২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৮:২২

চাল নয়, সংকট মনিটরিংয়ে

চলতি সপ্তাহে স্পষ্ট হবে বাজার

বেসরকারিভাবে ২৫ লাখ টন চাল আমদানির প্রক্রিয়া চলছে। এরই মধ্যে ১০ লাখ টন স্থল, নদী ও সমুদ্রবন্দর দিয়ে দেশে ঢুকেছে। বাকি চাল দেশে ঢোকার অপেক্ষায় রয়েছে। আর দেশে ১৭ হাজার হাস্কিং মিল ও ৩ শতাধিক অটো রাইস মিল মজুদ থেকে চাল সরবরাহ করতে পারবে আরও চার মাস। তা ফুরানোর আগেই নভেম্বর-ডিসেম্বরে প্রায় সোয়া কোটি টন আমনের ফলন যোগ হবে। সব মিলিয়ে দেশের কোথাও চালের কোনো সংকট নেই। টাকা নিয়ে বাজারে গেলেই কেনা যাচ্ছে চাহিদামতো। কিন্তু দাম রাখা হচ্ছে বেশি। এর পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংকট চালে নয়, মনিটরিংয়ে। স্থানীয়ভাবে জোরালো মনিটরিং না থাকলে ভোক্তা এর সুফল পাবেন না।

সরকারও জিটুজি প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন দেশ থেকে চাল আমদানি করছে। পাশাপাশি স্থানীয়ভাবেও ব্যবসায়ী ও মিল মালিকদের কাছ থেকে নতুন করে ৫ লাখ টন চাল কিনতে যাচ্ছে। ২৬ সেপ্টেম্বর এর দরপত্র ঠিক করা হবে। এরও আগে সরকার আমদানি উন্মুক্ত করে দিয়ে চালের ২৮ শতাংশ শুল্কের মধ্যে ২৬ শতাংশই তুলে নেয়। নতুন সুবিধা হিসেবে সম্প্রতি যোগ করা হয় পাটের পরিবর্তে প্লাস্টিকের বস্তা ব্যবহার, রেলপথে চাল আমদানি এবং স্থলবন্দর দিয়ে চালবাহী ট্রাক দ্রুত খালাসের নিশ্চয়তা। বিনিময়ে তিন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর (বাণিজ্য, কৃষি ও খাদ্য) উপস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা ঘোষণা দেন- মিলগেটে চালের দাম ২-৩ টাকা কমানোর। তারা কমিয়েছেনও। আবার আমদানিকারকরা ৫ টাকা পর্যন্ত কমিয়েছেন দাম। কিন্তু চার দিন পার হয়ে গেলেও দাম কমার প্রভাব পড়েনি ভোক্তা পর্যায়ে। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চাল এখনও বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে। রাজধানীতে পাইকারি বাজারগুলোয় চালের দামে মিশ্র প্রবণতা দেখা গেছে। যারা কম দামে আমদানি চাল তুলেছেন তারা পাইকারি পর্যায়ে ৪২ টাকায় মোটা চাল বিক্রি করতে পারছেন। কিন্তু ওই চাল খুচরা পর্যায়ে গেলেও তার দামে পরিবর্তন হচ্ছে না। আগের মজুদ না ফুরানোর অজুহাত তুলে খুচরা ব্যবসায়ীরা এখনও মোটা চাল ৫২-৫৫ টাকাতেই বিক্রি করছেন। অথচ তা বিক্রি হওয়ার কথা সর্বোচ্চ ৪৬ টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে মিলারদের কাছে মোটা চাল নেই। যা আছে সেগুলো মাঝারি মানের। এ চাল মিলাররা ৪৮-৫০ টাকায় বিক্রি করলেও ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ৫৭-৫৮ টাকা। আর মিনিকেটে মিলগেটে দাম কমানোর পরও তা ৬০ টাকার মধ্যেই ওঠানামা করছে। ভোক্তা পর্যায়ে এ চাল বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ৬৩-৬৭ টাকার মধ্যে।

এ বিষয়ে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, দেশে চালে কোনো সংকট নেই। সংকট সরকার ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে। যদি চালেই সংকট হতো, তাহলে বন্দরে এবং মিলগেটে ইতিমধ্যে চালের দাম কেজিতে ২-৫ টাকা কমত না। বুঝতে হবে, এখানে একটা কারসাজি হয়েছে।

ক্যাব সভাপতি আরও বলেন, দাম পাইকারি পর্যায়ে কমলে এর প্রভাব খুচরা বাজারেও পড়ার কথা। কিন্তু ভোক্তা বাজার থেকে এখনও সেই সুফল পাচ্ছেন না। এখানেও সেই একই ঘাটতি। প্রথমত, সুযোগ পেলেই ব্যবসায়ীদের লাগাতার মুনাফার মানসিকতা এবং দ্বিতীয়ত, সেটা বন্ধে বাজারগুলোয় সরকারি মনিটরিং পর্যাপ্ত, নিয়মিত ও জোরদার না হওয়া। তিনি বলেন, ভোক্তা পর্যায়ে দাম কমার সুফল পৌঁছাতে হলে মনিটরিংয়ে জোর দেয়ার পাশাপাশি বাজারে পণ্যের তালিকা ও দাম প্রদর্শন নিশ্চিত এবং ক্রয়-বিক্রয়ে ক্যাশ মেমো যাচাই-বাছাই করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কেউ অতিরিক্ত মুনাফা করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে নওগাঁ জেলা ধান-চাল আড়তদার সমিতির সভাপতি নিরোধ চন্দ্র সাহা যুগান্তরকে বলেন, ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভীতি ঢুকে গেছে। ধরপাকড়ের ভয়ে চাল না ফুরালে নতুন করে আর চাল কিনতে চাইছে না। এ কারণে মিলগুলোতে বেচাবিক্রিও হচ্ছে না। তবে পাইকার ও খুচরা বিক্রেতাদের মজুদেরও একটা সীমাবদ্ধতা আছে। আশা করছি, তারা সোম-মঙ্গলবারের মধ্যেই আবার মোকামমুখী হবেন। এর প্রভাব পড়বে ভোক্তা পর্যায়ে। এর জন্য চলতি সপ্তাহটা অপেক্ষা করতে হবে। নিরোধ চন্দ্র বলেন, তবে দাম ভোক্তা পর্যায়ে কতটা পড়বে সেটা নির্ভর করবে খুচরা বিক্রেতাদের মানসিকতার ওপর। এর জন্য স্থানীয়ভাবে বাজার নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। একই সঙ্গে ব্যবসায়ীদের মধ্যে যে ভীতি তৈরি হয়েছে তা দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। এ ব্যবসায়ীর দাবি, পাইকারি পর্যায়ে মোটা ৪০ ও সরু চাল ৫৮ টাকার নিচে নামার সুযোগ নেই।

মিলারদের দাবি, সারা দেশে ১৭ হাজার হাস্কিং মিল রয়েছে। এদের যে উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে প্রতিদিন উৎপাদনে গেলে তাদের ধানের মজুদ শেষ হতে বড়জোর এক মাস লাগবে। একইভাবে অটো রাইস মিলেরও যে মজুদ তা ফুরাতে লাগবে চার মাস। এ সময়ে আমনের ফলন ওঠার কথা থাকলেও কী পরিমাণ ফলন পাওয়া যাবে সেটা নিয়ে সংশয় আছে। তারা বলছেন, সরকারের পরিসংখ্যানে আস্থা নেই। কৃষি মন্ত্রণালয় ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবও ভুয়া। তাই আমনের ফলন সোয়া কোটি টন দাবি করা হলেও সেটা কতটা বাস্তবভিত্তিক তা প্রশ্নসাপেক্ষ।

বাংলাদেশ রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি এবং চাল আমদানিকারক কাওসার আলম খান যুগান্তরকে বলেন, নভেম্বরে ধান উঠলেও বোরো মৌসুমের বড় ফলন পেতে আরও ৮ মাস অপেক্ষা করতে হবে। তার আগে পরিস্থিতি স্থিতিশীল হওয়ার সম্ভাবনা কম। তিনি আরও বলেন, মিলারদের হাতে যে চাল আছে তার বেশিরভাগই মাঝারি ও সরু। মোটা চাল নেই বললেই চলে। আর এ কারণেই মোটা চালের ঘাটতি আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হচ্ছে। এক প্রশ্নে কাওসার আলম বলেন, এ মুহূর্তে দেশে চালের কোনো সংকট নেই। মিলেও চাল আছে। প্রতিদিন প্রচুর আমদানিও হচ্ছে। আরও ইতিবাচক খবর হচ্ছে, ভারতীয় বাজারেও দাম কিছুটা কমে এসেছে। বন্দরেই মোটা চালের দাম কমেছে কেজিতে ৫ টাকা।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক শফিকুল ইসলাম লস্কর যুগান্তরকে বলেন, শুধু চাল নয়, সব পণ্যের দামই ভোক্তা পর্যায়ে যাতে সহনীয় থাকে। দাম কমার সুফল যাতে ভোক্তা সরাসরি ভোগ করতে পারেন তার জন্য অধিদফতর নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছে। দাম বেশি রাখলে কিংবা ওজনে কম দিলে অথবা ভোক্তার যে কোনো অভিযোগেরও তদন্ত করছে অধিদফতর। এতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে।

https://www.jugantor.com/first-page/2017/09/23/157724