২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৮:০৯

গণহত্যার দায়ে সু চি ও সেনাপ্রধান দোষী সাব্যস্ত

* গণহত্যা ও নির্যাতনের ২০০ সুস্পষ্ট প্রমাণ
* রাখাইনে আযান দেয়া ও নামায আদায়ের কেউ নেই
* দয়া করে সন্ত্রাসীদের মত আচরণ করবেন না
সংগ্রাম ডেস্ক : গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অং সান সু চি এবং দেশটির সেনাপ্রধানকে দোষী সাব্যস্ত করেছে মালয়েশিয়াভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণ-আদালত। গতকাল ২২ সেপ্টেম্বর শুক্রবার এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় পার্মানেন্ট পিপলস ট্রাইব্যুনাল (পিপিটি) নামের এই আন্তর্জাতিক গণআদালত। রোহিঙ্গা ও কাচিনদের ওপর চালানো গণহত্যা ও নিষ্ঠুর নিপীড়নের তদন্তে যুক্ত বিশিষ্টজন এবং খ্যাতনামা আইনজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত সদস্যের বিচারক প্যানেল এ রায় দেন। এক প্রতিবেদনে এ খবর জানিয়েছে মালয়েশিয়াভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য স্টার।
১৮ সেপ্টেম্বর কুয়ালালামপুরে এই বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। আর ২২ সেপ্টেম্বরের রায়ের মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো কোনও নোবেল বিজয়ী আন্তর্জাতিক গণআদালতে দোষী সাব্যস্ত হলেন। ইতোপূর্বে কোনও নোবেলজয়ীকে এমন বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি।

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশেষজ্ঞদের একটি প্যানেল বার্মিজ নেতাদের গণহত্যা বিষয়ক শুনানিতে অংশ নেয়। এতে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের লোকজন মিয়ানমারে তাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত জাতিগত নিধনযজ্ঞের বর্ণনা দেন। নিজেদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রযন্ত্রের অপরাধের বিবরণ তুলে ধরেন সংখ্যালঘু কাচিন সম্প্রদায়ের সদস্যরা। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ মাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনোসাইড স্ট্যাডিজ অ্যান্ড প্রিভেনশনের গবেষক অধ্যাপক গ্রেগরি স্ট্যানটনও জবানবন্দী দেন।
গণহত্যা ও নির্যাতনের অন্তত ২০০টি সুস্পষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে মিয়ানমার সরকারকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় ঘোষণা করা হয়। এছাড়া রায়ের আলোকে ১৭টি সুপারিশ করেন আদালত। এ রায় এবং সুপারিশগুলো জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে পাঠানো হবে।

গণআদালতের শুনানিতে অধ্যাপক গ্রেগরি স্ট্যানটন বলেন, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী, পুলিশ, বৌদ্ধ মিলিশিয়া এবং দেশটির বর্তমান বেসামরিক সরকার মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা চালিয়েছে। সেখানে রোহিঙ্গারা রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের শিকার। বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হকও শুনানিতে অংশ নেন।
প্রসিকিউশনের যুক্তিতর্ক, বিশেষজ্ঞ সাক্ষীদের মতামত, ভুক্তভোগীদের জবানবন্দী বিচার বিশ্লেষণ করে এ রায় দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পিপিটি মালয়েশিয়া শাখার সাংগঠনিক সভাপতি চন্দ্র মোজাফফর।
রাখাইনে মসজিদে আজান দেয়ার ও নামায় আদায়ের কেউ নেই!
মিয়ানমারের আরাকানে চলমান গণহত্যায় নারী ও শিশুদের পাশাপাশি সহস্রাধিক আলেম ওলামাকেও হত্যা করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন- প্রখ্যাত আলেম মাওলানা আহমদ হোছাইন (৯০)। এছাড়া পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে কয়েকশ’ মসজিদ-মাদরাসা ও অন্যান্য ধর্মীয় স্থাপনা। বিছিন্নভাবে কিছু মসজিদ টিকে থাকলেও সেগুলোতে আজান দেয়া ও নামায় আদায়ের কেউ নেই। জীবন বাঁচাতে সবাই পালিয়ে এসেছেন বাংলাদেশে।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধরা আরাকান থেকে ইসলাম ও মুসলমানদের নাম নিশানা মুছে দিতেই পরিকল্পিতভাবে মুসলমান রোহিঙ্গাদের গণহত্যা শুরু করেছে। রোহিঙ্গাদের নেতৃত্বশূন্য করতে বেছে বেছে হত্যা করা হয়েছে আলেম ওলামা ও পীর মশায়েখদের। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
উখিয়ার বালুখালী শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া হাফেজ আইয়ুব নামের একজন জানিয়েছেন, মিয়ানমারের সেনা ও উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা রোহিঙ্গাদের ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে, নারী, শিশু ও পুরুষদের হত্যা করে এবং যুবতীদের ধর্ষণ করেই থামছে না। তারা পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে আরাকানের ঐতিহ্যবাহী মসজিদ-মাদরাসা ও ধর্মীয় স্থাপনাগুলোও জ্বালিয়ে দিচ্ছে। এপর্যন্ত তারা দুই শতাধিক মসজিদ, অর্ধশত মাদরাসা ও অসংখ্য খানাকাহ পুড়িয়ে দিয়েছে।
কিছু আলেম-ওলামা সেনা-পুলিশ ও উগ্র বৌদ্ধদের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিতে পারলেও অধিকাংশ বয়স্ক আলেম-ওলামা ও পীর মশায়েখকে হত্যা করেছে তারা। এতে করে গত ২৪ আগস্ট থেকে আজান ও নামায বন্ধ হয়ে গেছে জনশূন্য আরাকানের বাকি মসজিদগুলোতে। আরাকানের ২০টি দাওরায়ে হাদিস (কামিল) মাদরাসার সাথে মাধ্যমিক স্তরের আরো ৩০টি মাদরাসা এখন বিরান।

সায়দুল্লাহর চর এলাকার বড় মাদরাসার মুহাদ্দিস প্রবীণ আলেমে দ্বীন মাওলানা আহমদ হোছাইনকে (৯০) বর্মী সেনারা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। তিনি ছিলেন ওই মাদরসার মুহাদ্দিস ও পরিচালক। গত ৬০ বছর ধরে তিনি হাদিসের দরস দিয়ে আসছিলেন।
গত ৩০ আগস্ট সেনা-পুলিশ ও মগদের একটি দল সায়দুল্লাহর চর এলাকা ঘেরাও করে ওই মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের কাউকে গুলী করে আবার কাউকে ধারালো ছুরি দিয়ে, দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। কেউ বা পাশের বনে জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে পরে বাংলাদেশে পালিয়ে চলে আসেন।
সবার শ্রদ্ধেয় আলেমে দ্বীন মাওলানা আহমদ হোছাইন কোথাও যেতে পারেননি। তিনি মাদরাসায় থেকে যান।
সেখান থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা প্রত্যক্ষদর্শীদের কয়েকজন জানান, তারা দূর থেকে দেখেছেন সেনা-পুলিশ ও মগরা তাকে প্রথমে গুলী করে হত্যা করতে চেয়ে ব্যর্থ হয়। পরপর কয়েকটি গুলী করলেও একটিও তার শরীরে না লাগায় তারা ক্ষেপে যায়। এরপর দা দিয়ে তাকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। পরে তার শরীরে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়ে হত্যা করে।
একইভাবে টেকিবনিয়ার কোয়াইংচিবং মাদরাসার শিক্ষক মাওলানা নুর আহম্মেদকে নামাযরত অবস্থায় হত্যা করা হয়েছে। তার পুরো পরিবারকের হত্যা করেছে সেনা ও উগ্রপন্থী মগরা।

মৌলভী ইউসুফ নামের পালিয়ে আসা একজন রোহিঙ্গা বলেন, কোনো আলেম ওলামাকে তারা জীবিত রাখেনি। কোনো কোন আলেমকে হাত-পা কেটে পুরো শরীর টুকরো টুকরো করা হয়েছে।
‘দয়া করে আমাদের সঙ্গে সন্ত্রাসীদের মতো আচরণ করবেন না’
পার্সটুডে : ভারতে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা বলছেন, তারা এখানে কোনো সমস্যা তৈরি করতে আসেন নি। দয়া করে তাদের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদীর মতো ব্যবহার করবেন না। ভারতের হায়দ্রাবাদে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থী সাইদুল্লা বাশার (২৭) কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশ্যে ওই আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘ কেউ উদ্বাস্তু হতে চান না। মিয়ানমার সরকার গণহত্যা চালাচ্ছে বলেই আমরা দেশ ছাড়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছি। সেখানকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমরা সেখানে ফিরে যেতে চাই।’
হায়দ্রাবাদে কমপক্ষে চার হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রয় শিবিরে বাস করছেন। এরমধ্যে প্রায় সাড়ে তিন হাজার জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের নথিভুক্ত। এদের মধ্যে কিছু রোহিঙ্গা এসেছিলেন ২০১২ সালে যখন মিয়ানমারে সহিংসতা সৃষ্টি হয়।
স্থানীয় হোটেলে কাজ করা ২০ বছরের এক যুবক বলেন, ‘আমরা গরীব মানুষ, আমরা এখানে যে কাজ পাই সেই কাজই করি। মিয়ানমারে সহিংসতার জন্য আমাদের পরিবারের কিছু সদস্য ও আত্মীয় আমাদের সঙ্গে নেই। কিছু বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে, কিছু ইন্দোনেশিয়ায় চলে গেছে, কিছু শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব ও দুবাইতে চলে গেছে।’
আব্দুল করিম নামে এক রোহিঙ্গা বলেন, ‘আমরা দেশে ফিরে যেতে চাই। যদি গোটা বিশ্ব আমাদের সমর্থন করে তাহলে আমরা মনে করি আমরা সেখানে ফিরে যেতে পারব। কাউকে যদি দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয় তাহলে তার হৃদয় চূর্ণ হবে না, তিনি কী কাঁদবেন না?’ প্রশ্ন আব্দুল করিমের।
ভারতে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা দেশের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় সরকার। বিদেশী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গেও তাদের যোগ রয়েছে বলে গোয়েন্দারা দাবি করেছেন। সেজন্য তাদেরকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু ওই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি জনস্বার্থ মামলা হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। মানবিকতার খাতিরে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো উচিত নয় বলে মনে করছে ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা।

http://www.dailysangram.com/post/300737