২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, বুধবার, ১০:২০

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন

অনিয়মে জর্জরিত প্রিমিয়ার ব্যাংক

সুদবিহীন ৬৮ কোটি টাকা ঋণে এম ইয়ার্ন ডায়িং পুনর্গঠন; অনিয়মিত ঋণগ্রহীতার সুদ মওকুফ

মো: মোস্তফা জামান প্রিমিয়ার ব্যাংকের বনানী শাখার একজন গ্রাহক। তিনি এম ইয়ার্ন ডায়িং নামে একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। নিয়ম অনুযায়ী কোনো গ্রাহকের ঋণ দেয়ার আগে ওই গ্রাহকের সিআইবি রিপোর্ট নিতে হয়। কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য কারণে ব্যাংক কোম্পানি আইন ২৭কক (৩) ধারা লঙ্ঘন করে সিআইবি রিপোর্ট না নিয়েই প্রতিষ্ঠানটিকে দীর্ঘ দিন যাবৎ ঋণ প্রদান করা হচ্ছে। আবার তিনি নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করেন না। নিয়ম অনুযায়ী ঋণ পরিশোধে নিয়মিত না হলে কোনো গ্রাহককে সুদ মওকুফ করা যায় না। কিন্তু মোস্তফা জামানকে ৫ কোটি ২৬ লাখ ৩ হাজার টাকার সুদ মওকুফ করা হয়েছে। শুধু সুদই মওকুফ করা হয়নি, বিনা সুদে ৬৮ কোটি ৩৫ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ শূন্য সুদে ৮ বছরের জন্য পুনর্গঠনের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। যেখানে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতিসহ নানা সঙ্কট দেখা দিয়েছে, সেখানে বিনা সুদে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ পুনর্গঠন করায় ব্যাংকটির লোকসানের পাল্লা আরো ভারী করে তুলেছে।

প্রিমিয়ার ব্যাংকের এ রকম নানা অনিয়মের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশদ পরিদর্শন প্রতিবেদনে। ব্যাংকটির ঋণ ও অগ্রিমের সাথে মিশিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ করা হয়েছে কর্মকর্তা কর্মচারীদের গ্র্যাটুইটির অর্থ। প্রভিডেন্ট ফান্ড আছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত কোনো সিএ ফার্ম দিয়ে নিরীক্ষিত করা হয়নি। অর্ধশাতাধিক ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্র্যাচুইটি ও প্রভিডেন্ট ফান্ডের দায় না মিটিয়েই বিদায় করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, খেলাপি হওয়া সত্ত্বেও খেলাপি করা হচ্ছে না ঋণ। উপরন্তুখেলাপি ঋণ শূন্য সুদে নবায়ন করে ব্যাংকের আয় স্ফীত করা হচ্ছে। আর এই প্রশ্নবোধক আয়ের ওপর ভিত্তি করে নগদ ডিভিডেন্টের মাধ্যমে জনগণের আমানতের অর্থ বের করে নেয়া হচ্ছে। এভাবে নানা অনিয়মের ভারে জর্জরিত হয়ে পড়েছে বেসরকারি খাতের প্রিমিয়ার ব্যাংক।

নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর এক বছরের আর্থিক বিবরণী বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বাধ্যতামূলক পাঠাতে হয়। ব্যাংক সরবরাহকৃত আর্থিক বিবরণী সঠিকতা যাচাইয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিশদ পরিদর্শন করা হয়। প্রিমিয়ার ব্যাংকের মোট শাখা রয়েছে ৯৯টি। এর মধ্যে আটটি ব্যাংক শাখাকে গত ৩১ ডিসেম্বর স্থিতিভিত্তিক বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল পরিদর্শন করে। এরই ভিত্তিতে পরিদর্শন দলের প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে। এতে প্রিমিয়ার ব্যাংকের অর্ধশতাধিক বড় অনিয়নের চিত্র উঠে এসেছে। এসব অনিয়মের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ারও সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশদ পরিদর্শন প্রতিবেদনে উঠে আসা নানা অনিয়মের খণ্ড চিত্র তুলে ধরা হলো।
লেনদেনহীন অদাবিসংক্রান্ত আমানত : বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশদ পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যাংকটি লেনদেনহীন অদাবিকৃত আমানতের হিসাব ঠিকমতো দেখাচ্ছে না। যেমন ব্যাংকের গত ৩১ ডিসেম্বর ভিত্তিক খুলনা শাখার বিশদ পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী ১০ বছর বা এর বেশি সময় ধরে লেনদেনহীন অদাবিকৃত আমানতের ১১টি বিভিন্ন হিসাবের বিপরীতে ছিল এক লাখ ৩৩ হাজার ৪৪৬ টাকা। কিন্তু সমগ্র ব্যাংকের এ অর্থের পরিমাণ ২৪টি হিসাবের বিপরীতে উল্লেখ করা হয়েছে ১০ টাকা ১৮ পয়সা, যা বিভ্রান্তিকর ও অবিশ্বাস্য বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। লেনদেনহীন অদাবিকৃত আমানতের বিষয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য পাঠানোর সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিষয়ে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করার সুপারিশ করা হয়েছে পরিদর্শন প্রতিবেদনে।

বিনিয়োগ সংক্রান্ত অনিয়ম : বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন না নিয়েই বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করেছে ব্যাংকটি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্থায়ী ব্যাংকটির বিনিয়োগ সংক্রান্ত বিবরণী হতে দেখা যায়, ব্যাংকটি বাংলাদেশ ফিক্সড ইনকাম স্পেশাল পারপাস খাতে দেড় শ’ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। এ খাতে বিনিয়োগ করতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হয়। আলোচ্য টাকার মধ্যে ব্যাংকটি ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের অনুমোদন গত ৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক হতে পেয়েছে। অথচ গত ৩১ ডিসেম্বর ভিত্তিক আর্থিক বিবরণীতে এ টাকা প্রদর্শন করা হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদনের আগে ব্যাংকটি কিভাবে বিনিয়োগ করেছে।
ক্যাপিটাল মার্কেট সংক্রান্ত বিনিয়োগসীমা : বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, কোনো ব্যাংকের মোট মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারবে না। যাদের ২৫ শতাংশের অধিক থাকবে তাদের গত বছরের ২১ জুলাইয়ের মধ্যে তা নামিয়ে আনার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল; কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রিমিয়ার ব্যাংক এ নির্দেশনা পরিপালন করেনি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা পরিপালনের জন্য ব্যাংকটিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

পুনঃতফসিলকৃত ঋণ পর্যালোচনা ও পরিলক্ষিত অনিয়মসমূহ : প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রিমিয়াম ব্যাংক থেকে সরবরাহকৃত বিবরণী মোতাবেক পূর্ববর্তী নির্দেশনার পর হতে বর্তমান পরিদর্শন তারিখ পর্যন্ত ব্যাংকটিতে মোট ৬২টি ঋণ হিসাবের বিপরীতে ৭৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা পুনঃতফসিল করা হয়েছে। ব্যাংকের পুনঃতফসিল ঋণ হিসাবসমূহ পর্যালোচনাকালে পরিদর্শন দল দেখতে পায়, বহু গ্রাহকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকটি আবেদনকারীদের ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি প্রাপ্তি সাপেক্ষে’ অনুমোদন করেছে, যা বিআরপিডি সার্কুলারের নির্দেশনার লঙ্ঘন। পরে দেখা যায়, কোনো কোনো আবেদন বাংলাদেশ ব্যাংক পরিবর্তিত আকারে অনুমোদন দিয়েছে। আবার কোনো কোনো আবেদন বাংলাদেশ ব্যাংক প্রত্যাখ্যান করেছে ও কোনো কোনো আবেদন পারিদর্শনকালীন পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়নি। অথচ গ্রাহককে প্রদত্ত অনুমোদনের কোনোরূপ পরিবর্তন হয়নি। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের আগেই ব্যাংক ঋণসমূহকে পুনঃতফসিল করে নিয়মিত হিসেবে প্রদর্শন করেছে।
ঋণের অশ্রেণীকরণে অনিয়ম : পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংক পরির্দশনের তারিখে স্থায়ী সম্পদের মূল্য ছিল ২৪০ কোটি ৬২ লাখ টাকা, যা ব্যাংকটির পরিশেধিত মূলধনের ৩৫ দশমিক ২৮ শতাংশ। বিআরপিডি সার্কুলার অনুযায়ী কোনো ব্যাংকের ধারণকৃত স্থাবর/স্থায়ী সম্পদের মোট পরিমাণ ব্যাংকটির ৩০ শতাংশের অধিক হবে না। আবার আলোচ্য সার্কুলার জারির সময় কোনো ব্যাংকের স্থাবর, অস্থাবর সম্পদের মোট পরিমাণ ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধনের ৩০ শতাংশের অধিক হয়ে থাকলে সে ব্যাংকটিকে আনুপাতিক হারে তার পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ বৃদ্ধির আগ পর্যন্ত নতুন করে কোনো স্থাবর/স্থায়ী সম্পদ ক্রয় না করার বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে। ব্যাংকটি স্থায়ী সম্পদের পরিমাণ আলোচ্য সার্কুলারে নির্দেশিত সীমা অতিক্রম করেছে।

গ্রাচ্যুইটি : পরিদর্শন তারিখে ব্যাংকটির সরবরাহকৃত তথ্য মোতাবেক গ্র্যাচুইটির জন্য আবশ্যিক সংস্থান ছিল ৩১ কোটি ১৯ লাখ টাকা ও রক্ষিত সংস্থান ছিল সাত কোটি ৬৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ এ খাতে প্রভিশন ঘাটতি ছিল ২৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। গ্র্যাচুইটির অর্থ ব্যাংকের ঋণ অগ্রিমের সাথে মিশে যাওয়ায় স্টাফদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট এ গ্র্যাচুইটি ফান্ডটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। অধিকন্তু গ্র্যাচুইটির সঠিক হিসাবায়ন শুধু এ্যাকচুয়ারি ফার্মই করতে পারে। পরিদর্শনে বলা হয়েছে, আজ পর্যন্ত ব্যাংকটি কোনো অ্যাকচুয়ারি ফার্ম দিয়ে অডিট করে এর স্টাফদের বিপরীতে প্রয়োজনীয় গ্র্যাচুইটির পরিমাণ নির্ধারণ করেনি। ব্যাংকটি ২০১৪ সাল হতে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সময়কালে ব্যাংকটি ছেড়ে চলে যাওয়া ২৫ জন সাবেক কর্মকর্তার এক কোটি ৮৬ লাখ ২৮ হাজার টাকার আর্থিক দায় সমন্বয় করেনি। প্রচলিত বিধি মোতাবেক কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী ব্যাংক ত্যাগ করলে তার সাথে ব্যাংকটির আর্থিক দায়দেনা সমন্বয় করা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যাংকটির আলোচ্য ২৫ জন সাবেক কর্মকর্তার দায়দেনা ব্যাংকটি দীর্ঘ দিন ধরে সমন্বয় না করে অসমন্বিত রেখে সাবেক কর্মকর্তাদের প্রতি অবিচার করেছে। অবিলম্বে এ্যাকচুয়ারি ফার্ম নিয়োগ করে ব্যাংকটিতে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিপরীতে প্রয়োজনীয় গ্র্যাচুইটির পরিমাণ নির্ধারণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একই সাথে গ্র্যাচুইটি যেটা রয়েছে তা সংরক্ষণ করতে ও এ্যাকচুয়ারি ফার্মের নিরীক্ষা প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগে পাঠাতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি গ্র্যাচুইটি ফান্ডের অধিকতর নিরাপত্তা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ট্রাস্ট গঠন করে এর জন্য এনবিআর হতে স্বীকৃতি সনদ গ্রহণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

প্রভিডেন্ট ফান্ড : ব্যাংকটির প্রভিডেন্ট ফান্ড আইনের ধারা ১৯(বি) মোতাবেক সিএ ফার্ম দ্বারা প্রতি বছরই তাদের তহবিলের হিসাব নিরীক্ষিত হওয়ার কথা। কিন্তু ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠার পর থেকে পরিদর্শন তারিখ পর্যন্ত কোনো সিএ ফার্ম দ্বারা নিরীক্ষা করা হয়নি। এর ফলে ব্যাংক দ্বারা হিসাবায়িত প্রভিডেন্ট ফান্ডের সঠিকতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেনি পরিদর্শন দল। প্রিমিয়ার ব্যাংক থেকে সরবরাহকৃত তথ্য মোতাবেক গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রভিডেন্ট ফান্ডের ২৫ কোটি টাকা ৫ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রে ও ১৬ কোটি ২০ লাখ টাকা স্থায়ী আমানত হিসাবে বিনিয়োগ করা হয়েছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার লঙ্ঘন। পরিদর্শন প্রতিবেদন প্রাপ্তির তিন মাসের মধ্যে অ্যাককচুয়ারি ফার্ম নিয়োগ করে ব্যাংকটির জন্য রক্ষিতব্য প্রভিডেন্ট ফান্ডের পরিমাণ নিরূপণ করতে ও অ্যাকচুয়ারি নিরীক্ষা প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
৫৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর আর্থিক দায় (প্রভিডেন্ট ফান্ড)-এর অর্থ সমন্বয় না করা : প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৪ সাল থেকে গত মে পর্যন্ত সময়কালে ব্যাংকটি ত্যাগ করে চলে যাওয়া ৩০ জন সাবেক কর্মকর্তার প্রভিডেন্ট ফান্ডের দায় দুই কোটি ৮৭ হাজার টাকা সমন্বয় করা হয়নি। প্রচলিত বিধি মোতাবেক কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী ব্যাংক ত্যাগ করলে তার সাথে ব্যাংকটির আর্থিক দায়দেনা সমন্বয় করা হয়। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকটির আলোচ্য ৩০ জন সাবেক কর্মকর্তার প্রভিডেন্ট ফান্ডের দায় দুই কোটি ৮৭ হাজার টাকা ব্যাংকটি দীর্ঘ দিন ধরে অসমন্বিত রেখে দিয়ে এর সাবেক কর্মকর্তাদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে। সাবেক ১৫ জন কর্মকর্তাদের সাথে বিদ্যমান এক কোটি ৮৬ লাখ টাকার অসমন্বিত দায় এবং ৩০ জন কর্মকর্তার দুই কোটি ৮৭ হাজার টাকার অসমন্বিত দায় সমন্বয় করে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করতে বলা হয়েছে।
শ্রেণীকৃত কর্মচারী ঋণ : ব্যাংকটির ৪১টি কর্মকর্তা ঋণের মধ্যে ৩৮টি ঋণ হিসাব থাকা দুই কোটি এক লাখ ৩৩ হাজার টাকা বিভিন্ন স্ট্যাটাসে শ্রেণীকরণযোগ্য হলেও সেগুলো শ্রেণীকরণ করা হয়নি। প্রতিবেদনে উল্লিখিত ৩৮টি কর্মচারী ঋণকে ছক মোতাবেক স্ট্যাটাস অনুযায়ী শ্রেণীকরণ করে চলতি বছরে আয় হতে এদের বিপরীতে সর্বমোট এক কোটি এক লাখ ৩৩ হাজার টাকা সংস্থান, সংরক্ষণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

বনানী শাখার অনিয়ম : এম ইয়ার্ন ডায়িং নামক একটি প্রতিষ্ঠানের দুইজন পরিচালক রয়েছে, যাদের একজন হলেন মোস্তফা জামান। কিন্তু প্রিমিয়ার ব্যাংকের বনানী শাখা থেকে মো: মোস্তফা জামানের সিআইবি না নিয়েই প্রতিষ্ঠানটিকে দীর্ঘ দিন ধরে ঋণ প্রদান করা হয়েছে, যা ব্যাংক কোম্পানি আইনের ২৭কক(৩) এর ধারা লঙ্ঘন।
আবার ঋণটি পর্যালোচনা করার সময় দেখা যায়, গ্রাহককে বড় অঙ্কের সুদ মওকুফ করা হয়। গ্রাহকের বিভিন্ন ঋণ পরিশোধে অনিয়মিত হওয়ার লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়েছে। যদিও গ্রাহক ঋণ পরিশোধে অনিয়মিত, তথাপি একাধিক মেয়াদি ঋণ একত্রিত করে একটি মেয়াদি ঋণে পরিণত করা ও সাতটি এসটিএল ঋণ হিসাব একত্রিত করে একটি মেয়াদি ঋণে পরিণত করা হয়। অনিয়মিত ঋণগ্রহীতাকে বারবার সময় বাড়ানো, ঋণ পুনর্গঠন ও ঋণ নবায়ন করে গ্রাহকের দায় বাড়িয়ে ব্যাংক আয় খাত স্ফীত করেছে। ঋণ পুনর্গঠন করে গ্রাহককে ৬৮ কোটি ৩৫ লাখ ৫৭ হাজার টাকা আট বছরে মেয়াদে শূণ্য সুদে অনুমোদন করা হয়েছে। এটি অস্বাভাবিক ও ব্যাংকিং নিয়মাচারের ব্যত্যয় বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অধিকন্তু পাঁচ কোটি ২৬ লাখ তিন হাজার টাকার সুদ মওকুফ করা হয়। নিয়ম অনুয়ায়ী একজন অনিয়মিত ঋণগ্রহীতা কখনো সুদ মওকুফের সুবিধা লাভ করতে পারে না। ঋণ পরিশোধে অনিয়মিত হওয়ার পরও গত বছরের ১৮ জুলাই আলোচিত গ্রাহককে ওডি সুবিধা দেয়া হয়। এদিকে ব্যাংকটি কয়েক বছর ধরে প্রভিশন ঘাটতিতে আছে। আর এ প্রভিশন সময়ের সাথে ক্রমবর্ধমান। ব্যাংক কখনো শূণ্য সুদে তহবিল সংগ্রহ করতে পারে না। এর একটি ন্যূনতম তহবিল খরচ আছে। এ ক্ষেত্রে বিনা সুদে দীর্ঘ মেয়াদে অনিয়িমত গ্রাহকের ঋণকে নিয়মিত করা ও বড় অঙ্কের সুদ মওকুফ করা পুরো ব্যাংক ব্যবস্থাপনার অদক্ষতার পরিচায়ক বলে মনে করা হচ্ছে। এম আই ইয়ার্ন ডায়িংয়ের পরিচালক মোস্তফা জামানের সিআইবি রিপোর্ট না করা বিষয়ে ঋণ প্রস্তাব তৈরির সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, সিআরএম ও শাখার ব্যবস্থাপক দায়ী এবং সিআইবি রিপোর্ট না দেখে গ্রাহককে ঋণ বিতরণ ব্যাংক কোম্পানি আইনের ২৭কক (৩)-এর লঙ্ঘন করায় ব্যাংক কোম্পানি আইননের ১০৯ (৪) ধারা মোতাবেক কেন সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না সে বিষয়ে ব্যাখ্যা তলব করার সুপারিশ করা হয়েছে পরিদর্শন প্রতিবেদনে।

পরিচালনা পর্ষদ : গত বছরের জানুয়ারি হতে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে ব্যাংকটিতে অনুষ্ঠিত মোট ২৪টি বোর্ড মিটিংয়ের মধ্যে তাইওয়ানের নাগরিক ইয়ে চেং মিন একটিতেও উপস্থিত থাকেননি। বাকি পরিচালকদের মধ্যে মিসেস ফৌজিয়া রেকজা বানুও একদিনও পর্ষদ সভায় উপস্থিত ছিলেন না। বাকিদের মধ্যে ফাইজা রহমান পাঁচ দিন, এ এইচ এম ফেরদৌস তিন দিন ও আরিফ আলম দ্বিতীয় দিন পর্ষদের মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন। দুইজন পরিচালকের পর্ষদের সভায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিতির জন্য পর্ষদে তারা কোনো ভূমিকা রাখতে পারেননি। পর্ষদে থেকে কোনো ভূমিকা না রাখা পর্ষদে না থাকারই সমুতল্য। দুইজন পরিচালক কেন কোনো পর্ষদ সভায় উপস্থিত থাকেনি সে বিষয়ে ব্যাখ্যা তলবের সুপারিশ করা হয়েছে পরিদর্শন প্রতিবেদনে।
ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা : ঝুঁকিব্যবস্থানা সংক্রান্ত বিভিন্ন অনিয়মের বেশির ভাগই নিষ্পত্তি করছে না প্রিমিয়ার ব্যাংক। যেমন ২০১৫ সালে ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত ১৯টি অনিয়ম শনাক্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু গত বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার একটি অনিয়মও নিষ্পন্ন করা হয়নি। সম্পদ দায় ব্যবস্থানা সংক্রান্ত ৩৭টি অনিয়মের তথ্য পায় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এ অভিযোগুলোর ১১টি এখনো নিষ্পত্তি করেনি প্রিমিয়ার ব্যাংক।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/253242