২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, বুধবার, ১০:২৭

আকিয়াব ও রাসিডংয়ে আটকে পড়া রোহিঙ্গাদের বাঁচার আকুতি

জাতিসঙ্ঘের সহায়তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে; প্রধান সড়কের পাশ থেকে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নেয়া হচ্ছে; শরণার্থীদের সাথে চলছে প্রতারণা

এপারে রোহিঙ্গা শরণার্থী আর মিয়ানমারে বাঙালি শরণার্থী। রোহিঙ্গা মুসলমানদের এই হলো ভাগ্য। ওপারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের যেসব ক্যাম্প রয়েছে সেসব ক্যাম্পের খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে মিয়ানমার সরকার। এমনকি যেসব ক্যাম্পে জাতিসঙ্ঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা সাহায্য-সহযোগিতা করে আসছিল তাও মিয়ানমার সরকারের নির্দেশে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বর্মি বাহিনী ও নাডালা বাহিনীর নির্যাতনে এপারে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা এ তথ্য জানিয়েছেন। এমনকি ওই সব ক্যাম্পে যারা আটকে আছেন তারা বর্তমানে নারকেল-সুপারি গাছের মাথার শাস এবং কলাগাছের থোড় খেয়ে বেঁচে আছেন বলে তাদের আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন। একাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী বলেছেন, তাদের আত্মীয়দের সাথে ফোনে কথা বলে তারা এই করুণ পরিস্থিতির বিষয়টি জানতে পেরেছেন। মোবাইল ফোনে তারা বলেছেন, ‘আঁরারে তোয়ারা বাচাইবারলাই কুচশিস গরো। তোয়ারাতো এত্তুগিয়োগই, তোয়ারাতো বাচিগিউগোই। এহন আরারারে মগত্তু বাচাইবারলায় কুচশিস করো।’ এ দিকে রাসিডংয়ের জেলা শহরেও এভাবে কয়েক হাজার মানুষকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে। স্বজনেরা অবরুদ্ধ হয়ে আছেনÑ এ কথা শুনে চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছেন এপারের আত্মীয়রা। তারা বলেছেন, এখনো লাখ লাখ মানুষ বিভিন্ন এলাকায় আটকে আছেন। তারা জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে আটকে পড়া রোহিঙ্গাদের বাঁচানোর আকুতি জানিয়েছেন।
এ দিকে যেসব শরণার্থী নাইক্ষ্যংছড়ি, উখিয়া, টেকনাফ ও কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন, বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ তাদের পাশে দাঁড়ালেও দুঃখ-দুর্দশা যেন কমছে না। গতকাল বিভিন্ন ক্যাম্প ঘুরে দেখা গেছে শনিবার রাত থেকে রোববার দুপুর পর্যন্ত প্রবল বর্ষণের কারণে অনেক ক্যাম্পের মানুষ দুই দিন নির্ঘুম রয়েছেন। রাস্তার পাশে যেসব অস্থায়ী ক্যাম্প গড়ে উঠেছিল তাদেরকে দূরে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তি উদ্যোগে হাজার হাজার মানুষ ত্রাণ দিলেও অনেকেই এখনো অভুক্ত রয়েছেন। শরণার্থীদের পুঁজি করে এ এলাকায় কিছু অতি মুনাফাখোর ও প্রতারক চক্রের সৃষ্টি হয়েছে। তারা অশিক্ষিত রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে নানা উপায়ে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। ত্রাণ দেয়ার নাম করেও অনেকে প্রতারণা শুরু করেছে রোহিঙ্গাদের সাথে। অনেক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়ার কথা বলে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। কেউ কেউ তাদেরকে ঘর তৈরি করার কথা বলে অর্থ দাবি করছে। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে যেসব হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে সেগুলোতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। প্রসূতিদের স্বজনেরা রোগীকে কাঁধে করে হাসপাতাল খুঁজে বেড়াচ্ছেন। ওপারে বর্মি বাহিনী ও নাডালা বাহিনীর হাতে আহত হয়েছেন এমন শত শত মানুষ চিকিৎসার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছেন। রোগীর চাপের কারণে অনেককে অর্ধেক চিকিৎসা দিয়ে হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়া হয় বলেও অভিযোগ মিলেছে। এ দিকে রাস্তাঘাটের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রশাসন। অপরাধীদের শাস্তি দিতে গতকাল বিভিন্ন এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালতকে টহল দিতে দেখা গেছে। রোহিঙ্গারা যাতে রাস্তায় উঠে মানুষকে বিরক্ত না করে সে জন্য মাইকিং করা হচ্ছে। কিন্তু তার পরও উখিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে এখনো হাজার হাজার রোহিঙ্গা অবস্থান করছেন। তাদের অনেকেই বলেছেন, ক্যাম্পে গেলে খাবার জোটে না; যে কারণে তারা রাস্তার পাশে এসে বসে থাকেন। তাতে কিছু হলেও খাবার জোটে।

এপারে রোহিঙ্গা শরণার্থী ওপারে বাঙালি শরণার্থী
বাংলাদেশ সীমানায় যারা রোহিঙ্গা শরণার্থী ওপারে মিয়ানমারে তাদেরই কিছু অংশ বাঙালি শরণার্থী হিসেবে বেশ কিছু ক্যাম্পে অবস্থান করছেন। বিশেষ করে যারা বিভিন্ন সময় বর্মি বাহিনী ও মগদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন তারা মিয়ানমার ফেরার পরই বাঙালি শরণার্থী বলে তাদের অনেককে বিভিন্ন ক্যাম্পে নেয়া হয়। একাধিক রোহিঙ্গা বলেছেন, ২০১৬ সালের অক্টোবরে যারা বাংলাদেশে এসেছিলেন তারা দেশে ফেরত যাওয়ার পরে তাদেরকে বাঙালি শরণার্থী বলে বিভিন্ন ক্যাম্পে নেয়া হয়। ওইসব ক্যাম্পে জাতিসঙ্ঘসহ বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার ত্রাণও যেত। আকিয়াবের জানাজা পাড়ার বাসিন্দা ইদ্রিসের স্ত্রী সেতারা বেগম গতকাল বালুখালী ক্যাম্পে বলেন, তারা ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর বাংলাদেশে এসেছিলেন। তাদের বাবা-মাসহ আত্মীয়স্বজনও ওই সময় বাংলাদেশে এসেছিলেন। কিন্তু সেতারা ও তার স্বামী সন্তানদের নিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে এ দেশে থেকে গেলেও তার বাবা-মাসহ আত্মীয়স্বজনের অনেকেই আকিয়াব চলে যান। কিন্তু আকিয়াব যাওয়ার পর তাদেরকে বাঙালি শরণার্থী হিসেবে সেখানের ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। ওখানে এরূপ অসংখ্য ক্যাম্পে রোহিঙ্গা মুসলমান রয়েছেন। যাদের বাপ-দাদাসহ আদি বাসস্থান ও জন্মস্থান মিয়ানমার হলেও তাদেরকে বাঙালি বলে ওইসব ক্যাম্পে নিয়ে রাখা হয়। সেতারা বলেন, জাতিসঙ্ঘসহ বিভিন্ন সাহায্যকারী সংস্থা ওই ক্যাম্পগুলোতে থাকা মুসলমানদের খাদ্যসহ বিভিন্ন সহযোগিতা করে আসছিল। কিন্তু এবারে নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড শুরুর পর ওই ক্যাম্পগুলোর সব সাহায্য বন্ধ করে দেয়া হয়। সেতারা বলেন, ওখানে যারা আছেন তাদের সাথে নিয়মিত মোবাইল ফোনে কথাবার্তা হচ্ছে। সাহায্য সহযোগিতা বন্ধ হওয়ার পর তারা না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। সেখানে পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ক্যাম্পের রোহিঙ্গা মুসলমানরা গাছের নরম অংশ খেয়ে বেঁচে আছেন। সেতারা বলেন, তার জানা মতে কয়েক হাজার মানুষ ওই ক্যাম্পগুলোতে আটকে আছেন। তাদের মধ্যে যারা বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করেছেন তাদের অনেকেই এখানে আসতে পারেননি। তাদেরকে বাংলাদেশে পৌঁছে দেয়ার কথা বলে মগ মাঝিরা অর্থকড়ি-স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে যায়। পরে মধ্য সাগরে এসে তাদেরকে নৌকা থেকে ফেলে দেয়। সেতারা বলেন, এই খবর শুনে ওইসব ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গা মুসলমানরা এখন আর ক্যাম্প থেকে বের হচ্ছেন না। কিন্তু খাবারের তীব্র সঙ্কট হওয়ায় তাদের না খেয়ে মারা যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। সেতারা বলেন, বাবা-মায়ের সাথে তার এক সন্তানও সেখানে রয়েছেন। তাদের কথা বলতে গিয়ে সেতারা কেঁদে ফেলেন। তিনি বলেন, তার বাবা-মা মোবাইল ফোনে তাকে বলেন, ‘আঁরারে তোয়ারা বাঁচাইবারলাই কুচশিস গরো। তোয়ারাতো এত্তুগিয়োগই, তোয়ারাতো বাচিগিউগোই। এহন আরারারে মগত্তু বাচাইবারলায় কুচশিস করো।’ (আমাদেরকে বাঁচানোর জন্য তোমরা চেষ্টা করো। তোমরাতো আগে গিয়ে বেঁচে গেছো। এখন আমাদের বাঁচানোর জন্য কিছু করো)। মিনারা নামের অপর এক রোহিঙ্গা বলেন, তারও কয়েকজন স্বজন ওই ক্যাম্পে রয়েছেন। তারাও ফোন করে এ কথা জানিয়েছেন। মিনারা তিন দিন হয় স্বামী হারিয়ে চার সন্তান নিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন। এ দিকে, মিয়ানমারের ওইসব ক্যাম্পে যারা আটকে আছেন তাদের উদ্ধারের জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর কাছে দাবি জানিয়েছেন এ পাড়ে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া মুসলমানরা। হোসেন আহম্মদ নামে এক রোহিঙ্গা বলেন, জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো এখনই পদক্ষেপ না নিলে মিয়ানমারের ওইসব ক্যাম্পে থাকা হাজার হাজার রোহিঙ্গা না খেয়ে মারা যাবে।
রাসিডং টাউনশিপে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা অবরুদ্ধ

একটি সূত্র জানিয়েছে, রাসিডং টাউনশিপে (জেলা শহর) কয়েক হাজার মানুষকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে মগরা। সেখান থেকে পালিয়ে আসা একাধিক রোহিঙ্গা বলেছেন, ওই এলাকায় তাদের আত্মীয়-স্বজনেরা রয়েছেন। তাদেরকে মোবাইলে ফোন করে জানিয়েছেন মগরা তাদের অবরুদ্ধ করে রেখেছে। তাদেরকে সহায়তা করছে বর্মি সেনারা। ইতোমধ্যে তাদের সব বাড়িঘর পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। মালামাল লুটপাট হয়েছে। এখন তারা নিঃস্ব অবস্থায় কয়েক পাড়ার মানুষ একটি স্থানে জড়ো হয়ে আছেন। তারা মোবাইল ফোনে স্বজনদের কাছে অনুরোধ করেছেন যাতে তাদেরকে ওই স্থান থেকে উদ্ধার করা হয়। তাদের এই আকুতি শুনে স্বজনেরা অনেকেই কেঁদে ফেলেন। তারা এই বলে আকুতি করেছেন, ‘আঁরারে তোয়ারা উদ্ধার গড়ো। আঁরারে মগে ঘিরিরাইক্কে। দুনিয়ার মুসলমান কউমড়ে জানাইডাও।’

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/253263