মিয়ানমারের রাখাইনে জ্বলছে রোহিঙ্গাদের একটি গ্রাম
২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৮:১৫

প্রতিদিনই জ্বলছে রোহিঙ্গাদের গ্রাম

সীমান্তে মুহুর্মুহু গুলির শব্দ

মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে দেশটির সেনাবাহিনীর বর্বরতা থামছেই না। গতকাল শুক্রবারও নাফ নদীর ওপারে মংডু এলাকার পাঁচটি গ্রামের রোহিঙ্গাদের বসতবাড়িতে আগুন দিয়েছে সেনাবাহিনী। এ সময় রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে মুহুর্মুহু গুলিও করেছে।

আরাকানে গত ২৪ আগস্ট (বৃহস্পতিবার) থেকে শুরু হওয়া মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বর্বরতা শুরু হয়। এক মাস ধরে প্রতিদিনই জ্বলছে রোহিঙ্গাদের গ্রাম। জীবন বাঁচাতে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছেন অসহায় রোহিঙ্গারা। বিশ্ব সম্প্রদায়ের উদ্বেগ ও নিন্দাকে তোয়াক্কা না করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণসহ নির্মম নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে।
সীমান্তের প্রত্যক্ষদর্শীর জানান, গতকাল শুক্রবার ও আগের দিন বৃহস্পতিবার দক্ষিণ মংডুর ফ’খালীর রোহিঙ্গা গ্রাম পুতিপাড়ায় অগ্নিসংযোগ করে সেনাবাহিনী। এতে পুড়ে ছাই হয়ে যায় রোহিঙ্গা বসতবাড়িগুলো। ঘটনাস্থল থেকে দুই কিলোমিটার দূরের চালিপ্রাং থেকে ভিডিও ধারণ ও ছবি করেন কয়েকজন রোহিঙ্গা যুবক।
উখিয়ার থ্যাংখালী সীমান্তের নাফ নদীর ওপারে কালো ধোঁয়া সীমান্তের এপার থেকে তাকালেই চোখে পড়ে। সীমান্ত থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা বসতবাড়িতে দেয়া আগুনের ধোঁয়া এটি। এ সময় উখিয়ার থ্যাংখালীর অস্থায়ী শরণার্থী শিবিরে অবস্থানরত রোহিঙ্গা নারী-পুরুষেরা নয়া দিগন্তকে জানান, গত বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিক থেকে ওখানে ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়। এই প্রতিবেদকসহ সীমান্তের অনেকেই এই ধোঁয়া দেখতে পান।
এ ছাড়া বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টার দিকে তুমব্রু সীমান্তে রোহিঙ্গাদের গ্রামে আবারো নতুন করে আগুন দেয় মিয়ানমারের সেনা ও রাখাইনদের সংগঠন নাডালা বাহিনী। আগুনের লেলিহান শিখা সীমান্তের এপার থেকেও দেখা গেছে। এ সময় সীমান্তের বাংলাদেশ অংশ থেকে গুলির শব্দ শোনা যায়। এতে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন সীমান্তবাসী।

এলাকাবাসী জানান, তুমব্রু সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার এলাকা থেকে ১০ রাউন্ড গুলির শব্দ পাওয়া গেছে। সেখানে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে আগুন দেয়ার দৃশ্যও দেখা গেছে। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে প্রায় ১০০ গজ দূরে এ ঘটনা ঘটে। ওই সীমান্তের নো ম্যানস ল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছেন হাজারও রোহিঙ্গা। এক মাস ধরে তারা সেখানে অবস্থান করছেন।
গত বৃহস্পতিবার মংডুর রোহিঙ্গা গ্রাম নয়াপাড়া, কাজিরবিল এবং রাবাইল্লা সেনা ও রাখাইনদের দেয়া আগুনে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গত বৃহস্পতিবার সকালে ১৫০ জনের মতো সশস্ত্র রাখাইন ও সেনা সদস্য গ্রামগুলোতে প্রবেশ করে। এ সময় রোহিঙ্গাশূন্য বাড়িগুলোতে তারা লুটপাট চালায়। এসব গ্রামের বেশির ভাগ রোহিঙ্গা সেনা তাণ্ডবের ভয়ে আগেই বাংলাদেশ চলে এসেছেন। যারা থেকে গিয়েছিলেন তাদের বেধড়ক মারধর ও ধাওয়া করে সৈন্যরা। ফলে তারা পাহাড়ে আশ্রয় নেন ও পরে বাংলাদেশে চলে আসেন। পালিয়ে আসা এসব রোহিঙ্গা জানান, হামলাকারীরা কাচের বোতলে পেট্রল ঢেলে তাতে আগুন দিয়ে রোহিঙ্গা বাড়ির চালে নিক্ষেপ করে। এতে অন্তত ৪৫০টি বাড়ি পুড়ে গেছে। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে ৯টি মসজিদ ও ৭টি মক্তব।
রোহিঙ্গাদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড
মিয়ানমারে সহিংসতার পর থেকে এ পর্যন্ত পাঁচ লাখেরও অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। সেনাবাহিনী ও রাখাইনদের হাতে নানাভাবে নির্যাতিত অনেক রোহিঙ্গা গুলিবিদ্ধ, কাটা জখমসহ নানা রোগে আক্রান্ত। উখিয়া-টেকনাফের এনজিও ও জাতিসঙ্ঘ নিয়ন্ত্রিত হাসপাতালগুলোতে জায়গা না হওয়ায় গুরুতর আহতরা ছুটছেন জেলা সদর হাসপাতালে। এসব রোগীর চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে সদর হাসপাতালে খোলা হয়েছে আলাদা রোহিঙ্গা সার্জারি ইউনিট।

কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার শাহীন আবদুর রহমান চৌধুরী জানান, বেশির ভাগই রোগী হামলার শিকার। তাদের সরকারিভাবে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তবে ২৫০ শয্যার এ হাসপাতালে রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা দিতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে বলে জানান এই চিকিৎসক।
মিয়ানমারের সহিংসতার পর থেকে এ পর্যন্ত সদর হাসপাতালে ২০০ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। এ ছাড়া উখিয়া, টেকনাফ ও জেলার কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীর সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। এদের বেশির ভাগই গুলিবিদ্ধ।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/253950