২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:০৩

দেশ-জাতির জন্য দোয়া করুন

বিবিধ প্রসঙ্গ

মাসুদ মজুমদার

ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসকে ধন্যবাদ। রোহিঙ্গা ইস্যুতে তিনি তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয় প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। নোবেল লরিয়েটদের সঙ্ঘবদ্ধ করে তাদের ভাবমর্যাদা মানবিক কাজে লাগাতে তিনি এতটুকু বিলম্ব করেননি। তা ছাড়া বিশ্ববিবেকের বদ্ধ দুয়ারে প্রথম তিনিই কড়া নাড়লেন। দেশ-জাতি ও মানবতার প্রতি তার এই দায়বদ্ধতা কৃতজ্ঞচিত্তে সবার স্মরণ করা উচিত। ডক্টর ইউনূস কফি আনান কমিশনের মূল সুরটা যে রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান নিশ্চিত করবে, এ দিকটা আবার সবার নজরে আনলেন। যদিও কফি আনান কমিশনের সীমাবদ্ধতা প্রচুর। তার পরও এর ইতিবাচক দিকটি সামনে রাখা যায়। বলা চলে ড. ইউনূস সরকারকে একটি প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করলেন।

বাংলাদেশের অনেক বুদ্ধিজীবীকে এবারো দেখলাম তারা যে বিবেক বিক্রি করে দিয়েছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সম্ভবত সরকারের প্রথম দিকের পুশব্যাক নীতিকেই তারা সমর্থন জানাতে পারলে খুশি ছিলেন। অনেক আগেই তাদের মধ্যে বাম ঘেঁষা ক’জনের ভূমিকা পূর্বাপর ইতরপ্রাণীর মতো। এর বিপরীতে ক’জন বুদ্ধিজীবীর মানবিক ভূমিকা মনে রাখার মতো। মানবতার বিপর্যয়ের সময় জাত বিচার চলে না। বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর দায় সবার আগে। বামপন্থীদের মানবতার প্রতি মমত্ববোধ একসময় স্বীকৃত ছিল, এখন সেই দিন নেই। সৈয়দ আবুল মকসুদদের সাহসী ও মানবিক ভূমিকা দেখেও তারা লজ্জা পেলেন না। এ ধরনের মানুষ জাতির কোনো কাজে লাগে না। জাতি এদের কথা মনেও রাখে না। তাদের ভাগ্য এক সময় তাদেরই নির্ধারণ করতে হবে। জনগণ কোনো দায় নিতে আগ্রহী হবে না। দু’চারজন দলকানা বুদ্ধিজীবী লেখালেখির সাথে জড়িত, কত ইস্যুতে তাদের চোখের পানি ঝরে, এ ক্ষেত্রে তাদের মন যেন পাথরের মতো, লক্ষ বছর পানিতে ভিজেও নুড়ি পাথর যেমন এক কাতরা পানি পায় না, এদের অবস্থাও তাই। নিষ্ঠুরতা ও পাপাত্মার উপমা এখন মিয়ানমারের সু চি। সামরিক বাহিনীর মুসাবিদা করা ভাষণ পড়ে সু চি ভাবছেন সাহসী মানুষের উপমা হবেন। বাস্তবে তিনি ব্যবহৃত হলেন, একসময় চোখ খুলে তিনি দেখবেন তার জাতিকে তিনি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন, তার হাত দিয়ে ইসরাইলের মতো বিষবৃক্ষ রোপণ করিয়ে নিলো অস্ত্র ও মাদক ব্যবসায়ীরা। আশা করি, আমাদের নেতা-নেত্রীরা কেউ রাুসীর উপমা হবেন না।

সরকারদলীয় মুখপাত্রদের উসকানির মুখে খালেদা জিয়াও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিলেন। বিশ্বের স্নায়ুকেন্দ্রে বসে তিনি কূটনীতিক ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে দেশ জাতির স্বার্থ সংরক্ষণে তার গুডবুক কাজে লাগিয়েছেন। কখন দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় দায়িত্ব পালন করতে হয়Ñ এটা বোঝার মতো রাজনৈতিক দূরদর্শিতা প্রদর্শন চাট্টিখানি কথা নয়।
সংসদ বসল স্বল্পসময়ের জন্য। জাতীয় সংসদ জাতীয় দায়িত্ব পালন করতে এবারো কার্পণ্য প্রদর্শন করল। তবে জাসদ নেতা মাঈনুদ্দীন খান বাদলের অকপট উচ্চারণ ভালো লেগেছে, জাত-পাত ও ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে মানবতার প্রতি তার এই দরদি ভাবনাটা সমর্থনযোগ্য। অন্যদের কাছে রোহিঙ্গা ইস্যুর চেয়ে ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে খিস্তিখেউড় এতটা প্রাধান্য পেলÑ যেন এটা জাতির মরা-বাঁচার ব্যাপার। অথচ চাল সঙ্কট ও খাদ্যনিরাপত্তা আলোচনায় প্রাধান্য পেল না। এবার খাদ্য সঙ্কট মোকাবেলায় ব্যর্থ হলে দুর্ভিক্ষ ঠেকানো যাবে না। তখন সরকার পতনের জন্য তৃতীয় কাউকে বিউগল বাজাতে হবে না।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশ্বসম্প্রদায় জাগলেও সমাধান ধীর তাল লয়ে এগোবে। সঙ্কটের জমাট বাঁধা বরফ গলবে বিলম্বে। সংসদ সদস্যরা এই সঙ্কটের গভীরতাটা আঁচই করতে পারলেন না। জাতির সংবেদনশীল মনে দাগ কেটে দিয়ে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে পরিস্থিতির মোকাবেলায় সংসদ কোনো অবদানই রাখল না। তার চেয়ে প্রধানমন্ত্রী ক’দিন বিলম্বে হলেও সমস্যাটা আঁচ করতে পারলেন। খাদ্য সঙ্কট ও রোহিঙ্গা ইস্যু মুলতবি রেখে এখন কারো ভোটের রাজনীতি করাটা ভোটার মনে নেতিবাচক দাগ কাটবে। বিএনপি-জামায়াত জোটকে দুষলে ভোটার মনে কোনো রেখাপাত করবে না, বরং খাদ্য সঙ্কট ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিকে ঐক্যের ডাক দিলে লাভবান হবেন বেশি।

রাজপথের সক্রিয় কর্মী হওয়ার কারণে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের আঁচটা সরাসরি অনুভব করেছি। গৃহিণী যেমন উনুনের গরম আঁচ বেশি অনুভব করেন, আমরা তেমনটি করেছি। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সের ভেপুটা এখনো কানে বাজে। সে সময়ে বঙ্গবন্ধুর অসহায়ত্ব প্রকাশ পেয়েছিল। তিনি তখন রিলিফ চুরির প্রসঙ্গ টেনে বক্তব্য রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন। ‘শেখের মাথায় জুলিও কুরি আমরা সবাই ভাতে মরি’Ñ এ সেøাগান আমরা যারা শুনেছি, এখনো তাদের গা শিউরে ওঠে। সম্ভবত মঈনুদ্দীন খান বাদলও এই সত্যটি জানেন এবং মানেন।
চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ যাদের স্মৃতিতে নেই, অভিজ্ঞতায় নেইÑ তারা জানবেন না ভুখানাঙ্গা মানুষের রোষ কতটা ভয়াবহ হতে পারে। ক্ষোভের আগুনের দাহ্য শক্তি কতটা লেলিহান শিখা জ্বালাতে পারে। জাসদের দ্রোহের মশাল যা পারেনি, তা পেরেছে ুধার্ত মানুষের পেটের আগুন।

ক্ষমতার পাটাতনে বসে তখনো কেউ কেউ পিশাচের মতো হেসেছেন। হায়েনার মতো রিলিফ চুরি করে বড়লোক সেজেছেন। তখন আমরা ছিলাম সাত কোটি, এখন ষোলো কোটি। তখন বাড়তি ছিল গ্রাম থেকে শহরমুখী মানুষের স্রোত। তাও তারা ছিল দেশের ভেতরের মানুষ। সাত কোটির অংশ। এখন লাখ লাখ রোহিঙ্গা। আন্তর্জাতিক সাহায্য এখনো সীমিত। সেই সাহায্য বিতরণে প্রশাসনের কোনো দৃষ্টিগ্রাহ্য ভূমিকা নেই। দেড় সপ্তাহ আগে পরামর্শ রেখেছিলাম, জাতিসঙ্ঘ শান্তি মিশনে কাজ করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেনÑ এমন সেনাসদস্যদের কাজে লাগান। সিভিল প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে ত্রাণ গ্রহণ-বিতরণ ও শরণার্থী ব্যবস্থাপনায় আমাদের সেনাসদস্যদের সহযোগিতা নিন। বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন-সংস্থাকে ত্রাণকাজে শরিক করুক। হাতিরঝিলসহ অসংখ্য প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করেছেন সেনাসদস্যরা। বিশেষ প্রয়োজনে তারা রাজপথের শৃঙ্খলার কাজেও সাফল্য দেখিয়েছেন। মিয়ানমার সীমান্ত এখন এতটাই স্পর্শকাতর যে, এমনিতেই সেনাসাহায্য নেয়া প্রয়োজন। সেটা প্রয়োজন যুদ্ধের জন্য নয়, উত্তেজনা প্রশমনের জন্য। কোনো উসকানির মুখে বাংলাদেশ যুদ্ধবাদী নীতির দিকে যেতে পারে না। মনে রাখা ভালো, শরণার্থী ব্যবস্থাপনার মতো জটিল বিষয় দলবাজ প্রশাসন সামাল দিতে গিয়ে শত শত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্ম দেবে। এলাকার খুদকুঁড়াখোর রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা দল ও সরকারের জন্য দুর্নাম কুড়াবে। দুর্নীতির ডালপালা গজিয়ে তোলা হবেÑ যা বিশ্ব সম্প্রদায়কে বিগড়ে দেবে। তাতে ক্ষোভের অগ্নিগিরিতে অগ্ন্যুৎপাত বেড়ে যাবে। রিলিফ চুরির অভিশাপ আর খাদ্য সঙ্কটের দুঃসহ যন্ত্রণাই নৌকা ডোবানোর জন্য যথেষ্ট হবে।

বাজিকরদের দৌরাত্ম্য সবার জানা। টেন্ডারবাজদের কথা কেউ ভুলে যায়নি। সরকার সৃষ্ট অনেক ক্ষত এখনো দগদগে অবস্থায় রয়েছে। দোহাই, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, ভিন্নমতাবলম্বী দমন-দলনের সময় শেষ। এখনো গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতার পরীক্ষিত পথকে এড়িয়ে একরোখা দৈত্যের মতো আচরণ করলে রাশেদ খান মেনন যেমন ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা ভাবছেনÑ তেমনটি অবশ্যম্ভাবী হয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। একই ধরনের শঙ্কা ও আশঙ্কার কতা ওবায়দুর কাদের বহুবার ব্যক্ত করেছেন। এখন সেসব বিতর্কে জড়িয়ে যাওয়ার দায় একটু কম।

দেশ জাতি কয়েকটি কঠিন সঙ্কটের কবলে পড়েছে। ক. খাদ্য নিরাপত্তা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। খ. রোহিঙ্গা ইস্যু অনেক দূর যাবে। গ. আপিল বিভাগের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে সংসদ। এর আগে নির্বাহী বিভাগ বিতর্কটিকে একটি বিব্রতকর অবস্থার দিকে নিয়ে গেছে। সংসদে প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের বিরুদ্ধে যেসব অশোভন আলোচনা হয়েছে স্পিকার সেসব এক্সপাঞ্জ করবেন কি না এ এক বিরাট জিজ্ঞাসা। এটা রায়ের পর্যবেক্ষণের মতো পরিণত কিছু নয়, বলা চলে বিচার বিভাগ ও প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে মেঠো হুমকির মতো। ঘ. দুর্নীতি রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা পাচ্ছে, এটা গৌণ বিষয় নয়। ঙ. সামাজিক অবক্ষয় অনাচারকে ডেকে এনেছে। সর্বোপরি জাতীয় ঐক্য বিঘিœত করার মতো লোক এখনো কম নেই। কোনো কোনো রোমান্টিক বামপন্থী যারা কারো বন্ধু হলে তার যেমন আর শত্রুর প্রয়োজন হয় না, তেমনি নীতিভ্রষ্ট কিছু শ্রেণীচরিত্রহীন মানুষ নৌকায় ভর করেছে। তাই সামনের পথ চলায় জাতীয় ঐক্যকে প্রাধান্য দেয়ার স্বার্থে অনেক কিছু বিবেচনায় নিতে হবে।
বাংলাদেশ কারো কাছে মাথা নত করবে না। কিন্তু পড়শিদের প্রতি অসম্মানও দেখাতে যাবে না। তবে জাতীয় স্বার্থে একচুল ছাড় দেয়ারও কোনো দায় নেই। এটা শাসক এবং রাজনীতিবিদদের বিশেষ বিবেচনায় নিতে হবে। জনগণের উচিত এখন দেশ-জাতির জন্য দোয়া করা, আল্লাহ যেন সবার সুমতি দেন। আজ জাতিসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশনে ভাষণ দেয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী যেন দেশ-জাতির স্বার্থের প্রতিফলনটা সঠিকভাবে ঘটাতে পারেন।
masud2151@gmail.com

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/253428