বৃষ্টিতে ঝুপড়িতে আশ্রয় নিয়েছে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুরা
২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৮:৫৬

সমালোচনায় মুখর বিশ্ব নেতারা

মিয়ানমার নেত্রী অং সান সু চি রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে গত মঙ্গলবার জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দেন তার তীব্র সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছে বিশ্ব। তিনি রাখাইনে মানবাধিকার লংঘনের নিন্দা করলেও এজন্য মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিষয়ে কোনো শব্দ উচ্চারণ করেননি। মিয়ানমার থেকে লাখ লাখ লোক সীমাহীন বর্বরতা ও নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসলেও তিনি বলেন, অধিকাংশ মুসলমান রাখাইনে আছে। হত্যা, নির্যাত, ধর্ষণের মুখে রোহিঙ্গারা পালিয়ে আসার ঘটনা বেমালুম চাপা দিয়ে বললেন, মুসলমানরা কেন পালাচ্ছে খুঁজে দেখতে হবে। সুতরাং সু চির এ ধরনের ভাষণে সমালোচনামুখর হয়ে উঠেছেন বিশ্ব নেতারা। বিবিসি/বাংলা ট্রিবিউন/শীর্ষনিউজ।

মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে যে ভাষণ দিয়েছেন তার সমালোচনা আসতে শুরু করেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকেও। মঙ্গলবারের ঔ ভাষণে সু চি রাখাইন রাজ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা করেছেন কিন্তু মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিষয়ে কিছু বলেন নি। অথচ রাখাইন রাজ্যে ভয়াবহ নির্যাতনের জন্য সেনাবাহিনীকেই দায়ী করছে রোহিঙ্গারা।

অভগস্টের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশেএসেছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। বাংলাদেশে আসতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে শতাধিক রোহিঙ্গার, আবার অনেকে এসেছেন যারা গুলিতে আহত হয়েছেন কিংবা বয়ে এনেছেন নিজের অগ্নিদগ্ধ শরীর। অথচ সু চি বলেছেন, অধিকাংশ মুসলিমই রাখাইনে অবস্থান করছে। তিনি মুসলিমরা সেখান থেকে পালাচ্ছে কেন সেটিও খুঁজে বের করার কথা বলেছেন। পরাহিঙ্গা সম্প্রদায়ের নেতারা ইতিমধ্যেই সু চির বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে এ বক্তব্যকে সেনাবাহিনীর বক্তব্য বলে আখ্যায়িত করেছেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন সু চিকে ফোন করে বলেছেন, তার বক্তব্যকে তিনি স্বাগত জানাচ্ছেন যে শরণার্থীদের যাচাই করে ফিরিয়ে নেয়া হবে। কিন্তু তিনি একই সাথে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার দিকেও নজর দিতে বলেন। ফরাসী প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ বলেছেন, ‘রাখাইনে সামরিক অভিযান অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। মানবিক সহায়তার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। জাতিগত নিধন বন্ধে আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে।’ তিনি বলেন সহিংসতা বন্ধ করে মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর জন্য তারা নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে একটি উদ্যোগ নেবেন।জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও সামরিক অভিযান বন্ধ করে রোহিঙ্গাদের ক্ষোভের দিকে দৃষ্টি দেওয়ার জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগান সংকট নিরসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, যতক্ষণ না পর্যন্ত ‘মিয়ানমার ট্রাজেডি’-র অবসান না হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের একজন মুখপাত্র বলেছেন, আন্তর্জাতিক কূটনীতিকদের মিয়ানমার পরিদর্শনে যে আহবান জানিয়েছেন সু চি, তা এক ধাপ অগ্রগতি। কারণ আগে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় যাওয়ার আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মেও রাখাইনে সামরিক অভিযান বন্ধ করার কথাই বলছেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সু চির সমালোচনা করে বলেছে, তিনি বালিতে মাথা গুঁজে আছেন।

পথ হারিয়েছে মানবতা পথ হারিয়েছেন সু চিও
সঙ্কট যেন ব্যুহ রচনা করেছে, দুর্ভেদ্য ব্যুহ এক। সঙ্কটমুক্তির কোনও পথই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চল থেকে রোহিঙ্গাদের বিপুল বহিঃ¯্রােত অনর্গল, অবিশ্রাম। কিন্তু যে দিকেই এগোচ্ছে এই জনগোষ্ঠী, সে দিকেই যেন এখন ঠাঁই নাই-ঠাঁই নাই রব। এই রব যে আদ্যন্ত কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট বা সঙ্কীর্ণতাজাত, তা-ও বলা যাচ্ছে না। পৃথিবীর যে প্রান্তে মানবতা এই গভীর সঙ্কটে আক্রান্ত আজ, সেই প্রান্তকে ঘিরে জনবিন্যাসের ছবিটা এমনই যে, লাগোয়া এলাকায় লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর জন্য পুনর্বাসনের ঠাঁই খুঁজে দেয়া বেশ শক্ত। কিন্তু বিরাট জনগোষ্ঠীর বাঁচার আর্তির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখার দংশনও কম যন্ত্রণার নয়। সঙ্কটে আজ শুধু রোহিঙ্গারা নন, সঙ্কটে বিশ্ব মানবতা। মিয়ানমারের সর্বময়ী নেত্রী আউং সান সু চি নীরবতা ভেঙেছেন অবশেষে। মিয়ানমারের সরকার দেশের প্রত্যেকটি সম্প্রদায়ের সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজতে চায়, আশ্বাস তার। কিন্তু সে আশ্বাসকে খুব বলিষ্ঠ মনে হয়নি অনেকেরই, রোহিঙ্গা নির্যাতনের আশু পরিসমাপ্তির আভাসও খুঁজে পাননি অনেকেই। বিশ্বশান্তির নোবেল পদক যাঁর কণ্ঠহার, তার রাজত্বে মানবতার এমন ভীষণ অপমান কীভাবে সম্ভব? এ বৈপরীত্যকে বিশ্ব মেনে নেবে কীভাবে? সু চি-ই বা মানছেন কী করে? প্রশ্ন উঠছিল গোটা বিশ্ব থেকে। তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছিল গণতন্ত্রের জন্য সুদীর্ঘ সংগ্রাম করে ইতিহাস গড়া নেত্রীকে।মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের সঙ্কট নতুন নয়, এ সঙ্কট ঐতিহাসিক। সামরিক শাসনে থাকা মিয়ানমারে অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন রোহিঙ্গারা, আজকের গণতান্ত্রিক মিয়ানমারেও হচ্ছেন। নাগরিক অধিকার নেই এই বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর। রয়েছে নিদারুণ দৈনন্দিন সংগ্রাম, অশিক্ষা, কর্মসংস্থানহীনতা। আর রয়েছে মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর অবিশ্বাস, অসহযোগিতা। এমন এক অবহেলিত, কোণঠাসা জনগোষ্ঠীর মধ্যে থেকে অসামাজিকতা, সাম্প্রদায়িকতা, গোঁড়ামি উঠিয়ে দেয়া সহজ নয়, বরং বেশ কঠিন। আলোকিত মানুষ হতে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। সেই শিক্ষার সুযোগই সেখানে নেই।একটা হামলার অভিযোগে রাষ্ট্রীয় বাহিনী কী করে একটি জাতিকে ধ্বংস করতে পারে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ার পর লক্ষ লক্ষ মানুষকে পাশের দেশে তাড়িয়ে দিচ্ছে। বিপুল জনসংখ্যা এবং উন্নয়নশীল অর্থনীতির বাংলাদেশের পক্ষে এই বিপুল সংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া প্রায় অসম্ভব। রোহিঙ্গারা ভারতে ঢুকতে চান। কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে এবং ইতিমধ্যেই বিভিন্ন দেশ থেকে আসা বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর চাপের কথা মাথায় রেখে ভারত সরকার তাঁদের আশ্রয় দিতে নারাজ। একা ভার নিতে চায় না মালয়েশিয়াও। রোহিঙ্গারা সুতরাং কারওরই নন আচমকা, নিজভূমে পরবাসী তো ছিলেনই দীর্ঘ সময়, আজ নিজভূম বলেও কিছু নেই তাদের। এই পৃথিবীতে যেন কোনও জায়গাই নেই তাঁদের জন্য। রোহিঙ্গারা আচমকা যেন এই পৃথিবীর কেউ নন। পৃথিবী কিন্তু বলছে না, রোহিঙ্গারা পৃথিবীর কেউ নন। রাজনৈতিক এবং সামাজিক বাস্তবতা বলছে কথাটা। ওই বাস্তবতার কারণেই মিয়ানমার ছাড়তে হচ্ছে রোহিঙ্গাদের। ওই বাস্তবতার জেরেই গৃহহারা লাখ লাখ মানুষ কোনও প্রতিবেশীর সহায়তা পান না।জঙ্গি কার্যকলাপ রয়েছে রোহিঙ্গাদের মধ্যে, অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু নিরীহ-নিরন্ন রোহিঙ্গার সংখ্যা তো তার চেয়ে অনেক বেশি। ঘর হারিয়ে, আত্মীয়-পরিজনের শব ডিঙিয়ে, অবসন্ন শরীর নিয়ে কোনোক্রমে বাংলাদেশে ঢুকেছেন অন্তঃসত্ত¦ারা। মাথার উপরে ছাউনি নেই, শিশু নিয়ে ভিজছেন নারীরা। পায়ের তলার জমিটা স্থায়ী কি না জানেন না, গতকাল বা পরশু খাবার জোটেনি, আজ এবং আগামিকালও হয়তো জুটবে না। বেঁচে থাকা যাবে কি না, সেটাই আসলে স্পষ্ট নয় তাদের কাছে। লাখ লাখ মানুষের অসহনীয় দুর্দশা দেখে প্রবল উৎকণ্ঠায় বিশ্ব জমনত। কিন্তু মানবতার এই ভয়ঙ্কর লাঞ্ছনার নিরসন কোন পথে, কারও জানা নেই এই মুহূর্ত পর্যন্তও। বিশ্ব মানবতা যেন পথ হারিয়ে ফেলেছে এক জটিল আবর্তে।

সু চির দাবিগুলো কতটা সঠিক?
মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি শেষ পর্যন্ত কথা বলেছেন রাখাইনের সহিংসতা ও শরণার্থী সংকট নিয়ে। কিন্তু ভাষণে তিনি যেসব দাবি করেছেন তা কতটা সঠিক না বিশ্লেষণ করেছেন বিবিসি সংবাদদাতা জোনাথন হেড, যিনি মিয়ানমার ও বাংলাদেশে সরেজিমন পরিস্থিতি দেখেছেন।
অং সান সু চি বলেছেন, ৫ই সেপ্টেম্বরের পর থেকে সেখানে (রাখাইনে) কোন সহিংসতা নেই।
জোনাথন হেড : ৭ সেপ্টেম্বর সরকারি ব্যবস্থাপনায় একটি মিডিয়া দলের অংশ হিসেবে আলেল থান খিয়াও শহরে গিয়েছিলাম। সেখানে অটোমেটিক রাইফেলের গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিলো এবং বড় ধরনের চারটি ধোঁয়ার লাইন দেখতে পাচ্ছিলাম যা নিশ্চিত ইঙ্গিত দিচ্ছিলো যে গ্রামগুলো আগুনে পুড়ছে। ওইদিনেই পরের দিকে আমরা যাই রোহিঙ্গা গ্রাম গাউ দু থার ইয়া যেখানে সশস্ত্র পুলিশের সামনেই বৌদ্ধদের লাগানো আগুন তখনো জ্বলছিল। পরে বাংলাদেশ থেকেও আমি নাফ নদীর ওপারে আগুনের ধোয়া স্পষ্টই দেখতে পাই।

অং সান সু চি : ধর্ম, বর্ণ বা রাজনৈতিক অবস্থান যাই হোক না কেন আইনের বাইরে গেলে বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য মানবাধিকার লঙ্ঘন করলে যে কারও বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জোনাথন হেড : বার্মার সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে এ অভিযোগ ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কিন্তু কখনোই কোন সামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। মংগদুতে একজন সেনা কর্মকর্তা আমাকে বলেছেন যে ধর্ষণের অভিযোগগুলো সত্যি নয় কারণ তার সৈনিকরা ব্যস্ত আর রোহিঙ্গা নারীরা আকর্ষণীয় নয়।
অং সান সু চি : রাখাইনে সব মানুষের কোন বৈষম্য ছাড়াই শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার অধিকার রয়েছে।
জোনাথন হেড : এটা নির্জলা মিথ্যা। রোহিঙ্গারা বহু বছর ধরেই বৈষম্যের শিকার। এমনকি তাদের যাতায়াত নিয়ন্ত্রিত। বিয়ে করতেও অনুমতি নিতে হয়, আবার সে অনুমতির জন্য ঘুষও দিতে হয়। ২০১২ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর থেকে তাদের ওপর বিধিনিষেধ আরও জোরদার করা হয়। অনেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে মিয়ানমারের মধ্যেই ক্যাম্পে অবস্থান করে। আমি জানি ক্যাম্পের শিশুগুলো পড়ালেখা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিলো পাঁচ বছরের জন্য। চার বছর আগে আমি একটি রোহিঙ্গা গ্রামে গিয়েছিলাম বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সহিংস আচরণের জন্য রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা নিতে যাওয়াও অসম্ভব ছিলো। জোনাথন হেড বলেন, গত সোমবারই বাংলাদেশে তার সাথে দেখা হয় মোহাম্মদ আব্দুল মজিদের। সে এসেছে গাউ দু থার ইয়া গ্রাম থেকে যেটিকে তিনি পুড়তে দেখেছেন ৭ সেপ্টেম্বর। আব্দুল মজিদ তাকে জানান যে গত পাঁচ বছর তারা কাজের জন্য গ্রামের বাইরে যেতে পারেননি।

রোহিঙ্গাদের অপেক্ষা
মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সাং সু চি জানেন না কেন এত সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমান পালিয়ে আসছে বাংলাদেশে। সুচি এ প্রশ্নের জবাব পাওয়ার জন্যে বাংলাদেশে ভ্রমণে এলেই টের পাবেন বিষয়টি। তার সেনাবাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধরা কি ধরনের আচরণ করেছেন নিরস্ত্র ও নিরীহ রোহিঙ্গা মুসলমানদের সঙ্গে তা স্পষ্ট চোখে দেখতে পাবেন কক্সবাজারে এসে হাসপাতালে গেলে। এজন্যে সুচি আমন্ত্রণের অপেক্ষা না করেই গণতন্ত্রী হিসেবে, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী হিসেবে তার দেশের জনগণ কি দশায় আছে দেখতে আসতে পারেন। সঙ্গে চীন, ভারত, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতাদের নিয়ে আসতে পারেন যারা তাকে প্রবল সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। হাসপাতালে সু চিসহ বিশ্বনেতারা আসলে দেখতে পাবেন মিয়ানমার সেনাদের দেয়া আগুনে ঘরবাড়ি পুড়েছে, মানুষ পুড়েছে। দেখতে পাবেন পোড়া শিশু এখনো তার মায়ের কোলে বেঁচে থাকার আশায় নিস্পলক চোখে তার অপরাধ কি সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে। তার হাত ও পা পুড়ে গেছে। হরর ফিল্ম দেখার মত অনুভূতি হতে পারে বিশ্বনেতাদের।কক্সবাজারের সদর হাসপাতালে গেলে এই বিশ্ব নেতারা অবশ্যই তাদের বক্তব্যে রোহিঙ্গা নিয়ে কথা বলতে শুরু করবেন। এ কথা হলফ করে বলা যায়, কারণ তারাও মানুষ। পোড়া রোহিঙ্গাদের কাছে কোনো অস্ত্র ছিল না, তারা একেবারেই খেটে খাওয়া প্রান্তিক ধরনের মানুষ। মিয়ানমারের সেনারা এসেছে, এসেছে উগ্র বৌদ্ধরা। তাদের ঘরে পেট্রোল ঢেলেছে। তারপর সেনারা কাঁধ থেকে রকেট গ্রেনেড ছুড়েছে। গুলী বর্ষণ করেছে। মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীরা সদস্যরা প্রহরা দিয়ে রেখেছেন যতক্ষণ না রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি ভ্স্মীভূত না হয়। স্যাটেলাইট ইমেজে এসব ছবি মিডিয়ায় প্রকাশ হয়েছে আর সুচি বলছেন কেন রোহিঙ্গা মুসলমানরা বাংলাদেশে পালিয়ে যাচ্ছেন তা তিনি জানেন না। জাতিসংঘের অধিবেশনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মিয়ানমার বা রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করেননি। যেমন রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করেননি সুচি তার বক্তব্যে। ৩০ বছরের রোহিঙ্গা নারী শাহিদা বেগম হাসপাতালের বেড থেকে জানান, সেনারা এসে কিভাবে তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। ঘরের ভেতরেই ছিলেন তিনি। ঘর থেকে বের হওয়ার আগেই দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছে তার চারপাশ। তার শরীর দগ্ধ হয়েছে আগুনে। শাহিদা জানান, তার শরীরে ব্যথা ও জ্বালাপোড়া বলার মত নয়। এরচেয়ে মরে যাওয়া ভালো। রাসিডংএ ওই ঘটনার দুদিন আগে তার দুই ছেলেকে গুলী করে হত্যা করেছে মিয়ানমারের সেনারা। কারো জীবনে যেনো এধরনের দুর্গতি না নেমে আসে। এই হাসপাতালেই দিলদার বেগম তার ১০ বছরের মেয়ে নুর কলিমাকে নিয়ে ভর্তি হয়েছেন ৫ দিন আগে। পরিবারে তারা দু’জনই বেঁচে আছেন। দিলদার তার স্বামী, শাশুড়ি ও ছোট শিশু সন্তানকে হারিয়েছেন। গত ২৯ আগস্ট মিয়ানমারের সেনাদের নির্বিচার গুলীতে তারা প্রাণ হারিয়েছেন। সেনারা ও উগ্র বৌদ্ধরা ছুরি হাতে তাদের দিকে ছুটে আসে। তিন দিন জঙ্গলে পালিয়ে থাকার পর বাংলাদেশের দিকে রওনা দেন তারা। আট বছরের মোহাম্মদ আনাস মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসতে পারলেও তার মুখমণ্ডলের একপাশ পুড়ে গেছে। তার চাচা সাইদ আলম হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। তিনি জানান, মান্দুয়া জেলার লানখালি গ্রাম থেকে তারা এসেছেন। কুরবানির ঈদের ৩ দিন আগে সেনারা তাদের গ্রামে হামলা চালায়। পরিবারের ১০ সদস্যের ৪ জন এখনো নিখোঁজ।জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর বলছে গত কয়েক সপ্তাহে ৪ লাখ ২১ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের অনেকে মিয়ানমারের সেনাদের গুলীতে নিহত হয়েছে। নদীতে তাদের লাশ ভেসে যাওয়ার দৃশ্য আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশ পেয়েছে। তারপরও সু চি বলছেন, তিনি বুঝতে পারছেন না কেন রোহিঙ্গারা পালিয়ে বাংলাদেশে আসছে।
সু চির কথায় রাখাইনে ফিরতে চান না রোহিঙ্গারা

বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা মিয়ানমারে বসবাসের প্রমাণ হাজির করতে পারবেন, রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চি তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তার এই ঘোষণাকে অসম্ভব শর্ত সমন্বিত ‘মিথ্যে আশা’ বলে মনে করেছেন বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা। আর মিয়ানমারে ফেরার ইচ্ছেও তাদের নেই। রাখাইনে সেনাবাহিনীর হত্যা আর ধর্ষণের আতঙ্ক প্রতিনিয়ত তাদের তাড়া করতে থাকে।

২৫ আগস্ট নিরাপত্তা বাহিনীর চেকপোস্টে বিদ্রোহীদের হামলার পর ক্লিয়ারেন্স অপারেশন জোরদার করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। তখন থেকেই মিলতে থাকে বেসামরিক নিধনযজ্ঞের আলামত। পাহাড় বেয়ে ভেসে আসতে শুরু করে বিস্ফোরণ আর গুলীর শব্দ। পুড়িয়ে দেওয়া গ্রামগুলো থেকে আগুনের ধোঁয়া এসে মিশতে শুরু করে মৌসুমী বাতাসে। মায়ের কোল থেকে শিশুকে কেড়ে নিয়ে শূন্যে ছুড়ে দেয় সেনারা। কখনও কখনও কেটে ফেলা হয় তাদের গলা। জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয় মানুষকে। ওই সহিংসতা থেকে বাঁচতে এ পর্যন্ত ৪ লাখ ২০ হাজারের বেশি মানুষ বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। পালিয়ে আসা সেইসব মানুষই আশ্রয় নিয়েছে কক্সবাজার ও কুতুপালং আশ্রয়কেন্দ্রে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে এখন কয়েক লাখ রোহিঙ্গার বসবাস। মঙ্গলবার মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে সু চি বলেছেন, ‘আমরা জানতে চাই মুসলিমরা কেন দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। যদি মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনও ঘটনা ঘটে তবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ তবে বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গারা মনে করেন, এই প্রতিশ্রুতি অর্থহীন। খুব অল্পসংখ্যক রোহিঙ্গারা নিবন্ধন করেছেন। অস্ট্রেলীয় সংবাদমাধ্যম এবিসি নিউজ তাদের অনুসন্ধান থেকে জানতে পেরেছে দেশে ফিরে যেতে হতে পারে, এমন ভয় থেকেই নিবন্ধনে অনাগ্রহ রোহিঙ্গাদের। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বেশ ক’জন মানুষের সঙ্গে কথা বলেছে এবিসি নিউজ। খুব অল্পসংখ্যক রোহিঙ্গাই দেশে ফিরতে চেয়েছেন। বাংলাদেশ সরকার অবশ্য জানিয়ে দিয়েছে দীর্ঘমেয়াদে তাদের সহায়তা করা সম্ভব না এবং তারা চায় রোহিঙ্গারা যেন দেশে ফিরে যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ঘরবাড়ি হারিয়ে যেসব রোহিঙ্গা এখানে (বাংলাদেশে) এসেছেন, তারা সাময়িক আশ্রয় পাবেন। তাদের মিয়ানমারে ফিরে যেতে হবে। আপনারা যেন নিজ দেশে ফিরে যেতে পারেন, সে ব্যাপারে চেষ্টা চলছে।’
তবে বাংলাদেশেই নিরাপদ বোধ করছে রোহিঙ্গারা। ইসলাম হুসেন নামে এক রোহিঙ্গা বলেন, ‘এখানে থাকা হয়তো সত্যি কঠিন। কিন্তু আমাদের কেউ ধর্ষণের শিকার হচ্ছে না। হত্যার আতঙ্কে থাকতে হচ্ছে না আমাদের।’ সু চি তার বক্তব্যে কোথাও রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করেনি। রোহিঙ্গাদের নামোল্লেখ না করে তিনি বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে অনেক শরণার্থী বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে। যেকোনও সময় তাদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করতে আমরা প্রস্তুত।’ তবে রোহিঙ্গাদের মত, ফিরে গেলে আগের মতোই বিপাকে পড়তে হবে তাদের। হুসেন জানান, তারা ইচ্ছা করেই নিবন্ধন করছেন না। কারণ গুজব রয়েছে যে নিবন্ধন করলেই তাদের জোর করে দেশে ফেরত পাঠানো হবে।

http://www.dailysangram.com/post/300513