২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, বুধবার, ১০:৪৪

শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে নীরব চাঁদাবাজি

‘আমি কালাচান বলছি। ব্যবসা তো ভালোই চলছে তোর। জানিস তো আমাদের ব্যবসা ভালো না। পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে উপকার করবি, নইলে বিপদে পড়বি। দেখেছিস তো যারা আমার কথা রাখেনি তাদের কিভাবে ওপারে পাঠিয়ে দিয়েছি।’ এভাবে হুমকি-চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে খোদ রাজধানীতে। নীরবে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সন্ত্রাসীরা। এমন হাজার হাজার সাধারণ ডায়েরি রয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটনের বিভিন্ন থানায়। পুলিশও তৎপরতা চালাচ্ছে। তবু গ্রেপ্তার হচ্ছে না চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীরা। শীর্ষ সন্ত্রাসীরা সীমান্ত পেরিয়ে গেছে বেশ আগেই। দেশের বাইরে থেকেই চাঁদাবাজি করে যাচ্ছে তারা।

চাঁদাবাজদের মধ্যে শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাত, কালাচান, মহসিন, মিন্টু ও আশিকের নাম শুনলে কেঁপে উঠে মিরপুর, রূপনগর, পল্লবী, দারুসসালাম, কাফরুল ও তেজগাঁও এলাকার বাসিন্দারা। তাদের কিলার হিসেবে চিনেন সাধারণ মানুষ। তারা সবাই দেশের বাইরে থেকেই ফোনে চাঁদাবাজি করে। ঢাকায় তাদের প্রত্যেকের প্রায় অর্ধশত অনুসারী রয়েছে। প্রতিটি এলাকার লোকজন তাদের চিনতে পারলেও মুখ খুলতে ভয় পান। চাঁদা দাবির পরপর শুরু হয় নানা ধরনের উৎপাত। কখনও পিস্তলের গুলি, কখনও সাদা কাফন পাঠানো হয় টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে। এমনকি চাঁদাবাজদের অনুসারীরা ফোন দিয়ে তা আবার স্মরণ করিয়ে দেয়। অনুসরণ করে। এভাবেই আতঙ্ক সৃষ্টি করে চাঁদা আদায় করে তারা। সমপ্রতি মিরপুর-১১ এক ব্যবসায়ীর কাছে ফোন করে চাঁদা দাবি করেছে কালাচান। তিনি বিয়ের সরঞ্জাম বিক্রি করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যবসায়ী জানান, ফোন দিয়ে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছে কালাচান। বিষয়টি স্থানীয় নেতাকর্মীদের অবগত করলেও পুলিশে অভিযোগ করেননি। তিনি জানান, কালাচানের লোকজন অত্যন্ত বেপরোয়া। পুলিশে অভিযোগ করলে তাকে বাঁচতে দেবে না। দীর্ঘদিন থেকে এভাবেই নীরবে চলছে চাঁদাবাজি।

২০০৩ সালে মিরপুরে এক ব্যবসায়ীর বাসায় জোড়া খুনের ঘটনা ঘটে। তারপর থেকেই আলোচিত হতে থাকে কালাচান। এক সময় হয়ে যায় এক আতঙ্কের নাম। তারপরই মিরপুর-১ এলাকার প্রিন্স মার্কেটের মালিকের কাছে বড় অঙ্কের চাঁদা দাবি করে সে। প্রিন্স মার্কেটের মালিক চাঁদা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে প্রিন্স হোটেলের সামনেই গুলি করে হত্যা করা হয় তাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হন্যে হয়ে তাকে খুঁজলেও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। শেষ পর্যন্ত জানা গেছে, দুবাইয়ে আশ্রয় নিয়েছে কালাচান। সেখান থেকে টেলিফোনে চাঁদা দাবি করে। কালাচানের নাম শুনেই আতঙ্কে চাঁদা দেন অনেকে। চাঁদা গ্রহণ করে তার অনুসারীরা। নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডার মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নুর হোসেনও পালিয়ে ভারতে কালাচানের সহযোগী আশিকের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলো বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়।

দীর্ঘদিন থেকে মিরপুর এলাকায় প্রভাব বিস্তার করছিলো মহসিন। তার কারণে আতঙ্কে থাকতেন সাধারণ মানুষ। সূত্রমতে, ২০১৫ সালে মিরপুর-১১’র এভিনিউ পাঁচের একটি ফার্মেসির মালিক রাসেলের কাছে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছিলো মহসিন চক্র। চাঁদা না পেয়ে রাসেলকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে মিরপুর-১১’র প্যারিস রোডের বাসিন্দা সিমেন্ট ব্যবসায়ী তৈয়ব আলীর কাছে ভারতীয় ফোন নম্বর থেকে একটি কল আসে। তৈয়ব আলীর ছেলে রাজন জানান, তার বাবার কাছে সন্ত্রাসীরা চাঁদা দাবি করেছিলো। এমনকি একইভাবে তার কাছে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। কুখ্যাত চাঁদাবাজ ও কিলার মহসিনের নাম শুনেই কেঁপে উঠেছিলেন রাজন। কিন্তু এতো টাকা দেয়া সম্ভব ছিল না। তাই চাঁদা দিতে পারবেন না বলে জানান তারা। কিন্তু হুমকি-ধমকি থামে না। বেশকিছু দিন হুমকি-ধমকি দেয়ার পর রাজনের বড় ভাই সুমনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ বিষয়ে সোহাগ, মহসিন ও নাহিদকে আসামি করে মামলা করা হয়। ঘটনার পর অস্ত্রসহ সন্ত্রাসী সোহাগকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ছয় মাস পরেই গ্রেপ্তারকৃত সোহাগ হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে বের হয়ে যায়। ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় কিলার মহসিন। এ ঘটনার পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় সন্ত্রাসী মহসিন। একইভাবে তেজগাঁও কাওরানবাজার এলাকায় চাঁদাবাজি করতো আশিক। সেও এখন পলাতক। কিন্তু পালিয়ে যাওয়াই শেষ না। বরং পালিয়ে গিয়ে আরো বেশি প্রভাব বিস্তার করতে থাকে এসব সন্ত্রাসী। ভারতে থেকেই টেলিফোন করে বিভিন্ন ব্যবসায়ীকে। চাঁদা না পেয়ে গত বছরে এক ফার্মেসি ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পুলিশের ধারণা মহসিন ও তার অনুসারীরা এ ঘটনায় জড়িত।

ভুক্তভোগীরা জানান, ফোন করে অতীতের বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড স্মরণ করিয়ে দেয় এই সন্ত্রাসীরা। তারা হুমকি দিয়ে বলে, শুনিসনি অমুককে কিভাবে গুলি করে ওপারে পাঠিয়ে দিছি। বাঁচতে চাইলে ঝামেলা না করে টাকা দিয়ে দিস।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এসব সন্ত্রাসীর অনেকে পালিয়ে গেলেও ঢাকাতেই অবস্থান করছিলো মিন্টু। ওই সময়ে মিরপুর-১১ এর বাজারে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়েছিলো। এ ঘটনায় অনেকে আহত হন। এতে মিন্টুর সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়ে তাকে গ্রেপ্তার করতে অভিযান শুরু করে পুলিশ। ওই সময়ে পালিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নেয় মিন্টু। সেখান থেকেই চাঁদাবাজি করে যাচ্ছে বলে সূত্রে জানা গেছে। রাজধানীর শীর্ষ সন্ত্রাসী মুক্তার হাত ধরেই উত্থান ঘটেছিলো মিন্টুর। গত বছরে ব্রেনস্ট্রোক করে মারা গেছে মুক্তা। সন্ত্রাসীদের ভাষায় ‘তারপর থেকেই মুক্তার কোম্পানি চালাচ্ছে মিন্টু।’
ভুক্তভোগী এক নির্মাণ ব্যবসায়ী জানান, এলাকায় কেউ নতুন বাড়ি নির্মাণ করতে গেলেই সন্ত্রাসীরা ফোনে চাঁদা দাবি করে। খুব কম লোকই থানা- পুলিশমুখো হন। ওই ব্যবসায়ীর কাছেও কিছুদিন আগে দেশের বাইরে থেকে ফোনে চাঁদা দাবি করেছিলো মহসিন। মাথার উপরে তখনও ফ্যান ঘুরছিলো। তবুও মহসিনের সঙ্গে কথা বলার পর পুরো শরীর ঘেমে যায় তার। এমনিতেই নির্মাণ ব্যবসার অবস্থা ভালো না। তার মধ্যে কষ্টের আয় তুলে দিতে হবে সন্ত্রাসীর হাতে। না দিয়ে কোনো উপায় আছে বলে তার জানা নেই। এসব ভাবতে ভাবতেই ফোনে মহসিনের এক অনুসারীর কল। রিসিভ করতেই ওই প্রান্ত থেকে বলা হয়, ‘দাদা তো আপনাকে কল দিয়েছেন। যা করার তাড়াতাড়ি করেন। নইলে দাদার যে নির্দেশ তাই করবো, বুঝেন তো। টাকা না দিয়ে অন্য পথে হাঁটলে পুরো পরিবার ধ্বংস হয়ে যাবে।’ ওই ব্যবসায়ী জানান অবস্থা এমন হয়েছিলো যে, পুরোটা দিন কাটতো আতঙ্কে। মহসিনের লোকজন সারাক্ষণ অনুসরণ করতো। কোথাও গেলে ফোন দিয়ে বলতো- আপনি এখন অমুন জায়গায়। অমুক স্থানে দাঁড়িয়ে আছেন। আপনার পরনে এই রঙের শার্ট। বুঝেন তো আমরা কি করতে পারি। এখনো সময় আছে দাদা যা বলছে তা করেন। এসব কারণে তার পুরো পরিবারের সদস্যরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে যায়। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি সন্ত্রাসীদের চাঁদা দিয়েছেন কি-না স্বীকার করেননি।

গত বছরে পল্লবীর লালমাটিয়া এলাকায় মায়ের দোয়া নামক বেকারির মালিক সোহেলের কাছে ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। চাঁদা না পেয়ে কর্মচারীকে গুলি করে দুর্বৃত্তরা। মিরপুরের ৬ নম্বর বাজারের মুরগি ব্যবসায়ী জিয়াউদ্দিনের কাছেও ২০ লাখ টাকা দাবি করেছিলো এই চক্র। টাকা না পেয়ে তাকে গুলি করা হয়। এ ঘটনায় দুই ব্যবসায়ী পল্লবী থানায় অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাতের নামেও ঘটে চাঁদাবাজির ঘটনা। গত বছর কাফরুল থানা এলাকার এক বাড়ির মালিকের কাছে চাঁদা দাবি করা হয়েছিলো। ওই এলাকার ১৫ নম্বর সেকশনের ২৫ নম্বর রোডের বি ব্লকের ১৮ নম্বর প্লটে বাড়ি নির্মাণ করছিলেন তিনি। শাহাদাত বাহিনীর লোক পরিচয় দিয়ে চাঁদা দাবি করেছিলো তারা। গত বছরের ২১শে আগস্ট কাফরুল থানায় এ বিষয়ে মামলা হয়। এ ঘটনায় চার জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। একের পর এক হত্যাকাণ্ডে যার সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। দেশের ব্যবসায়ীদের কাছে একটি আতঙ্কের নাম শাহাদাত। পলাতক থাকা শাহাদাতসহ শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে প্রায়ই চাঁদা দাবি করা হয়। কিন্তু ঝামেলা এড়াতে অনেকেই পুলিশে অভিযোগ করেন না- বিষয়টি স্বীকার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি) শেখ নাজমুল আলম মানবজমিনকে বলেন, যারা ফোনে চাঁদাবাজি করে তাদের বেশিরভাগই প্রতারক। তারা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে চাঁদাবাজি করে। ইতিমধ্যে যাদের আমরা গ্রেপ্তার করেছি দেখা গেছে তাদের বেশিরভাগের বাড়ি মাদারীপুর। অনেকের নওগাঁ, খুলনা ও যশোর এলাকায়। এই চক্রের সদস্যরা সীমান্ত এলাকায় গিয়ে ভারতের মোবাইল টাওয়ার ব্যবহার করে হুমকি দেয়, চাঁদা দাবি করে। কখনও কখনও তারা ভিওআইপি (ভয়েস অব ইন্টারনেট প্রটোকল) নম্বর ব্যবহার করে চাঁদা দাবি করে। এসব ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা ঝামেলা এড়াতে অভিযোগ করতে চান না। তাদের অনুরোধ করবো অবশ্যই পুলিশকে অবগত করবেন। আমরা এ বিষয়ে কাজ করতে চাই। কোনোভাবেই সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ ও প্রতারকদের ছাড় দেয়া হবে না বলে জানান তিনি।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=83782