২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৮:০৮

রোহিঙ্গা নিধনের ইতিহাস : বার্মার অব্যাহত অপরাধ

মাওলানা এইচ এম গোলাম কিবরিয়া (রাকিব) : মিয়ানমারে মুসলিম জনসাধারণের উপর একযোগে গণহত্যা ও অবর্ণনীয় নির্যাতন চালাচ্ছে সেদেশের সেনাবাহিনী, সরকারের মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীগোষ্ঠী ও মুসলিমবিদ্বেষী উগ্রপন্থী হিংস্র বৌদ্ধরা। “অহিংসা পরম ধর্ম” এবং “জীব হত্যা মহাপাপ” প্রভৃতি বুলি মুখে আওড়িয়ে তারা নিরীহ মুসলমানদের উপর নির্বিচারে ইতিহাসের বর্বরতম জঘন্য হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে। বিশেষ করে মিয়ানমারে তারা রাখাইন রাজ্যে মুসলিম জনসাধারণকে তাদের বসতভিটা থেকে চিরতরে উৎখাত করতে চরম নির্যাতন ও ব্যাপক হত্যাকান্ড চালাচ্ছে।

দীর্ঘদিন ধরেই তারা রাখাইনের রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর অন্যায় অত্যাচার ও নৃশংসতা চালাচ্ছে। রাখাইন রাজ্যের মংডু ও আকিয়অরব এাকায় চালিয়েছে গণহত্যা ও লুটতরাজ। জ¦ালিয়ে দেয়া হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। মংডু এলাকার দক্ষিণ, নয়াপড়া, বমুপাড়া, মাঙ্গালাপাড়া, সম্মন্যাপাড়া রচমাইল, হাদির বিল ও ঝুড়ারপাড়া এবং আকিয়াবের নাজিরপাড়া, মৌলভীপাড়া, মং লেংপাড়া, বাহারছড়া ছাক্কিপাড়া, জালিয়াপাড়া, রোহাইঙ্গা ও ওয়ালিদপাড়া সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। মুসলিমদের মসজিদে, মাদ্রাসায় বা বিভিন্ন বাড়িতে একত্র করে তারা আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। কোন মুসলি জীবন বাঁচাতে বেরিয়ে আসলে তাকে কারফিউ ভঙ্গের অজুহাতে গুলি করে হত্যা করেছে।

এদের মূল উদ্দেশ্য, বার্মার ভূ-খণ্ড থেকে মুসলিম জাতিকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করা। এজন্য তারা সেখানে পরিকল্পিতভাবে মুসলিম নিধন চালাচ্ছে। মুসলিমদের সমূলে ধ্বংস করতেই বার্মার বিতাড়িত মুসলিমরা যখন প্রাণ নিয়ে ট্রলারে করে অন্যত্র আশ্রয় নিতে প্রয়াসী হন, তখন জালেম নাসাকা বাহিনী অনেক মুসলিমকে সাগরে ডুবিয়ে দেয়। আবার অনেক ট্রলারকে কোথাও ভিড়তে বাধা দেয়। যার কারণে খাবার পানিয়ের অভাবে মারা যায়। আবার অনেককে নৌকাতেই সরাসরি গুলি করে হত্যা করে।
বস্তুত মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিম নিধনে বৌদ্ধদের এই ষড়যন্ত্র কয়েক শতাব্দি ধরে চলা হিংসাত্মক হিংস্র কাণ্ড। তারা মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানগণকে ভাগ্যাহত জনগোষ্ঠীতে পরিণত করেছে। অথচ এককালে তাদের ছিল ‘আরকান’ নামীয় স্বাধীন রাষ্ট্র, ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি।

এ উপমহাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সর্বপ্রথম যে কয়টি এলাকায় মুসলিম বসতি গড়ে ওঠে, আরাকান তার মধ্যে অন্যতম। রোহিঙ্গারা সেই আরাকানী মুসলমানের বংশধর। এক সময় আরাকন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
আরাকানে ১৪৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম শাসন দুইশ’ বছরেরও অধিকাল স্থায়ী হয়। ১৬৩১ সাল থেকে ১৬৩৫ সাল পর্যন্ত আরাকানে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ হয়। এরপর মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। ১৬৬০ সালে আরাকন রাজা থান্দথুধম্মা নিজ রাজ্যে আশ্রিত মোঘল সম্রাট শাহজাদা সুজাকে সপরিবারে হত্যা করেন। এরপর শুরু হয় মুসলমানের উপর তার নিষ্ঠুর অমানবিক অত্যাচার-নিপীড়ন। প্রায় সাড়ে তিনশ’ বছর মুসলমানদের কাটাতে হয় এই দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে।
১৭৮০ সালে বর্মী রাজা বোধাপোয়া আরাকন দখল করে নেয়। সেও ছিল ঘোর মুসলিমবিদ্বেষী। বর্মী রাজা ঢালাওভাবে মুসলিম নিধন কতে থাকে। ইতিহাস সাক্ষী, ১৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দে ৩০ হাজার বার্মিজ আরাকান আক্রমণ করে মুসলমানদের মসজিদ ও বিভিন্ন স্থাপনা করে দেয়। একই সঙ্গে তারা বহু রোহিঙ্গা মুসলমানকে পুড়িয়ে হত্যা করে এবং প্রায় ২ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে।

১৮২৮ সালে বার্মা ইংরেজদের শাসন চলে যায়। তখন মুসলমানরা কিছুটা স্বস্তিতে কাটালে ১৯৩৭ সালে বার্মা স্বায়ত্তশাসন লাভের পর বৌদ্ধদের পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ব্যাপকরূপ নেয় এবং তারা প্রায় ৩০ লাখ মুসিলমকে হত্যা করে। এ সময় মুসলিমদের উপর অবর্ণীয় ধ্বংসকাণ্ড চালানো হয়।
১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেনি। অধিকন্তু তৎকালীন স্বাধীন বার্মায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিতে শুরু করা হয় নতুন ষড়যন্ত্র। বার্মার স্বাধীনতার পর পরই বার্মার সেনাবাহিনী, পুলিশ ও সরকারি পদে রোহিঙ্গাদের নিষিদ্ধ করা হয। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে জেনারেল নে উইন রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে মিয়ানমার থেকে মুসলিম বিতাড়নের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করেন। তিনি নানাভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে ফায়দা লুটেন এবং মুসলিম নির্যাতনে নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করেন।

এরপর ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সনদ দেয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে কেড়ে নেয়া হয় তাদের ভোটাধিকার। তারপর চূড়ান্তভাবে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্মূলে ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় অপারশন ‘ড্রাগন কিং’।
এই অমানবিক অভিযানের প্রেক্ষিতে তখন রোহিঙ্গা মুসলমানরা অনেকে প্রতিবেশী মুসলিম দেশ বাংলাদেশের দিকে পাড়ি জমায়। তখন শুধু ১৯৭৮ খ্রিস্টাবেদ্ই আড়াই লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলিম বার্মার বৌদ্ধদের বর্বর আক্রমণের মুখে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে বাধ্য হয় শরনার্থী হিসেবে।
বার্মা পরবর্তীতে নতুন অঙ্গীকার নিয়ে মায়ানমার নাম ধারণ করলেও সেখানে মুসলিম নিধন অব্যহতই থাকে। ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে অনেক মানুষ বৌদ্ধধর্ম পরিত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করে বলে সেখানকার উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা মুসলমানদেরকে সেখান থেকে নির্মূল করার ফন্দি আঁটে। তাই তাদেরকে সেদেশ থেকে বিতাড়িত করতে নানা রকম জুলুম ও হত্যাকান্ড অব্যাহত গতিতে চালিয়ে যায়।

অথচ সেই অপরাধ ঢাকার জন্য মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে মিথ্যা তথ্য বলা হয়, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে আগত বাঙ্গালি গোষ্ঠী। সুতরাং, রোহিঙ্গা মুসলমানদের মিয়ানমারে থাকার কোন অধিকার নেই। কিন্তু মিয়ানমার সরকার কখনো তাদের বক্তব্যের সমর্থনে কোনো দলিল হাজির করতে পারে নি। বরং রোহিঙ্গারা সেখানকার আদি বাসিন্দা, যুগ-যুগান্তের ইতিহাসই সে কথা প্রমাণ করে। তবুও বৌদ্ধপ্রভাবিত মিয়ানমার সরকার সেখানকার মুসলিম জনগণের উপর বিভিন্ন অমানবিক নির্যাতন চালায়। যাতে করে তারা দেশ ছেড়ে পালায় অথবা বৌদ্ধদের দমন-পীড়নে নিঃশেষ হয়ে যায়।
রোহিঙ্গাদেরকে সাধারণত স্থানীয়ভাবে ‘কালারস’ নামে অভিহিত করা হয়। তাদের সাথে বৌদ্ধদের আচরণ প্রসঙ্গে মিয়ানমারের ‘দ্য ভয়েস’ নামক সাময়িকী একজন পাঠকের মতামত উদ্ধৃত করেছে, “আমাদের উচিত, কালারস হত্যা করা অথবা ধ্বংস করা। তা না হলে এ দেশ থেকে বৌদ্ধ ধর্মের অস্তিত্ব মুছে যাবে।”
এতে সহজেই বোঝা যায়, মিয়ানমারের বৌদ্ধরা মুসলিম ও ইসলাম সম্পর্কে কতটা ভয়ংকর বিশ^াস পোষণ করে। আর সেই সূত্র ধরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে মুসলিমনিধনে মেতে উঠেছে তারা।”
এভাবেই বার্মা স্বাধীন হবার পরেও সেখানে মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তারা পরিকল্পিত গণহত্যা ও নৃশংসতা চালাতে থাকে। এমনি করে মুসলিম রোহিঙ্গাাদেরকে সমূলে উৎখাত করার জন্য সেখানে একের পর এক বহু অভিযান পরিচালনা করা হয়, যেমন-
০১. ৫ম বর্মী রেজিমেন্ট-এর সামরিক অভিযান- নবেম্বর ১৯৪৮ইং।
০২. বার্মা টেরিটেরিয়াল ফোর্স (BTF)-এর অভিযান-১৯৪৮ থেকে ১৯৫০ইং।
০৩. দ্বিতীয় জরুরী ছিন রেজিমেন্ট-এর সামরিক অভিযান-নবেম্বর ১৯৪৮ইং।
০৪. মাউ অভিযান-অক্টোবর ১৯৫২ থেকে ১৯৫৩ইং।
০৫. মনে-থোন অভিযান-অক্টোবর ১৯৫৪ইং।
০৬. সমন্বিত অভিবাসন ও সামরিক যৌথ অভিযান-জানুয়ারি ১৯৫৫ইং।
০৭. ইউনিয়ন মিলিটারি পুলিশ (UMP)-অভিযান-১৯৫৫ থেকে ১৯৫৮ইং।
০৮. ক্যাপ্টেন হটিন কিয়াও অভিযান-১৯৫৯ইং।
০৯. শোয়ে কি অভিযান-অক্টোবর-১৯৬৬ইং।
১০. কি গান অভিযান-ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ইং।
১১. মেজর অং থান অভিযান-১৯৭৩ইং।
১২. সাবি অভিযান-ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ইং।
১৩. মেজর অং থান অভিযান-১৯৭৩ইং।
১৪. সাবি অভিযান-ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৮ইং।
১৫. নাগা মিন (ড্রাগন রাজা) অভিযান-ফেব্রুয়ারি ১৯৭৮ থেকে ১৯৭৯ইং। (এ অভিযানে প্রায় ৩ লক্ষ রোহিঙ্গা বাস্তুহারা হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় এবং ৪০ হাজার রোহিঙ্গা মারা যায়।)
১৬. সোয়ে হিন্থা অভিযান-আগস্ট ১৯৭৮ থেকে ১৯৮০ইং।
১৭. গেলোন অভিযান-১৯৭৯ইং।
১৮. তাউঙ্গকের গণহত্যা-১৯৮৪ইং।
১৯. তাউঙ্গি (পশ্চিম বার্মা)-এর মুসলিম বিরোধী দাঙ্গা। পিয়াই ও রেঙ্গুনসহ বার্মার অনেক অঞ্চলে এই দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে।
২০. পি থিয়া অভিযান-জুলাই ১৯৯১-৯২ (এতে ২ লক্ষ ৬৮ হাজার রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
২১. নাসাকা অভিযান-১৯৯২ থেকে অব্যহত।
২২. মুসলিমবিরোধী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-ফেব্রুয়ারী ২০০১ইং।
২৩. সিটিওয়ে’তে মুসলিম বিরোধী দাঙ্গা-ফেব্রুয়ারি ২০০১।
২৪. মধ্য বার্মার মুসলিম বিরোধী সর্বাত্মক দাঙ্গা- মে ২০০১।
২৫. মধ্য বার্মার মুসলিমবিরোধী ভয়ংকর দাঙ্গা (বিশেষত পিয়াই/ প্রোম, বাগো/পেগু শহরে) ৯/১১-এর পরবর্তী থেকে অক্টোবর ২০০১ইং।
২৬. সেনা বাহিনী ও বৌদ্ধদের যৌথ মুসলিম নিধনে অভিযান-জুন ২০১২ থেকে অব্যহত।
২৭. সাম্প্রতিক (বিশেষ করে ২০১৬ইং) সেনা বাহিনী, সরকারি মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীগোষ্ঠী ও বৌদ্ধভিক্ষুদের সম্মিলিত মুসলিমনির্মূল অভিযান।

উল্লেখ্য, ১৯৬২ সালে উ নু সরকারকে উৎখাত করে জেনারেল নে উইনের নেতৃত্বাধীন সামরিক জান্তা মিয়ানমারের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার পর প্রায় তিন দশনক স্বৈরশাসন চালিয়ে বিদায় নিলেও গনতন্ত্রকে ফিরে আসতে দেয়া হয় নি। বরং মানবাধিকার ও আইনের শাসনকে হত্যা করে সামরিক গোষ্ঠী আরো দ্ইু দশক ক্ষমতা আঁকড়ে থাকে। এরপর ২০১১ সালে নির্বাচন হলেও সামরিক গোষ্ঠীই কৌশলে রাষ্ট্রক্ষমতা কব্জ করে রাখে। তখন থেকে মিয়ানমার শাসন করেছে দেশটির সেনাসমর্থিত রাজনৈতিক দল দ্য ইউনিয়ন সলিডরিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি)।
অতঃপর ২০১৫ সনের নবেম্বরের নির্বাচনে অং সান সুচি’র দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)বিশাল জয় অর্জন করে। আর এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ৫০ বছরের সামরিক গোষ্ঠীর শাসনের অবসান হয় এবং শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার পাওয়া মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চির হাত ধরে মায়ানমারে ফিরে আসে গণতন্ত্র।
অং সান সু চি এ নতুন গণতান্ত্রিক সরকারে বিশেষ কারণে প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট হতে না পারলেও তিনি এ সরকারের বিশেষ র্শীষপদধারী হিসেবে রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা নির্বাচিত হয়েছেন। যার মাধমে অং সান সু চি এই সরকারে অনেকটা প্রধানমন্ত্রীর মতোই ভূমিকা পালন করতে পারছেন।

অং সান সু চি’র দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসায় মুসলমানদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছিলো। কারণ, একে তো তিনি গণতন্ত্রপন্থী হওয়ায় দেশের সকল নাগরিক সমান অধিকার পাওয়ার আশাবাদী হওয়াই স্বাভাবিক। দ্বিতীয়তঃ মিয়ানমারের মুসলিম জনগোষ্ঠী সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে অং সান সু চি’র দলকে জেতাতে অনেক শ্রম দিয়েছেন এবং কষ্ট করেছেন। এ সম্পর্কে টেকনাফের নয়াপাড়া শরনার্থী ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ ইসলাম বলেন, “আমরা আমাদের অবস্থা সম্পর্কে জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, মিয়ানমার সরকার এবং বিশেষ করে অং সান সু চি’র দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সুচি এখনো আমাদের জন্য কোন কিছু করেননি। অথচ ১৯৯০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গারা এমনকি আমার বাবা-মা তার পক্ষে নির্বাচনী অভিযানে অংশ নিয়েছেন।”
সে কারণে সকলে আশাবাদী ছিলেন যে, এবার গণতন্ত্র চালু হওয়া মিয়ানমারে শান্তিতে নোবেল পাওয়া অং সান সু চি’র মাধ্যমে মুসলমানরা শান্তি ও নাগরিক অধিকার ফিরে পাবেন। তাদের উপর সাম্প্রদায়িক অপশক্তির চালানো অন্যায় ও জুলুম-নির্যাতনের অবসান হবে।
কিন্তু দুঃখজনক যে, অং সান সু চি’র দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পরও, সেই সাথে তিনি এ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর সমতুল্য রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা হওয়ার পরও এবং সর্বপরি সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও মিয়ানমারের মুসলমানদের উপর সাম্প্রদায়িক হত্যাকান্ড ও জুলুম-নির্যাতন বন্ধ হয় নি, তা নতুন মাত্রা নিয়ে আরো প্রবল বেগে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বিভিন্ন দিক দিয়ে তার তা পূর্বের তুলনায় অনেক বেশী ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে।

গত ৯ই অক্টোবর মিয়ানমারের রাখাইন সীমান্ত চৌকিতে এক হামলার জের ধরে সেদেশের সরকারী বাহিনী ক্লিয়ারেন্স অপারেশন-এর নামে চরমভাবে মুসলিমনিধনে মেতে উঠেছে। রাখাইনের সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর তারা ব্যাপকহারে দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। তারা মুসলমান পুরুষদের নির্বিচারে হত্যা করছে, মহিলা ও কিশোরীদের ধর্ষণ করছে, তাদের বাড়ীঢ়রে অগ্নিসংযোগ ও ব্যাপক লুটতরাজ চালাচ্ছ্ তাদের গণহারে হত্যাকান্ড থেকে বৃদ্ধ ও শিশুরাও নিস্তার পাচ্ছে না।
উক্ত ঘটনা বর্ণনা করে ১৮ নবেম্বর ২০১৬ জাতিসংঘ জানিয়েছে, রাখাইনে সেনা অভিযানে বহু রোহিঙ্গা মুসলিম জনসাধারণ নিহত হয়েছে এবং সেনাবাহিনী সেখানে বিমান থেকে বোমা নিক্ষেপ করেছে এবং সাধারণ মানুষের বাড়ীঘর জ¦ালিয়ে এমন ভাবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যে, মাত্র এক সপ্তাহে ৩০ হাজারের বেশি মানুষ তাদের ঘরবাড়ী ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। জাতিসংঘের তথ্যে বলা হয়েছে, সেনা অভিযানে শুধুমাত্র ১২ ও ১৩ নভেম্বর ১৫ হাজার রোহিঙ্গা তাদের বাড়ি থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। সবমিলে গত কয়েকদিনে ৩০ হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছেন। এ প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ বাংলাদেশসহ পার্শবর্তী দেশগুলোর কাছে তাদের সীমান্ত খুলে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে।

মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রকাশিত কিছু ছবিতে দেখা গেছে, বেশ কয়েকটি গ্রাম পুড়ে সম্পূর্ণ ছাই হয়ে গেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া পরিচালক ব্র্যাড অ্যামামস বলেছেন, নতুন প্রকাশিত ছবিতে ব্যাপকহারে ধ্বংসযজ্ঞ দেখা যাচ্ছে, যা আগের ধারণার চেয়ে অনেক বেশী।
এমনি করে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর গণহত্যা ও চরম নির্যাতন চলছে। যা সেখানে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। তাই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেই তাদের বিষয় বিবেচনা করা সমগ্র বিশ্ববাসীর কর্তব্য। এ অবস্থায় কোন বিবেকবান মানুষ নীরব থাকতে পারেন না।

সুতরাং, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত, অবিলম্বে জরুরী ভিত্তিতে মিয়ানমারের সাম্প্রদায়িক নির্যাতন-নিপীড়ন ও এথনিক ক্লিনজিং বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া। মুসলিবিশ্বকে এ ব্যাপারে ত্বড়িৎ উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে প্রতিবেশী মুসলিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের এক্ষেত্রে অনেক করণীয় রয়েছে। যেমন, আশ্রয়প্রার্থী উদ্বাস্তু ও অসহায় রোহিঙ্গাদেরকে নিরাপত্তার সাথে শরণার্থীরূপে আশ্রয় দেয়া, কড়া প্রতিবাদের মাধ্যমে মিয়ানমারকে মুসলিম নিধন বন্ধে বাধ্য করা এবং জাতিসংঘের মাধ্যমে রোহিঙ্গা মুসলিমদের জন্য তাদের নিজেদের দেশে স্থায়ী শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে বসবাসের গ্যারেন্টিপূর্ণ সমাধানের ব্যবস্থা করা প্রভৃতি এখন সময়ের বড় দাবী হয়ে পড়েছে। তেমনি ওআইসিসহ আন্তর্জাতিক মুসলিম সংস্থাগুলোর এ ব্যাপারে বাস্তবমুখী ভূমিকা পালন করা অপরিহার্য।
সেই সাথে মানবতার দৃষ্টিকোণ থেকে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বিশ্বের মানবতাবাদী জনগণকে এ ব্যাপারে সোচ্চার হওয়া কর্তব্য। আমাদের মনে রাখতে হবে-সকলের নির্লিপ্ততাকে মিয়ানমার সরকার সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করছে অসহায় রোহিঙ্গাদের নিপীড়নে।

এ মর্মে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ হিসেবে আমরা বার্মিজ সকল পণ্য বর্জন করতে পারি। এ ছাড়াও শান্তিতে নোবেল পাওয়া অং সান সু’র নেতৃত্বাধীন সরকারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন ও নির্বিচারে হত্যাকান্ডের দ্বারা সেখানে শান্তি ব্যাহত করার কারণে অং সান সু’র নোবেল পুরস্কার বাতিল বা ফেরত নেয়ার জন্য নোবেল কর্তৃপক্ষের নিকট আমরা দাবী জানাতে পারি। আর আমাদের দেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের বিভিন্নভাবে সহায়তা ও সহযোগিতা করতে পারি। সর্বপরি আমরা মহান আল্লাহর কাছে এ ব্যাপারে আরজী পেশ করে দু’আ করতে পারি।

অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন সরকারের ছত্রছায়ায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থী বৌদ্ধদের মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন ও নির্বিচারে হত্যাকান্ডের তীব্র প্রতিবাদ করছি এবং তাদেরকে এ অন্যায় তৎপরতা থেকে ফিরে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। মিয়ানমরের সরকার ও উগ্র বৌদ্ধরা যদি মনে করে থাকে যে, পাশবিক কায়দায় মিয়ানমারকে মুসলিমশূণ্য করা যাবে, তাহলে তাদের অংকে চরম ভুল রয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য কখনো সফল হওয়ার নয়। ১৯৪৮ সন থেকে এ যাবতকালের দীর্ঘ ৬৮ বছরের ইতিহাসই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

ঐতিহাসিকভাবেই রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক। হাজার হাজার বছর ধরেই রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে বসবাস করেছেন। এই সত্যকে অস্বীকার করে রোহিঙ্গাদেরকে কখনো নিজ মাতৃভূমি থেকে উচ্ছেদ করা যাবে না। বরং এ অন্যায়ের দ্বারা তাদেরকে চরমপন্থা ও সশস্ত্র লড়াইয়ের দিকেই ঠেলে দেয়া যাবে। যা মিয়ানমার সরকার ও উগ্রপন্থী বৌদ্ধদের জন্য কখনো শুভ ফল বয়ে আনবে না।

http://www.dailysangram.com/post/300735