২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শুক্রবার, ৭:৪০

চালের দামে কোনো কৌশলই কাজে আসছে না

থাইল্যান্ডের দুই জাহাজ পচা চাল চট্টগ্রামে, সরকার না নেওয়ায় বেসরকারিভাবে বিক্রির চেষ্টা
সরকারের দূরদর্শিতার মাশুল দিচ্ছে সাধারণ মানুষ -মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম
ছলে বলে কৌশলে সরকার চালের দাম কমাতে মরিয়া। কখনও শুল্কছাড়, কখনও আমদানি বাড়ানোর চেষ্টা বা খোলাবাজারে কম দামে বিক্রি করে। তবে কিছুতেই যেন কিছু মিলছে না। আবার বল প্রয়োগেরও চেষ্টা হয়েছে...! তাতে উল্টো হিতে বিপরীত ভেবে একরকম পিছু হটেছে সরকার। এমনকি চাল ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে তিন মন্ত্রণালয়ের বৈঠকও করেছে। বৈঠকের পর চালের দাম কিছুটা কমার কথা থাকলেও পাইকারি ও খুচরাভাবে মোটা ও চিকন চালের দাম আগের অবস্থানে রয়েছে। এছাড়া বাজারে কোন মনিটরিং না থাকায় চালের দাম কমার কোন আশা দেখছেন না চালের আড়তৎদাররা। যদিও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ আবারও বলেছেন, ‘চালের অবৈধ মজুদের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী অভিযান অব্যাহত থাকবে। যারা চাল মজুদ করবে তাদের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান কঠোর। কোনও ছাড় নাই।’ এদিকে থাইল্যান্ড থেকে সরকারিভাবে আমদানি করা দুই জাহাজ চাল চট্রগামে আসলেও তা পঁচা হওয়ায় এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে চট্টগ্রামজুড়ে। সরকার এই চাল না নেওয়ায় এখন বেসরকারিভাবে বিক্রির চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে জানা গেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, চালের দাম বাড়ায় স্বল্প আয়ের মানুষদের মোট খরচের প্রায় ৭০ শতাংশই চলে যাচ্ছে চালের পেছনে। তাদের ক্রয়ক্ষমতা ও জীবনযাত্রার মানের ওপরে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে তাদের খাদ্যনিরাপত্তার ক্ষেত্রে অসুবিধা হচ্ছে। তারা বলছেন, সঠিক সময়ে যোগান না বাড়ানোর মাশুল দিতে হচ্ছে সরকারকে। যা সাধারণ মানুষের ঘাড়ে পড়েছে। তবে এ জন্য বল প্রয়োগ কোনভাবেই কাম্য নয়, তাতে বাজার আরো অস্থির হতে পারে।

সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, চালের ব্যাপারে সরকার দূরদর্শিতার অভাব দেখিয়েছে। কারণ জুন মাসেই দেখা গেছে সরকারের নিজস্ব স্টক (মজুদ) অনেক বড় মাত্রায় কমে গেছে। তারপর বন্যার আভাস তো আগে থেকেই ছিল এবং বন্যায় যখন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তখনও সরকার নিজে থেকে কোন পদক্ষেপ নেয়ানি। পরে সরকার আমদানিতে গেছে। এখন সেগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডেলিভারি (সরবরাহ) নিতে হবে। একই সঙ্গে বেসরকারি খাতে আমদানি শুল্ক সরকার সময় মতো কমায়নি। কাজেই সরবরাহে কিছুটা সংকট দেখা দেয়। এরপর রোহিঙ্গারা আসায়, ব্যবসায়ীরা তো জানেই তাদের (রোহিঙ্গা) খাবার দিতে সরকারের চাল বেশি কিনতে হবে। এ জন্য চাহিদা বেড়ে গেছে। একদিকে সরবরাহ সমস্যা, অন্যদিকে চাহিদা বৃদ্ধির ফলে দাম বেড়ে গেছে বলে উল্লেখ করেন এই অর্থনীতিবীদ।

চালের দাম কমানোর উদ্যোগ হিসেবে সিপিডি ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এখন আমদানি বাড়াতে হবে এবং জি-টু-জি (সরকার থেকে সরকার)-এর বাহিরে গিয়ে বেসরকারি খাতের মাধ্যমে আমদানি করে চাল কিনে মজুদ বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে বাজার নিয়ন্ত্রণে খোলাবাজারে বিক্রি আরও স¤প্রসারিত করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সবেক গভর্নর আতিউর রহমান বলেন, চাল আমদানি করে সরকারের এখন বাজার একেবারে ভাসিয়ে দিতে হবে। এটিই হলো প্রধান কাজ। একই সঙ্গে ওএমএস খোলাবাজারে চাল বিক্রি কর্যক্রম) চালু রাখা। সম্ভব হলে ওএমএস’র দাম আর একটু কম রাখা।

রাজধানীর নিকেতন থেকে কারওয়ান বাজারে চাল কিনতে এসেছেন আফরীন আক্তার। জানালেন, চালের বাজারে দাম বৃদ্ধির যে চমক তাতে একরকম ভুলেই যান এক সপ্তাহ আগেও ঠিক কয়টাকা কেজিতে চাল কিনেছেন। তার মতো প্রায় সব ক্রেতাই চাল কিনতে এসে এমন চমকে যান। বাজার ঘুরে দেখা যায়, চালের দোকানে বেচাকেনার চেয়ে যেন দরকষাকষিই বেশি।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে কুমিল্লা রাইস এজেন্সির সারোয়ার জানান, চালের বাজার এখনও আগের মতোই রয়েছে। দাম কমার বিষয়ে আমরা কোন ঘোষণা কিংবা এ জাতীয় কোন নির্দেশনা পাইনি। তাই দাম কমার কোন সম্ভাবনা নেই। বাজারে সরকারের কোন মনিটরিং আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোন মনিটরিং নেই, কেউ এসে খোঁজখবরও নিচ্ছে না। শুধু মিডিয়ার লোকেরা এসে খবর নিয়ে যায়। তাদের মতে, কোরবানি ঈদের পর বাজারে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে ১০টাকা বেড়েছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ হিসাব বলছে, ১৪ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারের কাছে চালের মজুদ আছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মেট্রিক টন। আগের বছর একই সময়ে যা ছিল প্রায় আট লাখ মেট্রিক টন।
সূত্র মতে, চালের বাজার স্থিতিশীল করতে সরকারের নেয়া একাধিক পদক্ষেপ কাজে না আসায় শেষ পর্যন্ত অভিযানে নামে মিল মালিকদের বিরুদ্ধে। হুশিয়ারী আসে অতিরিক্ত মজুদের বিপরীতে। গত মঙ্গলবার সচিবালয়ে বাক বিতন্ডায় জড়ায় সরকার, ব্যবসায়ী ও চালকল মালিকরা। এ সময় চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে ব্যবসায়ীদের সকল দাবি মেনে নেয় সরকার। একই সঙ্গে চালের মূল্য কেজি প্রতি দুই টাকা কমবে বলে আশা প্রকাশও করেন ব্যবসায়ীরা। যদিও স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য খোলাবাজারে চাল বিক্রির কার্যক্রম চলছে। অথচ প্রভাব নেই সেখানেও।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, যে সময়ে স্টক (সরকারের মজুদ) ভালো রাখা উচিত ছিল, তখন মজুদ রাখা হয়নি। এর সঙ্গে আমন, বোরো সংগ্রহের যে লক্ষ্য ছিল তাও পূরণ হয়নি। আমদানির পদক্ষেপও সময় মতো নেয়া হয়নি। একই সঙ্গে বন্যার প্রভাব ছিলো। সবমিলিয়ে বাজারে সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে ঘাটতিতে বাজারে চালের মূল্য বাড়ে। এই অর্থনীতিবীদ বলেন, যারা স্বল্প আয়ের এবং যাদের মোট খরচের প্রায় ৭০ শতাংশই চলে যায় চালের পেছনে, তাদের ক্রয়ক্ষমতার ওপর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তাদের জীবনযাত্রার মানের ওপরেও চালের দাম বৃদ্ধির একটা প্রভাব আছে। বিশেষ করে তাদের খাদ্যনিরাপত্তার ক্ষেত্রে অসুবিধা হচ্ছে।
মজুদের বিরুদ্ধে অভিযানের বিষয়ে মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, অভিযানের আমি খুব বেশি পক্ষপাতি না। কারণ এটি করতে গেলে দেখা যাবে মজুদদাররা একটি গোডাউনে মাল রেখে অন্য গোডাউন থেকে মাল সরিয়ে দিবে। যাতে সরবরাহের ওপর আরও বেশি চাপ সৃষ্টি হয়। তাই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে এবং কিছুটা ভয় দেখিয়ে দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে।

এদিকে থাইল্যান্ড থেকে সরকারিভাবে আমদানি করা দুই জাহাজ পঁচা চাল নিয়ে নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে চট্টগ্রামজুড়ে। সরকার এই চাল না নেওয়ায় এখন বেসরকারিভাবে বিক্রির চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে জানা গেছে। জাহাজ সংশ্লিষ্টদের মতে, সরকার নেয়নি। তাই বেসরকারিভাবে হলেও চাল বিক্রি করে যাবেন বিদেশি দুই জাহাজ সংশ্লিষ্টরা। আর এ নিয়ে দেন-দরবার শুরু হলে ব্যবসায়ীরা জানতে পারেণ- চালগুলো পঁচা। খাওয়ার অনুপযোগী। অবশ্য খাদ্য বিভাগ বলছে, চাল অত্যন্ত নিম্মমানের। তাই খাদ্য বিভাগ চালগুলো ফিরিয়ে নিতেও বলেছে থাইল্যান্ডের এ জাহাজ দুটিকে। কিন্তু, জাহাজ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা চাল ফেরত না নিয়ে চালগুলো বেসরকারিভাবে হলেও বিক্রি করার চেষ্টা শুরু করেন। গত মঙ্গলবার থেকে তারা যোগাযোগ করেন চট্টগ্রামসহ দেশের বেশ কয়েকটি চাল ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে।

খাদ্য বিভাগ চট্টগ্রামের চলাচল ও সংরক্ষণ নিয়ন্ত্রক জহিরুল ইসলাম বলেছেন, থাইল্যান্ড থেকে আমদানি করা প্রায় ৩২ হাজার ১৪০ টন চাল নিয়ে দুটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। এরমধ্যে এমভি থাই বিন বে নামের একটি জাহাজ ১২ হাজার ২৯০ টন চাল নিয়ে ৩১শে আগষ্ট এবং এমভি ডায়মন্ড-এ নামের অপর চালবাহী জাহাজ আসে ১লা সেপ্টেম্বর। এতে ১৯ হাজার ৮৫০ টন চাল রয়েছে। কিন্তু চালগুলো খালাসের আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেছে, দরপত্রের শর্তের চেয়ে বেশি পরিমান মরা, বিনষ্ট ও বিবর্ণ দানা রয়েছে। ফলে চালগুলো গ্রহণ করা হয়নি। সেগুলো ফেরত নিতে বলা হয়। তিনি বলেন, জাহাজে থাকা চালের মধ্যে মরা, বিনষ্ট ও বিবর্ণ দানার পরিমাণ ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। অন্য জাহাজের চালের দানায় এর পরিমাণ পাওয়া যায় ১৭ শতাংশ। সরকারের আমদানির দরপত্র চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, মরা, বিনষ্ট ও বিবর্ণ দানার গ্রহণযোগ্য সীমা ৩ শতাংশ।

সরবরাহকারি প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে খাদ্য বিভাগের চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, একটি জাহাজে যত চাল আনা হবে, তার মধ্যে নমুনায় যদি ৪ শতাংশ পর্যন্ত মরা, বিনষ্ট ও বিবর্ণ দানা পাওয়া যায়, তবে জরিমানা আদায় করে তা গ্রহণ করতে পারবে খাদ্য বিভাগ। কিন্তু দুটি জাহাজে আনা চাল জরিমানা করেও গ্রহণ করার সুযোগ নেই বলে জানান তিনি। খাদ্য বিভাগের এ কর্মকর্তা জানান, আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে সিঙ্গাপুরভিত্তিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওলাম ইন্টারন্যাশনালের কাছ থেকে মোট ৫০ হাজার টন চাল কেনার চুক্তি হয়। এর মধ্যে প্রথম দুটি চালানেই শর্ত লঙ্ঘন করে নিয়ে আসা হয়েছে পঁচা চাল।

https://www.dailyinqilab.com/article/96717