২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৮:১৩

দুঃসহ স্মৃতি তাড়া করছে ওদের

দুর্ভোগের কাল কেবলই দীর্ঘ হচ্ছে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের। এখন মিয়ানমারের রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে ঠিক কী ঘটছে, তা নিশ্চিত করে জানা যাচ্ছে না। তবে গতকাল শুক্রবারও দুপুর ১২টার দিকে টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সোজাসুজি নাফ নদের ওপারে মিয়ানমারের গ্রামগুলো থেকে আগুনের ধোঁয়া উঠতে দেখা গেছে। এ সময় সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা পালিয়ে আসা নুর মোহাম্মদ দাবি করেন, তার বাড়ি ওপারের গজবিল এলাকায়। আজও (শুক্রবার) তার গ্রামে সেনারা আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, উখিয়া আর টেকনাফ উপজেলা দুটি এখন পুরোপুরি পরিণত হয়েছে শরণার্থী পল্লীতে। ঢাকা থেকে চকরিয়া হয়ে উখিয়া সড়কে প্রবেশের পর থেকে পথের দু'ধারে কিছুক্ষণ পরপরই চোখে পড়বে দু-চারটি রোহিঙ্গা পরিবার। দুধের শিশু নিয়ে পাহাড়ের কোলে, পথের ধারে সারারাত ভালোভাবে ঘুমাতে না পারা হএই শরণার্থীরা কখনও আবার হাত পেতেও ত্রাণ শেষ হয়ে যাওয়ায় পায় না কোনো কিছুই।

আবার কখনও মেলে ধমক। ছোট-বড় যে কোনো যানবাহন থামা মাত্রই ত্রাণের আশায় ছুটে যাচ্ছেন অভুক্ত নারী, শিশু, যুবা ও বৃদ্ধ। কোনো কোনো ত্রাণবাহী গাড়ি ভালোভাবে না থামিয়েই তাদের দিকে ছুড়ে দেয় ত্রাণ। কেউ কেউ গাড়ি থেকে নেমে ওদের সঙ্গে 'সেলফি'ও তোলেনঙ্ঘ এমন নিষ্ঠুর বাস্তবতাও রয়েছে। শরীরে কাদামাটি মাখা না খাওয়া দুর্বল শরীরের ওপর লাঠিপেটার দৃশ্যও চোখে পড়েছে।
টানা কয়েকদিনের অনাহারে অথবা অর্ধাহারে হাড় জিরজিরে শীর্ণ চেহারা সবার। সবচেয়ে সঙ্গিন অবস্থা
অন্তঃসত্ত্বা নারীদের। দৌড়ে কাড়াকাড়ি করে অন্যদের সঙ্গে ত্রাণ আনতে পারছেন না তারা। মায়েদের পুষ্টিকর খাবার না পাওয়ায় দুগ্ধপোষ্য শিশুদের অবস্থাও সঙ্গিন। টিউবওয়েলের পানি বোতলে ভরে তাদের খাওয়াতে বাধ্য হচ্ছেন এসব মা। এমন দৃশ্য উখিয়া টেকনাফে এখন খুব সাধারণ।

গতকাল সকালে টেকনাফ উপজেলা সদরের প্রধান সড়কের দু'পাশে দেখা গেছে বহু ছিম্নমূল রোহিঙ্গা পরিবারের। স্থানীয় সিদ্দিক মার্কেটের দোতলায় আশ্রয় নিয়েছে কয়েকটি পরিবার। সেখানে সকালে গিয়ে দেখা যায়, একটি মাত্র বিস্কুট ভাগ করে খাচ্ছে দুই বোন আছিয়া আর আসমা। মিয়ানমারের মংডু এলাকায় তাদের ঘরবাড়ি সব আগুনে পুড়েছে। পোড়েনি কেবল তাদের ভালোবাসা আর মমতা। জীবনের চরম অসহায় অবস্থায়, এমন ঘোরতর দুর্দিনেও ভালোবাসাই যেন টিকিয়ে রেখেছে তাদের।
নিজ দেশের সরকারের চরম নিষ্ঠুরতার শিকার এই মানুষগুলো জানে না, কী তাদের অপরাধ। জন্মই হয়তো তাদের আজন্ম পাপ। প্রাণের মায়ায় দেশ ছেড়ে পালানো নিরীহ এই মানুষগুলোর হয়তো মিয়ানমার সরকারকে মহাশ্বেতা দেবীর উপন্যাসের ভাষায় বলতে ইচ্ছে করে, 'তুই যদি ভালো গোরমেন, তবে আমাদের এত কষ্ট ক্যান?' (তুমি যদি ভালো সরকারই হও, আমাদের তাহলে এত কষ্ট কেন?)। মহাশ্বেতা দেবী তার 'চোট্টি মুন্ডা এবং তার তীর' উপন্যাসে আদিবাসী সংগ্রামের মহান পুরুষ বিরসা বাওয়ার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন। শরীরে গুলির চিহ্ন আর অভুক্ত শরীরে রোহিঙ্গাদের যেন নীরব প্রশ্ন, কেন আজ মিয়ানমারের নাগরিক হয়েও তাদের স্বজন হারিয়ে পরদেশে পাড়ি জমাতে হয়েছে? দেশ, মাটি, সংসার, স্বজন ও সন্তান হারিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া সোয়া চার লাখ রোহিঙ্গার জীবনে রয়েছে সোয়া চার লাখ গল্প। সদ্য ফেলে আসা দুঃসহ স্ট্মৃতি তাড়া করে ফিরছে প্রতিটি রোহিঙ্গাকে।

টেকনাফের হোয়াইক্যং পুতিন পাহাড়ে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের বিভিম্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতিদিনের মতো গতকালও সাহায্য করতে দেখা গেছে। পাশাপাশি টেকনাফ ২ নম্বর বিজিবির পক্ষ থেকে প্রতিদিন আট হাজার রোহিঙ্গাদের মাঝে ভাত বিতরণ করা হচ্ছে বলে সমকালকে জানিয়েছেন অধিনায়ক লে. কর্নেল এসএম আরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, এ ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের দেখভাল করে যাচ্ছে বিজিবি। সেখানে যেন কোনো বিশৃগ্ধখলা সৃষ্টি না হয় এজন্য বিজিবি কাজ করে যাচ্ছে।

'বাবা আমাকে ছেড়ে যেও না' :মিয়ানমারের হাসসুরাতা এলাকা থেকে আসা মোহাম্মদ উল্লাহর চোখের জল আর কিছুতেই শুকাচ্ছে না। নিজের মনকে কিছুতেই প্রবোধ দিতে পারছেন না তিনি। ত্রাণ পেলেও কোনো খাবার খেতে পারেন না, ঘুমুতেও পারেন না। স্ত্রী দিলারা বেগমও তো পাগলের মতো আচরণ করছেন। টেকনাফের উন ছি প্রাং আশ্রয়কেন্দ্রে কথা হয় মোহাম্মদ উল্লাহর সঙ্গে। তিনি জানান তার নিষ্ঠুর জীবনের গল্প। মিয়ানমারের হাসসুরাতা এলাকায় দুই ছেলে ইমাম হোসেন (১২), নবী হোসেন (৯) ও স্ত্রী দিলারা বেগমকে নিয়ে সুখের সংসার ছিল তার। ব্যবসা করতেন তিনি। আরাকান স্যালভেজ আর্মির সদস্য সন্দেহে গত কোরবানি ঈদের পরদিন তার পাশের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় মিয়ানমারের পুলিশ ও সেনারা। তা দেখে ভয়ে তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাড়ির পেছন দিকে পালাতে চেষ্টা করেন। টের পেয়ে সেনা সদস্যরা তাদের ধাওয়া করে। এক পর্যায়ে তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এতে মোহাম্মদ উল্লাহর দুই ছেলেই গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। বড় ছেলে ইমামের পিঠ দিয়ে গুলি ঢুকে বুক দিয়ে বেরিয়ে যায়। চোখের সামনে সে ছটফট করতে থাকে। ছোট ছেলে নবীরও বাঁ হাতে গুলি লাগে। তিনি বুঝতে পারেন, বড় ছেলেকে আর বাঁচাতে পারবেন না। বাধ্য হয়ে তিনি স্ত্রী ও ছোট ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে দ্রুত পালাতে শুরু করেন। এ সময় গুলিবিদ্ধ ইমাম বার বার চিৎকার করে বলতে থাকে, 'বাবা আমাকে ছেড়ে যেও না।' অদূরে প্যারাবনে লুকিয়ে থাকেন তিনি, যেন আর্মিরা চলে গেলে বড় সন্তানকে উদ্ধার করে আনতে পারেন। তবে আর্মিরা এসে মোহাম্মদ উল্লাহর পরিবারকে খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে গুলিবিদ্ধ তার বড় সন্তানকে ছুরি চালিয়ে জবাই করে হত্যা করে। দূর থেকে এই অমানবিক দৃশ্য লুকিয়ে দেখেছেন তিনি আর তার স্ত্রী। এরপর থেকে তার স্ত্রী মানসিক ভারসাম্য প্রায় হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি নিজেও কানে বার বার ছেলের ওই চিৎকার শুনতে পাচ্ছেন। অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে মোহাম্মদ উল্লাহ বলেন, যদি জানতাম সারাজীবন এমন ডাক কানে বাজবে, তাহলে ছেলের আগেই আমি নিজেই জবাই হয়ে যেতাম।

মরতে চান জুলেখা বেগম :নিজের প্রাণ আর রাখতে চান না জুলেখা বেগম (৪৮)। এরই মধ্যে দু'বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন তিনি। স্থানীয়দের হস্তক্ষেপে রক্ষা পেয়েছেন। কেন তিনি আত্মহত্যা করতে চান জানতে চাইলে স্থানীয়রা জানায় জুলেখার গল্প। এমনকি এক পর্যায়ে তিনি নিজেও না বলে থাকতে পারলেন না তার জীবনের দুঃসহ গল্পটি। জুলেখার সঙ্গে আমাদের গতকাল কথা হয় টেকনাফের লম্বাবিল এলাকায়। মংডুর বালুখাল এলাকায় জুলেখার বাড়ি। স্বামীর নাম মোহাম্মদ রশীদ। এই দম্পতির তিন মেয়ে ও দুই ছেলে। গত ৪ আগস্ট দুপুরে মিয়ানমার পুলিশের সদস্য ও রাখাইন বৌদ্ধরা তাদের বাড়িটি ঘিরে ধরে। তিন মেয়ের মধ্যে দুই মেয়েকে ধরে নিয়ে যায় তারা। আর দুই ছেলে, এক মেয়ে ও তার স্বামীকে বাড়ির পুকুরপাড়ে নিয়ে গুলি করে পুলিশ সদস্যরা। তারপর সবার লাশ পুকুরে ফেলে দেয়। তিনি ছাড়া তার পরিবারের আর কেউ এ বেঁচে নেই। যে পুকুরে তার স্বামী শখ করে মাছ চাষ করতেন, সেখানেই তিনি ভাসতে দেখেছেন তার লাশ।

বাড়ির মুরগির ঘরের পেছনে লুকিয়ে প্রাণ রক্ষা করেন জুলেখা। পরে পাশের বাড়ি দুই ছেলে আবদুল্লাহ ও কাশেমের সঙ্গে সাগর পাড়ি দিয়ে গত বুধবার এখানে আসেন। স্বামী ও সন্তানদের হারিয়ে বেঁচে থাকার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন এ দুর্ভাগা নারী।
চোখের সামনে পরিবারের সবাইকে পুড়তে দেখেছেন আহম্মেদ : নিজ পরিবারের সবাইকে চোখের সামনে পুড়তে দেখেছেন সৈয়দ আহম্মেদ। তার বাড়ি মিয়ানমারের খিলাডংয়ের সাহাব বাজারে। আহম্মেদ জানান, সাহাব বাজারে তার দুটি বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোর আছে। তিনি স্থানীয়ভাবে ধনী মানুষ। দোকান বন্ধ করে ফিরতে তার প্রতিদিনই রাত হতো। পরিবারে রয়েছে স্ত্রী জাহানারা বেগম, দুই সন্তান লোকমান হাকিম ও সোনা মিয়া। গত ৩ সেপ্টেম্বর রাত ১১টার দিকে বাড়িতে তারা ঘুমিয়ে ছিল। এ সময় সৈয়দ আহম্মেদ বাড়িতে ফিরে দেখতে পান, বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর একটি দল ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। হতবিহ্বল আহম্মেদ সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পালিয়ে যান। দোকানে ফিরে ক্যাশবাক্স বের করে সব টাকা নিয়ে চলে আসেন। কিছুদিন পালিয়ে থাকার পর গত মঙ্গলবার সকালে নৌকা ভাড়া করে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে এসে আশ্রয় নেন। জুলেখা, মোহাম্মদ উল্লাহ আর আহম্মেদের মতো এমন গল্প লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর। নিয়তি যেন তাদের সবাইকে আজ এক সুতোয় বেঁধে দিয়েছে।

http://www.samakal.com/whole-country/article/17091406