২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৮:১৮

২০১২ সাল থেকে রোহিঙ্গা সন্তানদের লেখাপড়া বন্ধ

ধর্ম পালন নিষিদ্ধ

স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার সুযোগ নেই রোহিঙ্গাদের। মগা স্কুলে লেখাপড়া করলে চার ক্লাসের বেশি পড়তে পারে না তারা। এরপর তাদের স্কুল থেকে চলে যেতে হয়। সাধারণত রোহিঙ্গা মুসলমানদের সন্তানরা মাদরাসায় লেখাপড়া করত। একমাত্র কওমি মাদরাসাই হচ্ছে মুসলমানদের মূল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ২০১২ সালের অক্টোবর মাসের পর সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ করে দেয়া হয়। বেশির ভাগ এলাকায় মুসলমানেরা মসজিদে গিয়ে নামাজও আদায় করতে পারতেন না। ঘরে বসেই তাদের ধর্মকর্ম সারতে হতো।

২০১২ সাল থেকে রোহিঙ্গা শিশুদের লেখাপড়া বন্ধ। কিছু কিছু এলাকার মসজিদ, মাদরাসা ’১২ সাল থেকে তালাবদ্ধ। ওখানে লেখাপাড়া বা ধর্মীয় কোনো কাজ নিষিদ্ধ। বর্মি সেনাবাহিনী তালা মেরে দিয়েছে। আর তার পাহারার দায়িত্ব দিয়েছে নাডালা বাহিনীকে। মিয়ানমারের বিভিন্ন এলাকা থেকে আশ্রয় নিতে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীরা এসব তথ্য জানিয়েছেন। মংডুর তমব্রু এলাকার বাসিন্দা হাফেজ সৈয়দ হোসেন। স্থানীয় একটি মাদরাসার শিক্ষক ছিলেন তিনি। একটি মসজিদে ইমামতি করতেন। বর্মি বাহিনী ও নাডালা বাহিনীর অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তারা বাংলাদেশে এসেছেন। গত ১২ সেপ্টেম্বর নাইক্ষ্যংছরির চাকঢালার বরশনখোলা সীমান্তে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে কথা হয় সৈয়দ হোসেনের সাথে। সৈয়দ হোসেন বলেন, ২০১২ সালে তাদের ওপর যে নির্যাতন হয় ওই নির্যাতনের পর থেকেই তার এলাকায় মসজিদে তালা লাগিয়ে দেয়া হয়। ২০১২ সালের ৯ অক্টোবরের পর আর কোনো দিন জামাতে নামাজ আদায় করতে পারেননি তারা। ওই সময়ও মসজিদগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল। সৈয়দ হোসেন বলেন, ওই সময়ের পর থেকে এলাকার রোহিঙ্গা মুসলিম ছেলেমেয়েদের লেখাপড়াও বন্ধ। রোহিঙ্গা শিশুরা যেটুকু লেখাপড়া করে তা নিজ নিজ ঘরে বসে। এক পাড়া থেকে অন্য পাড়া বা এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে গিয়ে লেখাপড়ারও সুযোগ নেই রোহিঙ্গা শিশুদের। যে পাড়ার লোক সে পাড়া ছেড়ে অন্য পাড়ায় গেলেও তাদের ওপর নির্যাতন হতো। নাডালা বাহিনীর সদস্যরা প্রতি পাড়ার দিকে নজর রাখতো। যদি কেউ অন্য পাড়ায়ও যেত তাহলেও সেই তথ্য চলে যেত সেনাবাহিনীর কাছে। সে তথ্য অনুযায়ী নির্যাতন চালানো হতো। হাফেজ সৈয়দ হোসেন বলেন, তাদের দাড়ি রাখা ও টুপি পরিধান করাও নিষিদ্ধ। এই অবস্থায় কাউকে পেলে তার ওপর চরম নির্যাতন চলত। ফলে বেশির ভাগ মুসলমান দাড়ি রাখতো না এবং টুপিও পরিধান করত না। মংডুর তৈজ্যং এলাকার হাফেজ আহম্মেদও ওই একই কথা বলেন। তিনিও আশ্রয় নিয়েছেন চাকঢালা বরশনখোলা ক্যাম্পে। তিনি বলেন, আগে মুসলমানরা মগা স্কুলের তিন-চার ক্লাস পর্যন্ত পড়তে পারত। কিন্তু ২০১২ সালের পর মুসলমানদের জন্য সেই সুযোগও বন্ধ হয়ে যায়। ২০১২ সাল থেকে স্কুল বা মাদরাসার লেখাপড়া কি তা জানে না রোহিঙ্গা শিশুরা। মংডুর পোড়া মাইজ্যা এলাকার বাসিন্দা আবু তাহের বলেছেন, কোনো কোনো রাস্তা এবং বাজারে ওঠাও মুসলমানদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। এই নিষেধাজ্ঞা কেউ অমান্য করলে তার ওপর চরম নির্যাতন নেমে আসতো।

মংডুর টংশু এলাকার বাসিন্দা ডাক্তার সৈয়দ আলম বলেন, তিনি একজন গ্রাম্যডাক্তার। রোহিঙ্গা মুসলমানেরা জটিল রোগে আক্রান্ত হলেও ওখানে তাদের চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। গ্রাম্যডাক্তার হিসেবে মুসলমানদের চিকিৎসা দিয়ে আসছেন সৈয়দ আলম। তিনি বলেন, কোনো রোহিঙ্গার চিকিৎসা নিতে হলে সেনাবাহিনীকে বড় অঙ্কের টাকা দিতে হতো। সেনাবাহিনীর কোনো কর্মকর্তার সুপারিশ ছাড়া কেউ চিকিৎসা নিতে পারেনি। তিনি বলেন, মুসলমানদের সন্তানরা যাতে শিক্ষার আলো না পায়, তারা যাতে অশিক্ষিত থাকে সেই পরিকল্পনা থেকেই তাদের শিক্ষা গ্রহণের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের একজন লোকও মিয়ানমারে সরকারি চাকরিজীবী নেই। এমনকি, একজন পিয়নও নেই। ব্যবসা-বাণিজ্য করারও কোনো সুযোগ নেই। পান দোকান দিতে গেলেও সেনাবাহিনীকে মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হয়।
মংডুর তৈজ্যংপাড়ার শহিদুল আলম বলেন, এভাবে অনেকবার তারা দেশ ছাড়া হয়েছেন। তাদের বাপ-দাদারাও দেশ ছাড়া হয়েছেন। আবার প্রতিবার ফিরে গেছেন। ওখানে তাদের জমিজমা আছে। কৃষিকাজ আছে। বাপ-দাদার ওইসব সম্পত্তি এখন মগদের দখলে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/253945