উখিয়ার গয়ালমারা আশ্রয়শিবিরে স্বজনদের খুঁজছেন এক রোহিঙ্গা শরণার্থী নারী
২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:১৮

এখনো জ্বলছে রোহিঙ্গাদের জনশূন্য বাড়িগুলো

বৃষ্টি ও ঝড়ে লণ্ডভণ্ড রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প; স্যানিটেশন ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সঙ্কট

প্রবল বাতাস, টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঝুপড়ি ঘরগুলো লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। নতুন বাসস্থানের সন্ধানে ব্যস্ত তারা। অনেক অস্থায়ী ক্যাম্পে জলাবদ্ধতা স্থায়ী রূপ ধারণ করেছে। রাস্তার পাশে তৈরি করা সব ঝুপড়ি ঘর সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এসব ঘরে অনেকেই সংসার শুরু করেছিলেন। রান্নাবান্নাও করেছিলেন কেউ কেউ। কিন্তু টানা বর্ষণের ফলে এখন তাদের রান্নাবান্না বন্ধ। এ দিকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য সরকার উখিয়া ও টেকনাফে আটটি লঙ্গরখানা খুলেছে।
গতকাল হাসপাতালগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, অসুস্থ মানুষের ভিড় দিন দিন বাড়ছে। গতকাল কাস্টমস ছড়ার মধ্যে একটি লাশ ভেসে যেতে দেখা গেছে। রোহিঙ্গারা বলেছেন, কে কোথায় মরে পড়ে থাকছেন তার খোঁজও কেউ রাখছেন না। অনেক রোহিঙ্গা এসেছেন পরিবার-পরিজন ছাড়া। আত্মীয়স্বজন কে কোথায় আছেন কেউ জানেন না।

এ দিকে গতকালও মিয়ানমার সীমান্তের অনেক এলাকায় আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। ওই সব এলাকায় যেসব রোহিঙ্গা ছিলেন তারা বলেছেন, এখন তাদের বাড়িগুলো জনশূন্য। সেসব বাড়িতে এখন বর্মি, সেনা ও নাডালা বাহিনী আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে। গতকাল উখিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ঘুরে দেখা যায় শরণার্থীদের জন্য ত্রাণের গাড়ি কমে আসছে। শরণার্থীরাও বলেছেন, ত্রাণের পরিমাণ দিন দিন কমছে। দিন যত যাবে তাদের সাহায্য ততই সঙ্কুচিত হয়ে আসবে বলে শরণার্থীরাও বুঝতে পেরেছেন।
এ দিকে রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা সম্পদ ভাগবণ্টন করা শুরু হয়ে গেছে। কোনো কোনো এলাকায় রোহিঙ্গাদের জমিজমা মগদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হচ্ছে। কোনো কোনো সীমান্তে মৃত্যুপুরীর মতো নীরবতা বিরাজ করছে।
লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে রোহিঙ্গাদের ঘর : গতকাল উখিয়ার কাস্টমস ছড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার ওপর তিন সন্তান নিয়ে বসে আছেন মিনারা। মিয়ানমারের বুচিডং এলাকায় তার বাড়ি। তার পাশেই একটি সিলভারের কলসি, বাঁশের কয়েকটি খুঁটি, একটি পেঁচানো ত্রিপল, দু’টি রান্নার পাতিল ও কাপড়ের পোটলায় পেঁচানো কিছু জিনিস। মিনারার স্বামীকে মেরে ফেলেছে বর্মি বাহিনী। তিন সন্তান নিয়ে আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের সাথে তিনি চলে এসেছেন সীমান্তের এপারে।
মিনারা জানালেন, কাস্টমস ছড়ার ৪১৮টি ঘরের মধ্যে তার ঘরও ছিল। গত শনিবার থেকে বৃষ্টির কারণে ওই ক্যাম্পে স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। ভেবেছিলেন হয়তো পানি কমবে। কিন্তু এখন আর সেখানে বসবাস উপযুক্ত নেই। শিশুসন্তানদের নিয়ে কোনোভাবে ঘরটি খুলে এপারের রাস্তায় এনে বসে আছেন। সকাল থেকে কাউকে খুঁজছেন অন্য কোথাও যেতে তাকে সহায়তার জন্য। কিন্তু কাউকে পাচ্ছেন না। এখন আর সাহায্যকারীরাও নেই। গত ৭ সেপ্টেম্বর তিনি বাংলাদেশে প্রবেশের পর অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলেন। এপারের স্বেচ্ছাসেবীরা তাকে ওই এলাকায় আসতে সহায়তা করেছেন। তাকে ঘর তৈরির জন্য সরঞ্জাম দিয়েছেন। এখন ঘর সরানোর জন্য কারোরই সাহায্য পাচ্ছেন না।
পাহাড়ের গায়ে যেসব ঘর তৈরি করা হয়েছে, সেগুলো কয়েক দিনের বৃষ্টি আর বাতাসে তছনছ হয়ে গেছে। ঘরের ছাউনি উড়ে গেছে, বেড়ার পলিথিন ছিঁড়ে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে গেছে, পানি জমে ঘরের মেঝ স্যাঁতসেঁতে হয়ে গেছে। ঘরগুলো এখন বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে।

লাশ ভাসছে পাহাড়ি ছড়ায় : কাস্টমস ছড়া পার হয়ে এপারে প্রধান সড়কে ওঠার জন্য একটি বাঁশের সাঁকো নির্মাণ করেছেন শরণার্থীরা। গতকাল দুপুরের দিকে দেখা যায় ভাসতে ভাসতে একটি লাশ ওই সাঁকোতে আটকে আছে। কয়েকজন রোহিঙ্গা কিশোর লাশটি পাশেই টেনে তোলে। কিন্তু পরে লাশটি আবার নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। আবদুস শুকুর নামের এক কিশোর বলে, ওই লাশ তারা কোথায় দাফন করবে? তার চেয়ে লাশটি নদীতে ভাসিয়ে দেয়াই ভালো। লাশের পরনে কিছুই ছিল না। তবে গায়ে একটি চেক শার্ট আছে। ওই এলাকার শরণার্থীরা বলেন, তারা কেউ মৃত ব্যক্তিকে চেনেন না। হয়তো অন্য কোথাও মারা গেছেন তিনি। পরে লাশটি পাহাড়ি ছড়ায় প্রবল স্রোতে ভেসে এসেছে। সেখানকার রোহিঙ্গারা বলেন, লাশটি দাফন কাফনের সঙ্গতি নেই বলেই তারা কেউ দায়িত্ব নিতে চাচ্ছেন না।

জনশূন্য ঘরেও আগুন দিচ্ছে বর্মি বাহিনী : সীমান্তের এপারে বাংলাদেশের আঞ্জুমানপাড়া আর ওপারে মিয়ানমারের মংডুর চাকমাকাটা এবং ঢেকিবুনিয়া। গতকাল ওই সীমান্তে গিয়ে দেখা যায় ওপারে চারটি স্থানে আগুন জ্বলছে। ঢেকিবুনিয়ার বাসিন্দা নুরুল আমিন জানালেন, ওই সব এলাকায় আর কোনো মুসলমান অবশিষ্ট নেই। অনেককে বর্মি সেনা ও নাডালা বাহিনী মেরে ফেলেছে এবং অবশিষ্টরা সবাই চলে এসেছেন এপারে আশ্রয়ের জন্য। যে স্থানটিতে আগুন জ্বলছিল ওখানেই নুরুল আমিনের বাড়ি। নুরুল আমিন তার স্ত্রী, দুই সন্তান ও বাবা-মাকে নিয়ে ২৭ আগস্ট বাংলাদেশে চলে আসেন। তিনি জানান, এখন ওখানের জনশূন্য বাড়িগুলোতে আগুন দিচ্ছে বর্মি বাহিনী। শাহপরীর দ্বীপে গতকাল আশ্রয় নেয়া কয়েকজন রোহিঙ্গা বলেছেন, তারা ঘরবাড়ি ছেড়ে আশপাশের ঝোপজঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারা মনে করেছিলেন পরিস্থিতি শান্ত হলে তারা ফিরে যাবেন বাড়িতে। বর্মি সেনারা প্রথম দিকে ঘরে মানুষ না পেয়ে সেগুলোতে আগুন না দিলেও পরে জনশূন্য ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়।
রোহিঙ্গাদের সম্পদ ভাগ করে দেয়া হচ্ছে মগদের মধ্যে : কয়েকজন রোহিঙ্গা শরণার্থী বলেছেন, তারা যে ঘরবাড়ি, সম্পদ রেখে এসেছেন তার মধ্যে যা সরানো যায় তার সবই লুটপাট করে নিয়ে গেছে বর্মি সেনা ও নাডালা বাহিনীর সদস্যরা। এখন তাদের জমিজমাও মগদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হচ্ছে। তারা যে ফসলি জমি রেখে এসেছিলেন, তাও দখল করে নিয়েছে মগরা। অনেক জমিতে তারা ধানসহ বিভিন্ন ফসল ফলিয়েছিলেন। ওই জমিও এখন মগদের দখলে। মংডুর ঢেকিবুনিয়া এলাকার বাসিন্দা নুরুল আমিন বলেন, তাদের এলাকায় কোনো মগ ছিল না। ২০১২ সালে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর মগদের হামলার সময় অনেক মুসলমান ভিটেমাটি ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাদের অনেকে ফিরে গিয়ে সম্পত্তি ফিরে পাননি। নুরুল আমিন বলেন, ওই সময় তাদের এলাকায় ১২০ ঘর মগের বসতি করে দেয় বর্মি বাহিনী। মুসলমানদের জমিজমা ওই ১২০ পরিবারের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হয়েছে তখন।

কমে আসছে ত্রাণের গাড়ি : গত ১০ দিন উখিয়া, টেকনাফ ও নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিদিনই অসংখ্য গাড়ি এসেছে ত্রাণ নিয়ে। ত্রাণের গাড়ির জন্য রাস্তায় জ্যাম লেগে যেত। শত শত গাড়ি ত্রাণ নিয়ে এসেছে। কিন্তু গতকাল দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। ত্রাণবাহী গাড়ি হাতেগোনা। কাস্টমসছড়া এলাকার শরণার্থী হাফেজ সুলতান বলেন, ক্রমেই কমে আসছে ত্রাণের গাড়ি। এভাবে আর কয়দিন পরে হয়তো তাদের এক বেলা খাবারও জুটবে না।

গড়ে উঠছে নতুন ক্যাম্প : গতকাল উখিয়ার পালংখালী গয়ালমারা এলাকায় দেখা যায় নতুন করে পাহাড়ের ওপর গড়ে উঠছে রোহিঙ্গা ক্যাম্প। সেখানে নতুন ঘর নির্মাণ হচ্ছে। বসানো হচ্ছে টিউবওয়েল ও টয়লেট।
কোনো কোনো সীমান্তে মৃত্যুর নীরবতা : গতকাল আঞ্জুমানপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায় একেবারেই জনমানবশূন্য। এই এলাকা দিয়ে পাঁচ দিন আগেও হাজার হাজার শরণার্থী প্রবেশ করেছেন। নাফনদী হয়ে এসব শরণার্থী প্রবেশ করে বাবুল মিয়ার মাছের ঘেরের বেড়িবাঁধে ঘর তুলেছিলেন। বৃষ্টির পানিতে ওই বেড়িবাঁধ এখন কানায় কানায়পূর্ণ। বেড়িবাঁধের সেই রোহিঙ্গাদের ঘরগুলোও সরিয়ে ফেলা হয়েছে। জানা গেছে, সেখানে যারা আশ্রয় নিয়েছিলেন তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এখানে যারা শরণার্থী ছিলেন তাদের উখিয়ার গয়ালমারা এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
খোলা হয়েছে ৮টি লঙ্গরখানা : উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন স্থানে সরকারি নিয়ন্ত্রণে আটটি লঙ্গরখানা খোলা হয়েছে বলে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। নতুন আসা শরণার্থীদের ওইসব লঙ্গরখানা থেকে খাবার সরবরাহ করা হবে বলে জানা গেছে।

হাসপাতালে দীর্ঘ হচ্ছে লাইন : গতকাল উখিয়া ও টেকনাফের কয়েকটি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, আগের দিনের তুলনায় গতকাল লাইন বেড়েছে। ওইসব স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দায়িত্বরত ডাক্তাররা বলেন, অসুস্থদের লাইন কেবল দীর্ঘ হচ্ছে।
কমেছে শরণার্থীদের অনুপ্রবেশ : কোনো কোনো সীমান্ত দিয়ে শরণার্থী প্রবেশ একেবারেই থেমে গেছে। তবে শাহপরীর দ্বীপ হয়ে এখনো কিছু রোহিঙ্গা প্রবেশ করছেন। গতকাল ওই পয়েন্ট দিয়ে শ’পাচেক রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছেন বলে স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে।

ক্যাম্পে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, নেই গোসল করার ও খাওয়ার পানি
কক্সবাজার, টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ বিরাজ করছে। এগুলোতে নেই স্যানিটেশন ব্যবস্থা, গোসল করার ও বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি। কয়েক দিনের একটানা বৃষ্টিতে সবখানে নোংরা পরিবেশ। বাতাসে প্রকট দুর্গন্ধ। এমতাবস্থায় সংক্রামক ব্যাধি ছড়িয়ে পড়েছে উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে। এসব ক্যাম্পের লোকজন আক্রান্ত হচ্ছেন সর্দি, কাশি, নিউমোনিয়া, জ্বর, ডায়রিয়া ও চর্মরোগসহ নানা রোগে।
২৫ আগস্টের পর থেকে হাজার হাজার রোহিঙ্গা গোসল করতে পারেননি। তাদের শরীর থেকে বের হওয়া দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। আক্রান্ত হচ্ছেন নানা চর্মরোগে। কুতুপালংয়ের অনিবন্ধিত একটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝি আবদুর রশিদ জানান, তাদের ক্যাম্পে প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গা গত ২০ দিন ধরে গোসল করতে পারছেন না পানির অভাবে। খাবার পানিরও তীব্র সঙ্কট। এ ছাড়া টয়লেট না থাকায় মহিলাদের বেশি কষ্ট হচ্ছে। রাতের অন্ধকার হলেই তারা প্রাকৃতিক কাজে যেতে পারছে; কিন্তু দিনের আলোতে তাদের কষ্টের সীমা থাকছে না।

গতকাল বুধবার জেলার উখিয়া উপজেলায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় নেয়া বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, বৃষ্টিতে সব তাঁবুসহ সবখানে স্যাঁতস্যাঁতে অবস্থা। কোথাও আবার জমে থাকা পানি। পরিবেশ এমন নোংরা হয়ে গেছে যে সেখানে মানুষ দূরের কথা, কোনো জীবজন্তুর পক্ষেও বসবাস করা কঠিন হবে। এমনি এক পরিবেশে পলিথিনের তাঁবুতে ঘুম, খাবার, জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে থালা বাসন ধোয়া, মলমূত্র ত্যাগ সবই চলছে। পানির অভাবে গোসল নেই অনেক দিন। শিশু ও পুরুষ এখানে সেখানে মলমূত্র ত্যাগ করলেও মহিলাদের কষ্টের সীমা নেই। তাদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে রাতের অন্ধকারের জন্য। অন্ধকার নামলেই কেবল তারা প্রাকৃতিক কাজ সারতে পারছেন।
ছড়িয়ে পড়ছে রোগব্যাধি : প্রতিটি রোহিঙ্গা তাঁবুতে রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়ায় স্বাস্থ্যকর্মীদের পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র অপর্যাপ্ত হওয়ায় প্রতিটিতে দীর্ঘ লাইন। অবস্থা এমন হয়েছে যে জরুরিভাবে ব্যবস্থা না নিলে এসব ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গাদের রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

কুতুপালংয়ের কাছে একটি পলিথিনের তাঁবুতে স্বামী সন্তানসহ পাঁচজনের বসবাস রোহিঙ্গা নারী জয়নবের। স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে খাওয়া ও বিশ্রাম। সেখানেই মলমুত্র ত্যাগ। পনের দিন ধরে কেউ গোসল করতে পারেননি। তিন-চার দিন ধরে জয়নব ও সন্তানরা সর্দি, জ্বর ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। প্রায় সব রোহিঙ্গা পরিবারের একই অবস্থা। সঠিক চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ না পাওয়ায় রোগব্যাধি ছড়াচ্ছে ব্যাপকভাবে। একবেলা আহারের সংস্থানের চেষ্টার পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের এখন লড়তে হচ্ছে রোগব্যাধির বিরুদ্ধেও।
আক্রান্তরা আশ্রয়স্থল কিংবা অনেক দূরে মেডিক্যাল ক্যাম্পে গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। মেডিক্যাল ক্যাম্প পরিচলনাকারী ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা রোগীর ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। চিকিৎসা দিলেও ঘাটতি থাকায় অনেককে ওষুধ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। গতকাল দুপুরে কুতুপালংয়ের একটি পাহাড়ে স্থাপিত হোপ ফাউন্ডেশনের একটি মেডিক্যাল ক্যাম্পে দেখা যায় রোহিঙ্গাদের দীর্ঘ লাইন। এদের বেশির ভাগ নারী ও শিশু। লাইনে দাঁড়ানো মায়ের কোলের শিশুরা সর্দি কাশির সাথে ডায়রিয়াও আক্রান্ত। প্রত্যেকের জ্বর ও ডায়রিয়া।

সেখানে এক স্বাস্থ্যকর্মী জানান, ঠাণ্ডাজনিত রোগ ছাড়াও ডায়রিয়া, চর্মরোগ ও বহু যক্ষ্মা রোগী পাওয়া যাচ্ছে। রইক্ষ্যং এলাকায় বিজিবি পরিচালিত মেডিক্যাল ক্যাম্পের পরিচালক লে. কর্নেল ডা: নুরে আলম জানান, চিকিৎসা নিতে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে ডায়রিয়া ও চর্ম রোগ ছাড়াও অনেক যক্ষ্মা রোগী পাওয়া যাচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা এসব রোগীর তাৎক্ষণিক ব্লাড টেস্ট করছি। ম্যালেরিয়া, হেপাটাইটিস বি সি জাতীয় রোগ ধরা পড়লে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তিনি আরো বলেন, রোগগুলো সংক্রামক আকারে ছড়াতে পারে।

কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা: মোহাম্মদ শাহীন আবদুর রহমান চৌধুরী বলেন, এখন প্রতিদিন অনেক রোহিঙ্গা জটিল রোগ নিয়ে সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসছেন। তাদের চিকিৎসা দিতে কোনো গাফলতি করা হচ্ছে না। গত সোমবার একজন (পরিচয় গোপন রাখা হলো) এইডস রোগীও ভর্তি হয়েছেন সদর হাসপাতালে। ধর্ষণের কারণে নানা জটিলতায় আক্রান্ত রোগীরাও আসছেন সদর হাসপাতলে। এসব রোগীকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা।

কক্সবাজার জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, রোহিঙ্গাদের মধ্যে এ পর্যন্ত পোলিও আক্রান্ত ২৬ জন, হামে আক্রান্ত ১৬ জন ও অসংখ্য চর্ম রোগী পাওয়া যাচ্ছে। এ পরিসংখ্যান কয়েকদিন আগের। এ সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: মেজবাহ উদ্দিন আহমদও কুতুপালং রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরগুলোতে পোলিও রোগীর সন্ধান পাওয়ার কথা জানান। তিনি জানান, ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশ পোলিওমুক্ত রয়েছে। কিন্তু শরণার্থীদের মাধ্যমে এসব রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তাই দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।

ধর্ষিতা রোহিঙ্গা নারীরা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে : মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে ধর্ষিতা রোহিঙ্গা নারীদের জন্য আলাদা চিকিৎসাব্যবস্থা না থাকায় ওই সব নারী মারাত্মক কষ্টে রয়েছেন। লোকলজ্জার ভয়ে তারা এসব কথা প্রকাশও করতে পারছেন না বলে জানান এক রোহিঙ্গা নারী। তিনি দুই সন্তানের জননী এবং তার কোলে রয়েছে আট মাসের সন্তান। তিনি আছেন কুতুপালংয়ের একটি অস্থায়ী ক্যাম্পে। তিনি বলেন, ‘আমাকে বার্মার সেনারা ‘জুলুম’ করেছে। জুলুম মানে কী প্রশ্ন করা হলে তিনি কিছুটা দ্বিধার সাথে বলেন, ধর্ষণ’। তার মতো অনেক রোহিঙ্গা নারী বাংলাদেশে এসে লোকলজ্জার ভয়ে চিকিৎসাসেবা নিতে পারছেন না বলে জানান চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা।

অনেক রোহিঙ্গা নারী জানান, সেনাবাহিনীর হামলার সময় যারা পালিয়েছিলেন তারা প্রাণে বেঁচে গেছেন। আর যারা পালাতে পারেননি তারা প্রত্যেকে ‘জুলুমের’ (ধর্ষণ) শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে কেউ নিহত হয়েছেন, কেউ ধর্ষণের যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছেন। পালিয়ে আসা এক নারী (পরিচয় গোপন রাখা হলো) জানালেন তার ওপর বীভৎস নির্যাতনের কথা। তিনি বলেন ‘জুলুমের’ পর আমরা সীমাহীন কষ্ট সহ্য করে বাংলাদেশে এসেছি। এখানে এসে আমার মতো অনেক নারীই চিকিৎসা নিতে চেয়েছেন। কিন্তু চিকিৎসা পাচ্ছি না। আমি নির্যাতনের পরেও বেঁচে গিয়েছি। কিন্তু অনেক মেয়েকে সেনারা ধর্ষণের পর হত্যা করেছে’।

এ বিষয়ে উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: মেজবাহ উদ্দিন আহমদ জানান, এ পর্যন্ত ১৮ জন ধর্ষিতা নারী উখিয়া স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন। কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে অনেক নারী মুখ না খোলায় তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তিনি জানান, স্বাস্থ্যকর্মীরা এখন ক্যাম্পে ক্যাম্পে গিয়ে খোঁজ নিচ্ছেন এসব নির্যাতিত নারীদের। ডা: মেজবাহ উদ্দিন বলেন, নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গা নারীদের শনাক্ত করে চিকিৎসা দিতে না পারলে তারা বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়বেন।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/253450