজে মেধার ভিত্তিতে ভর্তি করলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি করবেন তাও রয়েছে অজানা। এ ছাড়া বিভিন্ন বর্ষের একাধিক শিক্ষার্থী জানায়, তারা এখনো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস পড়ছে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধীনে অনুষ্ঠেয় পরীক্ষাগুলো একদম নতুন সিলেবাসে হচ্ছে। পরীক্ষা দিতে সমস্যা হচ্ছে। তাই সব মিলিয়েই জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। গত ১৬ই ফেব্রুয়ারি রাজধানীর সাতটি সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। এগুলো হচ্ছে- ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ। এসব কলেজের প্রায় দুই লাখ শিক্ষার্থী বিভিন্ন বর্ষের পরীক্ষার তারিখ, সিলেবাস বা পাঠ্যক্রমের দাবিতে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। পুলিশের টিয়ারশেল নিক্ষেপে সিদ্দিকুর রহমান নামে তিতুমীর কলেজের এক শিক্ষার্থী চোখ হারিয়েছে।

ঢাবি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, অধিভুক্ত এসব শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেয়া, খাতা দেখা, ফলাফল প্রকাশ, রেজিস্ট্রেশন, ভর্তি, ফরম পূরণ, একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তাদের বড় ধরনের জনবল দরকার। কিন্তু এই আয়োজন এখনো শুরুই করতে পারেনি তারা। ২০১৪ সালের ৩১শে আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ সরকারি কলেজগুলোকে সংশ্লিষ্ট এলাকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেয়ার নির্দেশ দেন।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=84244