২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:৩৭

অবৈধ মজুদ চাল নিয়ে মিল মালিকরা বিপাকে

মিলারদের চালে আগ্রহ কম পাইকারদের, ঝুঁকছেন আমদানি চালে * মিলারদের দাম কমার ঘোষণা কেজিতে ২ টাকা, প্রভাব পড়েনি বাজারে * বেনাপোল ও হিলিতে আমদানি চালে কেজিতে কমেছে ৫ টাকা
অবৈধভাবে মজুদ করা চাল নিয়ে বিপাকে পড়েছেন মিল মালিকরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অব্যাহত অভিযানে গুদামের অতিরিক্ত চালের মজুদ কমাতে বেপারি ও পাইকারদের এখন খুঁজে বেড়াচ্ছেন তারা। তবে এতে সাড়া দিচ্ছেন না নিয়মিত পাইকাররা। কারণ মিলারদের চড়া দামের চালে তাদের আগ্রহ কম। এদিকে পিঠ বাঁচাতে সরকারের সঙ্গে বৈঠকে কেজিপ্রতি ২-৩ টাকা দাম কমানোর ঘোষণা দিয়েছেন মিলাররা।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর চালের সবচেয়ে বড় আড়ত বাবুবাজার ও বাদামতলীতে দেখা গেছে, অনেকটাই ক্রেতাশূন্য। সংশ্লিষ্টরা জানান, বিভিন্ন বন্দর দিয়ে বেসরকারিভাবে আমদানি করা চালের দিকে এখন তারা ঝুঁকছেন। এর নেপথ্য কারণ হিসেবে জানা গেছে, ভারত থেকে আমদানি করা চালের দাম এদিনই কেজিপ্রতি কমেছে ৫ টাকা। ফলে আগে বেনাপোল ও হিলিতে আমদানি করা যে চাল পাইকারি বাজারে ৪৭ টাকায় বিক্রি হতো কেজি, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৪২ টাকা। এ কারণে এদিন এই দুটি স্থলবন্দর থেকে খালাসের পর চালভর্তি শতাধিক ট্রাক রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও বিভাগীয় শহরগুলোয় পৌঁছেছে। পাইকাররা কম দামে ভালোমানের চাল কিনে স্বাচ্ছন্দ্যবোধও করছেন বলে জানান কয়েকজন।
বাংলাদেশ রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি ও বাবুবাজার-বাদামতলী চাল ব্যবসায়ী সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাওসার আলম খান যুগান্তরকে বলেন, রাজধানীর বৃহত্তম পাইকারি বাজারে এখন কাস্টমার নেই। বেচাকেনা শূন্য। কারণ হিসেবে তিনি জানান, পাইকারি পর্যায়ে এখনও প্রতি কেজি চালে ২ টাকা কমার প্রভাব পড়েনি। এর কারণ পাইকারদের আগের মজুদ শেষ হয়নি। ফলে খুচরা পর্যায়ে তার প্রভাব পড়তে আরও সময় লাগবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাইকাররা এখন মিলারদের কাছে কম যাচ্ছেন। তারা আমদানি চালের প্রতিই বেশি ঝুঁকছেন। কারণ আমদানি চালে কমেছে ৫ টাকা। কিন্তু দেশি মজুদ চালে কমেছে ২ টাকা। যেখানে বেশি মুনাফা পাবেন পাইকাররা সেখানেই যাবেন।
কুষ্টিয়া জেলা চালকল মালিক সমিতির সভাপতি আবদুস সামাদ জানান, ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে রয়েছেন। মোকামে কেউ চাল কিনতে আসছেন না। মিলাররা চাল দু-এক টাকা কমে বেচতে চান, কিন্তু ক্রেতা নেই।
আমদানিকারক সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিদিন স্থলবন্দর দিয়ে শত শত টন চাল দেশে ঢুকছে। শুধু স্থলবন্দর দিয়েই আসছে না চাল। কলকাতা বন্দর দিয়ে মাদার ভেসল ও লাইটার ভেসলে করেও নৌবন্দর দিয়ে দেশে চাল প্রবেশ করছে। প্রায় ৪ হাজার টন চাল নিয়ে চারটি মাদার ভেসল বাংলাদেশের উদ্দেশে বৃহস্পতিবার রওনা হয়েছে। এ চাল দু-তিন দিনের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ বন্দরে প্রবেশ করবে। এ ছাড়া বিনা মার্জিনে চাল আমদানির সুযোগ থাকায় প্রতিদিন বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে চালের নতুন নতুন এলসি খোলা হচ্ছে। বর্তমানে ভারতে প্রতি টন চাল ৪২০-৪৬০ মার্কিন ডলারে পাওয়া যাচ্ছে। দাম কমে আসায় চাল আমদানির পরিমাণও বাড়ছে।

অভিযোগ, কিছুদিন আগেও পাইকাররা প্রয়োজনীয় চালের জন্য মিলারদের অগ্রিম ডিও দিয়েও ট্রাক প্রবেশের গেট পাস পেতেন না। যারা পেতেন তারাও চাহিদার অর্ধেক পেতেন। সেখানে মিল গেটেই চালের দাম প্রতি কেজি মোটা চালে ৪৬-৪৮ টাকা এবং সরু চালে ৬০-৬২ টাকা রাখা হতো। এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। চাল নিয়ে কারসাজি করছেন মিলাররা, এটা বুঝতে পেরেছে সরকার। বিভিন্ন জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালাচ্ছে। অবৈধ মজুদ চাল রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে। এই ভয়ে মিলাররা মজুদ কমাতে এখন চালের দামও কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তবে বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে দাম যে হারে কমানো উচিত ছিল মিলাররা সেটা করেননি। আবার দাম কমানোর ঘোষণাও সব মিলার এখন পর্যন্ত কার্যকর করেননি। অন্যদিকে বড় মিলাররা চালের বস্তাপ্রতি ১০০ টাকা দাম কমালেও বাবুবাজার ও বাদামতলীর পাইকারি বিক্রেতারা তাদের নামমাত্র হ্রাস করা দামে নতুন করে চালের অর্ডার দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তারা মনে করছেন, চালের দাম মিলগেটে শুধু দুই টাকা কমানোই যথেষ্ট নয়। প্রতি কেজিতে আরও ৩-৪ টাকা কমানো উচিত। তাহলে আমদানি করা চালের সঙ্গে দেশি মজুদ চালের বাজারমূল্যে একটা সামঞ্জস্য তৈরি হবে। নতুবা তারা মিলারদের চাল না কিনে আমদানি করা চাল বিক্রিতেই নজর দেবেন বলে দাবি করছেন।
জানা গেছে, সারা দেশে ২০ হাজার মিলার রয়েছেন। তাদের বেশিরভাগই ধান ও চাল দুটোই প্রক্রিয়াজাত করে থাকেন। এর মধ্যে শতাধিক অটো রাইস মিলার নিজেদের উৎপাদিত চালকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নামে বাজারে চাল সরবরাহ করেন। এর মধ্যে সরু চাল (মিনিকেট) বিক্রি করা হয় এমন ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে রয়েছে- রশীদ মিনিকেট, মজুমদার, সিরাজ, জোয়ার্দ্দার, বিশ্বাস, গ্রামীণ, নেয়ামত, জামাল, সাফায়াত, হেকিম, আলাউদ্দিন উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া নাজিরশাইল চালের ব্র্যান্ডের মধ্যে আছে খুশবু, উৎসব, রাবেয়া পিওর, রজনীগন্ধা, কাবা নাজির, জাকারিয়া নাজির উল্লেখযোগ্য। এসব ব্র্যান্ড মিলাররা বাজারে একচেটিয়া ব্যবসা করছেন। দামও ইচ্ছেমতো হাঁকছেন। তবে এসব ব্র্যান্ড মিলারদের পাশাপাশি বিভিন্ন মিলারের বিরুদ্ধে উৎপাদন সক্ষমতার বেশি ধান ও চাল মজুদের অভিযোগও রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে তাদের অনেকের গুদামে অবৈধ মজুদের সন্ধানও পেয়েছে। তবে মিলারদের কারসাজি আরও গভীরে। তারা মজুদ করলেও সেটা অনেক সময়ই নিজেদের গুদামে মজুদ না রেখে বাজার থেকে কেনা ধান-চাল কৃষক বা ফড়িয়ার মাধ্যমে গোপন স্থানে মজুদ রাখেন। যা চোখে পড়ে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর।

বাবুবাজার মায়া ট্রেডার্সের ম্যানেজার রুস্তম আলী জানান, আগে সারাদিনে ৭০-১০০ বস্তা চাল বিক্রি হতো। এখন দাম নিয়ে অস্থিরতার কারণে বাজার ক্রেতাশূন্য। আমরা বেশি দামে কিনে তা কম দামে বিক্রি করতে পারি না। ফলে দিন শেষে এখন চাল বিক্রির পরিমাণ ৭-১০ বস্তায় দাঁড়িয়েছে। বিক্রি না হওয়ায় নতুন অর্ডারও দিতে পারছি না। তিনি দাবি করেন, দেশে চালের কোনো সংকট নেই। মিলারদের হাতে প্রচুর চাল রয়েছে। অন্তু সেন্টু রাইস মিলের স্বত্বাধিকারী মো. ইব্রাহিম খান বলেন, মিলারদের চালের দাম বেশি। এখন আমদানি চালের দামই তুলনামূলক কম।
কুষ্টিয়া প্রতিনিধি এএম জুবায়েদ রিপন জানান, মন্ত্রীদের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি রাখেননি মিল মালিকরা। কেজিপ্রতি চালের দাম ২-৩ টাকা কমানোর ঘোষণা দেয়ার ২৪ ঘণ্টায়ও কমেনি চালের দাম। খুচরা বাজারে চিকন চাল মিনিকেট এখনও বিক্রি হচ্ছে ৬০-৬২ টাকায়, কাজল লতা ৫৬ এবং আটাশ ও মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে যথাক্রমে ৫৪ ও ৪৫ টাকা কেজিতে। এক সপ্তাহ ধরে দেশের অন্যতম বৃহত্তম চালের মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগরে বাংলাদেশ চালকল মালিক সমিতির সভাপতি আবদুর রশীদের মিলসহ বেশ কয়েকটি বড় মিলে টাস্কফোর্স অভিযান চালিয়েছে দফায় দফায়। নামমাত্র জরিমানা করা হলেও বড় ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেয়নি টাস্কফোর্স। কুষ্টিয়ার পৌরবাজারের খুচরা ব্যবসায়ী রঞ্জুর রহমান নিশান জানান, চালের বাজার আগের মতোই অস্থির রয়েছে। মোকামে কোনো দাম কমেনি। তাই বর্ধিত দামেই বিক্রি করছি। জেলা বাজার নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম জানান, বাজার পরিস্থিতি এখনও আগের মতোই রয়েছে। তবে দু-একদিনের মধ্যেই বাজারে চালের দাম কমে আসবে।
ঈশ্বরদী (পাবনা) প্রতিনিধি আলাউদ্দিন আহমেদ, জানান, উত্তরবঙ্গের অন্যতম বৃহৎ ঈশ্বরদীর জয়নগর চাল মোকামে দামের অস্থিরতা এখনও স্বাভাবিক হয়নি। চালের বাজার অস্থির থাকায় খুচরা ক্রেতাদের নাভিশ্বাস বাড়ছে। রাজধানী ঢাকার বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রভাব পড়েছে ঈশ্বরদীর মোকামেও। এর প্রভাব পড়ছে সাধারণ মানুষের ওপর। ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে বৈঠকের পরও এখানে কোনো সুফল আসেনি। এক সপ্তাহের ব্যবধানে এই মোকামে চালের দাম বেড়েছে বস্তাপ্রতি (৮৪ কেজি) ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত। দাম বাড়ার কারণে ঈশ্বরদী মোকাম ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়ছে। এক সপ্তাহ আগে যে চাল ৩৮০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে তা বুধ ও বৃহস্পতিবার ৪৩০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এই মোকামে চালের দাম আরও বেড়ে যাওয়ার আশংকায় ঈশ্বরদীর বাইরের ব্যবসায়ীরা চাল কিনতে আসছে না বলে মোকাম সূত্রে জানা গেছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমানে চালের বাজার অস্থিতিশীল। মোকামে চালের দাম বাড়ার কারণে খুচরা বাজারেও প্রকারভেদে দাম বেড়েছে প্রতি কেজিতে ৮ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত। জয়নগরের চাল ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন বাদশা বলেন, চালের দাম বৃদ্ধির কারণে বেপারি আসছে না।

https://www.jugantor.com/first-page/2017/09/21/157201