২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শুক্রবার, ৭:৫৯

এক গ্রামেই হত্যা করা হয় নারী শিশুসহ ৮১ রোহিঙ্গা!

কামাল হোসেন আজাদ ও শাহনেওয়াজ জিল্লু, কক্সবাজার : বুথিদং শহরতলীর নিকটবর্তী একটি ক্ষুদ্র রোহিঙ্গা পল্লীতেই নারী শিশুসহ ৮১ জন রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। গ্রামটির বেঁচে ফেরা রোহিঙ্গারা খোঁজ খবর নিয়ে নিহতদের একটি পরিসংখ্যানিক তালিকা তৈরী করেছে। গত ২৪ আগস্ট শুরু হওয়া বর্মী সেনাবাহিনীর চলমান কিলিং অপারেশনের অংশ হিসেবে ঐ গ্রামে হামলা করে ব্রাশ ফায়ার ও আগুনে পুড়িয়ে এসব রোহিঙ্গা হত্যা করা হয়।
সূত্র জানিয়েছে, গ্রামটির নাম ক্রান্তামা উজু। আয়তনের দিক দিয়ে অন্যান্য রোহিঙ্গা পল্লীর তুলনায় এটি অনেক ছোট। গ্রামের বাসিন্দাও সবেমিলে সর্বোচ্ছ শ’পাঁচেক এর বেশি না। ২৭ আগস্ট রাতে ঐ গ্রামে হামলা করে সামরিক ও নাডালা বাহিনী।
হামলাকারীরা রোহিঙ্গাদের ধাওয়া করলে দিক-বিদিক ছুটে পালায় তারা। এসময় অনেক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে একটি স্কুল ঘরে তালাবদ্ধ করে বাহির থেকে আগুন ধরিয়ে দেয় হানাদার বাহিনীর সদস্যরা। নারীদের সাথে তাদের সন্তান-সন্ততিও ছিল। অনেককে পিছমোড়া হাত বেঁধে উপুর করে ব্রাশ ফায়ার করে। পরে রোহিঙ্গাদের বসত বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম রোহিঙ্গারা ঐ রাতে গহীন অরণ্যে আশ্রয় নেয় পরে বাংলাদেশ চলে আসে।

সূত্র আরো জানিয়েছে, গ্রামটির বেঁচে ফেরা মানুষগুলোর জবানবন্দী আর স্বজন হারাদের নিকট থেকে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে ৮১ জনের একটি তালিকা পাওয়া গেছে। তালিকায় নিহতদের নাম, পিতার নাম ও বয়স উল্লেখ করা হয়েছে। বার্মিজ ভাষায় লিখিত এতালিকায় দেখা গেছে নিহত ৮১ জনের মধ্যে ২২ জন শিশু, যাদের বয়স আটারো বছরের নিচে। তালিকায় দুধের শিশুও হত্যার শিকার হয়েছে বলে উল্লেখ রয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে একজন বিশ্লেষক জানান, আরাকানে এরকম নৃশংস ঘটনা অহরহ ঘটছে। কিন্তু সেখানে গণমাধ্যমের প্রবেশাধিকার না থাকায় সেসব প্রকাশ পায়নি। যেসব প্রকাশ পেয়েছে তা সংঘটিত ঘটনার কিঞ্চিৎ মাত্র। বিশ্লেষক আরো জানান, একটি ছোট গ্রামেই যদি ৮১ জন হত্যার শিকার হয়, তবে বড় বড় গ্রামগুলোতে কত রোহিঙ্গা হত্যার শিকার হয়েছে তা সহজেই অনুমেয়।

এদিকে বিশ্ব সম্প্রদায় রোহিঙ্গা গণহত্যা বন্ধে বার্মাকে বারংবার হুঁশিয়ারী দিলেও, তারা ভয় পাননা বলে জনসমক্ষে জানান সুচি। টেলিভিশনে দেয়া ভাষণে সেনা অভিযান অব্যাহত রাখার কথাও বলেন তিনি।
বর্মী প্রশাসনের ত্রাণোপহাস!
বুথিদং-এর প্রত্যন্ত অঞ্চলে বর্মী প্রশাসনের সরকারি প্রতিনিধিরা গত মঙ্গলবার রোহিঙ্গাদেরকে ধান, চাল, আলু প্রভৃতি দিতে বাধ্য করে। পরে একটি স্কুলে ডেকে নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে তা রোহিঙ্গাদের মাঝে বিতরণ করে। এসময় প্রশাসনের কর্মীরা ভিডিও ধারণ করে এবং ছবি তোলে।
উদ্দেশ্য : আরাকানে রোহিঙ্গাদের মাঝে সরকারিভাবে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে বলে বিশ্ব সম্প্রদায় ও গণমাধ্যমকে দেখানোর ব্যবস্থা!

সীমান্তে রোহিঙ্গা গ্রামে মিয়ানমার বাহিনীর আগুন, গুলী
বাংলাদেশ সীমান্ত-সংলগ্ন মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম গ্রামগুলোতে নতুন করে আগুন দেয়ার খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া বাংলাদেশ এলাকা থেকে সেখানে গোলাগুলির হওয়ার শব্দও শোনা যায়।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে তমব্রু সীমান্তের ডেকুবুনিয়া উত্তর পাড়ায় একটি গ্রামে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। ভীত-সন্ত্রস্ত্র অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশ সীমান্তের পালিয়ে আসার চেষ্টা করছে। আগুনের লেলিহান শিখা সীমান্তের এপার থেকেও দেখা যাচ্ছে।
তবে এ রিপোর্ট লেখার সময় বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত হতাহতের তথ্য নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, মিয়ানমারের রাখাইনে ২৫ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া সেনাদের নিধনযজ্ঞের শিকার হয়ে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ রোহিঙ্গা। এখনো এক লাখের বেশি রোহিঙ্গা আটকা পড়ে আছে রাখাইন রাজ্যে। মাইন পুঁতে রাখা সীমান্ত কিংবা নাফ নদী পেরিয়ে তারা বাংলাদেশে আসতে সমর্থ হয়নি। তাদের ওই সাত ক্যাম্পে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মিয়ানমার সরকার।

মিয়ানমার সরকারের একজন মুখপাত্র জো হতাই এক সাক্ষাৎকারে রাখাইনে নিপীড়নের শিকার হওয়া ওই জনগোষ্ঠীকে বাঙালি বলে উল্লেখ করেন।
তিনি জানান, ওই ক্যাম্পগুলো বাঙালিদের জন্য। স্থানীয় আদিবাসীরা তাদের গ্রামে ফিরতে পারবেন।
তিনি জানান, রাখাইনে থেকে যাওয়া রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে কেউ ফিরতে চাইলে তাদেরও রাখা হবে ওই ক্যাম্পে।
এদিকে গত সপ্তাহে সরকারের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, রাখাইনের ৪৭১ মুসলিম গ্রামের মধ্যে ইতোমধ্যে ১৭৬টি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। পুড়িয়ে কিংবা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে সাত হাজার বাড়িঘর। এরই মধ্যে হত্যা করা হয়েছে অন্তত ৫ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিমকে। মিয়ানমার সেনা বৌদ্ধদের গণধর্ষণের শিকার হয়েছে অসংখ্য রোহিঙ্গা নারী, তরুণী ও কিশোরী।
এদিকে ত্রাণ বিতরণেও বাধা দেয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে বুধবার বিকেলে রাখাইনে আন্তর্জাতিক রেডক্রসের ত্রাণবাহী নৌকায় বোমা হামলা চালায় মিয়ানমারের উগ্রবৌদ্ধরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ফাঁকা গুলী ছুড়ে। এপির খবরে এ কথা জানানো হয়েছে।

http://www.dailysangram.com/post/300638