২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৮:১৯

আলু নিয়ে বিপাকে লাখ লাখ কৃষক

আলু চাষে নিরুৎসাহিত হওয়ার আশঙ্কা ; হিমাগারে নষ্ট হচ্ছে বিশ হাজার কোটি টাকার আলু

প্রতি একর জমিতে চাল উৎপাদন হয় ২০ থেকে ২৫ মণ। অন্য দিকে একই জমিতে তুলনামূলক কম খরচে আলু উৎপন্ন হয় ২৫০ থেকে ৩০০ মণ। দেশের সব চাষযোগ্য জমিতে তিন মওসুমে তিনবার ধান চাষ করে চাল পাওয়া যায় তিন কোটি টনের মতো। অন্য দিকে মাত্র ১০ শতাংশ জমিতে বছরে মাত্র একবার চাষ করে আলু পাওয়া যায় এক কোটি টন। ভাতে অনেক রোগ-বালাই লুকিয়ে থাকলেও আলু কেবল খেতেই সুস্বাদু নয়, পুষ্টিগুণের দিক থেকেও এর জুড়ি মেলা ভার। অথচ দেশে চালের জন্য হাহাকার চললেও ৪০ লাখ টন অবিক্রীত আলু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন লাখ লাখ কৃষক। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকারিভাবে আলু কিনে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি এবং বন্যাদুর্গত ও রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় ত্রাণ হিসেবে বিতরণ করার আহবান জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।

বিভিন্ন পর্যায়ের আলুচাষি এবং হিমাগারমালিকের সাথে কথা বলে জানা যায়, দেশে এ বছর আলু উৎপাদিত হয়েছে এক কোটি টনের মতো। এর মধ্যে ৩৯০টি হিমাগারে সংরক্ষণ করা হয়েছে ৫৩ লাখ টন। মওসুমের বড় অংশ চলে গেলেও এখন পর্যন্ত সংরক্ষিত আলুর প্রায় ৭০ শতাংশ অর্থাৎ ৩৭ লাখ টন আলু রয়ে গেছে কোল্ড স্টোরেজে। প্রতি বস্তা আলু উৎপাদন, বস্তাভর্তিকরণ, পরিবহন, লোডিং ও আনলোডিংসহ খরচ পড়েছে ১১০০ টাকা। সাথে যুক্ত হয়েছে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা হিমাগার ভাড়া। অর্থাৎ ১৪০০ টাকার আলু বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৮০০ টাকায়। প্রতি বস্তায় লোকসান হচ্ছে ৬০০ টাকা। অথচ এই দামেও ক্রেতা মিলছে না। এখনই উদ্যোগ নেয়া না হলে বছর শেষে ২০ থেকে ২৫ লাখ টন আলু পচে নষ্ট হবে বলে সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা।

আলু সঙ্কটের ভয়াবহতা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো: মোশাররফ হোসেন পুস্তি গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, আলুর সাথে কেবল দেশের ৫ কোটি প্রান্তিক চাষিই জড়িত নন, কয়েক লাখ আলু ব্যবসায়ী, হাজারখানেক কোল্ড স্টোরেজের মালিক, অর্ধশতাধিক ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ভাগ্যও এর সাথে জড়িত। এ বছর যারা আলু চাষ এবং সংরক্ষণ করে পুঁজিহারা হচ্ছেন, সামনের বছরগুলোয় তারা আলু চাষে উৎসাহিত হবেন না এটাই স্বাভাবিক। আলুকে ভাতের বিকল্প আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, সারা দেশে চালের জন্য হাহাকার চলছে অথচ আলু খেতে উৎসাহিতকরণের কোনো কর্মসূচি নেই। সরকারের কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি, খোলাবাজারে বিক্রয় (ওএমএস) কর্মসূচি, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যাদুর্গতদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ কর্মসূচি এবং রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিতরণের জন্য চালের মতো সরকারিভাবে আলু কেনার আহবান জানান তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. আ ব ম ফারুক নয়া দিগন্তকে বলেন, আলুতে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ পানি। ফলে প্রতিদিন আলু খেলে শরীরে পানির ঘাটতি পূরণ হয়। পাশাপাশি প্রচুর আয়রন, ফসফরাস, ক্যালসিয়াম ও পটাশিয়াম রয়েছে আলুতে। প্রতি ১০০ গ্রাম আলুতে ১৭ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি থাকে। সেই সাথে থাকে ভিটামিন এ এবং বি। শরীরের পানি ও কার্বোহাইড্রেটের ঘাটতি পূরণ করার জন্য তাই নিয়মিত আলু খাওয়া প্রয়োজন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, অল্প সময়ে অধিক উৎপাদন হয় বলে আলু চাষে লাভ অপেক্ষাকৃত বেশি। প্রতি একর জমিতে যেখানে মাত্র ২০ থেকে ২৫ মণ চাল উৎপন্ন হয় সেখানে আলু উৎপন্ন হয় ২৫০ থেকে ৩০০ মণ। ফলে কয়েক বছর ধরে কৃষকেরা অধিক হারে আলু উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছেন। আবহাওয়া ভালো থাকায় উৎপাদনও হচ্ছে বেশ। এক সময় কেবল মুন্সীগঞ্জ এলাকায় আলুর বাম্পার উৎপাদনের কথা প্রচার থাকলেও বর্তমানে রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, ময়মনসিংহসহ দেশের প্রায় প্রতিটি এলাকায় আলুর উৎপাদন বেড়েছে। ২০১৬ সালে দেশে আলু উৎপাদিত হয়েছিল ৮০ লাখ টন। এ উৎপাদন চলতি বছর এক কোটি ছাড়িয়ে গেছে। অথচ আলুর চাহিদা ও ব্যবহার মোটেই বাড়েনি।

ওয়ার্ল্ড পটেটো কাউন্সিলের হিসেব অনুযায়ী, আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বে সপ্তম এবং এশিয়ায় তৃতীয়। তবে রফতানির দিক থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে। চলতি বছরের প্রথম আট মাসে দেশ থেকে আলু রফতানি হয়েছে মাত্র ৫০ হাজার মেট্রিক টন। রফতানিকারকদের কাছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবহন না থাকায় আলু রফতানি অলাভজনক এবং ঝুঁকিপূর্ণ। পচনশীল পণ্য হওয়ায় উৎপাদন মওসুমে আলুর উপযুক্ত দাম পাওয়া যায় না। কোল্ড স্টোরেজে আলু রাখতেও খরচ হয় তুলনামূলক বেশি। কিন্তু ভাতের বিকল্প হিসেবে আলুর ব্যবহারে দেশবাসীকে অভ্যস্ত করে তুলতে ব্যর্থতার কারণে আলুর উৎপাদন বাড়লেও আলুচাষিদের ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না।

চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, আলু খুব সহজে হজম হয়। সেই সাথে হজমপ্রক্রিয়ার উন্নতিতেও সাহায্য করে। যারা একদম রোগা, তারা নিয়মিত আলু খেতে পারেন। আলুতে থাকা ফাইবার কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে। আলু শরীরে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়। ফলে হার্টের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে। আলুতে রয়েছে ভিটামিন সি, যা টিস্যুর যতেœ দারুণ কাজ দেয়। এ ছাড়াও আলুতে থাকা পটাশিয়াম এবং ভিটামিন বি৬ শরীরের ভেতরের প্রদাহজনিত সমস্যা দূর করে। গবেষণা বলছে, লাল আলুতে প্রচুর পরিমাণে ফ্ল্যাভোনয়েড নামক অ্যান্টি অক্সিডেন্ট থাকে। পাশাপাশি ভিটামিন এ তো রয়েছেই। এই উপাদান দু’টি অনেক ধরনের ক্যান্সারের হাত থেকে রক্ষা করে। আলুতে থাকা কুয়েরসেটিন নামক এক ধরনের উপাদান ক্যান্সার এবং টিউমার রোধে সাহায্য করে। প্রতিদিন আলু খেলে ত্বক ভালো থাকে। যারা মাঝে মধ্যেই মুখের ঘায়ে ভুগে থাকেন, তারা নিয়মিত আলু খেতে পারেন।

কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি এবং ত্রাণ হিসেবে আলু বিতরণের অনুরোধ করে ইতোমধ্যে অর্থ, বাণিজ্য, কৃষি, খাদ্য, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিবকে সমিতির পক্ষ থেকে পত্র দেয়া হয়েছে জানিয়ে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আরো বলেন, ত্রাণকার্যে আলু বিতরণ করা হলে হিমাগারগুলোয় সংরক্ষিত আলু সময়মতো খালাস করা সম্ভব হবে। এতে আলুচাষিরা উপকৃত হবেন এবং হিমাগার মালিকরাও ব্যাংকঋণ পরিশোধে সমর্থ হবেন। অন্যথায় পরবর্তী বছর আলুর উৎপাদন হ্রাস পাবে। তিনি বলেন, আমাদের মনে রাখতে হবে, আলুই দেশের ভবিষ্যৎ খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম। আলু খেলে কৃষক বাঁচবে, কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে। কাজেই আমাদের সাধারণ জনগণের মধ্যে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনসহ বিদেশে আলু রফতানির উদ্যোগ গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/253964