মিয়ানমারের আরাকান রাজ্য থেকে নির্বাচিত রোহিঙ্গা এমপিগণ।
২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, বুধবার, ১০:০৭

নাগরিকত্বের নানা দলিল রোহিঙ্গাদের হাতে

‘নাগরিক না হলে সু চিকে ভোট দিলাম কিভাবে’

‘যে পরিবারের জন্য মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গারা আজীবন ত্যাগ স্বীকার করেছে, সেই পরিবারের অং সান সু চি আমাদের তাড়িয়ে দিয়েছে। সেই কষ্ট এখন আমরা কোথায় লুকাব। ’ গতকাল মঙ্গলবার উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে কালের কণ্ঠকে বলছিলেন রোহিঙ্গা মোহাম্মদ হোসেন (৫০)। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পূর্ব রাখাইনের পাত্তরিকিল্লার বাসিন্দা মোহাম্মদ হোসেন (৫০) বলেন, ‘আমার বাপ-দাদারা ছিলেন বার্মার (মিয়ানমার) প্রতিষ্ঠাতা অং সানের কট্টর সমর্থক। পরে তাঁর কন্যা অং সান সু চিকেও সমর্থন করেন তাঁরা। এমনকি পরের প্রজন্মে আমরাও অং সান সু চির জন্য জীবনকে বাজি রেখে আন্দোলন-সংগ্রামও করেছি। দুর্ভাগ্য, এই সু চির কারণেই আমরা আজ দেশছাড়া। ’
মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ‘আজ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অং সান সু চি বলেছেন, আমরা যে মিয়ানমারের নাগরিক তার প্রমাণ কী? তাঁর এই বক্তব্য শুনে আমরা ভীষণ কষ্ট পেয়েছি। আমরা মিয়ানমারের নাগরিক না হলে সু চিকে কিভাবে ভোট দিলাম?’

রোহিঙ্গাদের মধ্যেও কিছু কিছু শিক্ষিত নাগরিক রয়েছেন। তাঁদের অনেকেই এখানে (বাংলাদেশ) অবস্থান করছেন। গতকাল সু চির ভাষণ শোনার পর অকেনেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
তাঁদেরই একজন এই মোহাম্মদ হোসেন। তাঁর বাবা সুলতান আহমদ, দাদা আবদুল জব্বার, দাদি সাইরুন্নেছা, নানি নূর বাহারের ভোটার আইডি কার্ডও পরিবারের সংরক্ষণে রয়েছে। নিজের ভোটার আইডি কার্ড দেখিয়ে মোহাম্মদ হোসেন বুক চাপড়ে বলেন, ‘এই ভোটার আইডি কার্ডই প্রমাণ দিচ্ছে আমরা যে মিয়ানমারের নাগরিক। আর এখন অং সান সু চি বলছে, আমরা বাঙালি। আমরা যদি বাঙালিই হতাম, তাহলে আমাদের বাপ-দাদারা ওই দেশের পরিচয়পত্র কিভাবে পেল বা কিভাবে নির্বাচনে ভোট দিল?’—এমন সব প্রশ্ন করেন মোহাম্মদ হোসেন।

 

মিয়ানমারের নাগরিক হিসাবে বিভিন্ন ধরনের রাষ্ট্রীয় পরিচয়পত্র সঙ্গে রয়েছে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের।

একই শিবিরে অবস্থানকারী মিয়ানমারের রাখাইনের কাউয়ানাং এলাকার আবু তাহের (৬৭) বলেন, ‘আমার বাবা প্রয়াত ছিদ্দিক আহমদ। ১৯৬২ সালে মিয়ানমার সরকার আমাকে একটি নাগরিকত্ব সনদ দেয়। ওই সনদের ওপরে লেখা ছিল ‘পেটাংজু মেমানেইয়ংদ থাতে ক্যাংপ্রু’ অর্থাৎ ‘মিয়ানমারের প্রকৃত নাগরিক। ’ যেটি দিয়েছিলেন অং সান সু চির বাবা আউং সান। আবু তাহের বলেন, ১৯৯০ সালে তাঁর স্ত্রী মরিয়ম খাতুনকে পরিচয়পত্র দেয় প্রশাসন। সেই পরিচয়পত্রে বলা হয় মরিয়ম বর্মার (মিয়ানমার) নাগরিক নয়, বাঙালি। আবু তাহের ওই সময় একটি মামলায় আড়াই বছর জেলে থাকায় স্ত্রীর জন্য বর্মার নাগরিকত্বের সনদ নিতে পারেননি। স্ত্রীকে দেওয়া এই পরিচয়পত্র দেখিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে আবু তাহের তাঁদের ভাষায় বলেন, ‘আমি ১৯৬২ সাল থেকে মিয়ানমারের প্রকৃত নাগরিক। যে নাগরিকত্ব সনদ খোদ সু চির বাবাই দিয়েছিলেন। আর এখন বলছেন আমরা রোহিঙ্গা বা মিয়ানমারের নাগরিক নই, বাঙালি। সু চি যে ইতিহাসের একজন জঘন্যতম মিথ্যাবাদী তার প্রমাণ দিয়েছেন এসব কথা বলে। এই সুচিই আমাদের সব কিছু থেকে বঞ্চিত করছেন। ’

আবু তাহের আরো বলেন, ‘আমাদের প্রতিটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান (হোকাট্টা) রোহিঙ্গা, এলাকায় এলাকায় রোয়াজিগিরি (সর্দার) নিয়োগ করা হতো রোহিঙ্গাদের। এমনকি মিয়ানমারের জাতীয় সংসদ সদস্যও ছিলেন আরাকানের অন্তত পাঁচজন রোহিঙ্গা নাগরিক। জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সু চি যে আমাদের রোহিঙ্গা বলে উল্লেখ করলেই সত্যকথন হতো। ’
জাতির উদ্দেশে সু চির দেওয়া ভাষণ শুনে চরমভাবে ক্ষুব্ধ হন ছালামত উল্লাহ (৩২)। তিনি মিয়ানমারের তুলাতলী গ্রামের বাসিন্দা। ছালামত উল্লাহ তাঁদের গ্রামে ২৫ আগস্টের ভয়াবহ নিধনযজ্ঞে চার সন্তান, স্ত্রী, শাশুরি ও চাচা শ্বশুরকে হারিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘হৈ চৈ শুনে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম। ততক্ষণে সেনা ও সন্ত্রাসীরা এসে বাইরে থেকে আটকে দিয়ে ঘরদোরে আগুন ধরিয়ে দেয়। আমার পরিবারের সাতজন সদস্য আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়। ’ এত বড় আঘাতের পর তিনি আজও ধাতস্থ হতে পারেননি। ছালামত উল্লাহ সু চিকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘তোঁরে আঁরা ভোট দিইয়্যে রে বড় ভুল গজ্জিলাম। তুঁই জেলত আছিলি দে ভালা আঁছিলাম আঁরা, শান্তিত আছিলাম। তুঁই জেলত্তুন বাইর হইয়্যেরে রোহিঙ্গার তিন ভাগর এক ভাগ কাটি ফেলাইয়ছ, আরেক ভাগ বন্দি গরি রাইক্কছ, আরেক ভাগ দেশ ছাড়া গইজ্জছ। অর্থাৎ তোমাকে আমরা ভোট দিয়ে বড়ই ভুল করেছিলাম। তুমি যে জেলের মধ্যেই ছিলে, তখন আমরা খুবই ভালো ছিলাম, শান্তিতে ছিলাম। তুমি জেল থেকে বের হওয়ার পর আমাদের রোহিঙ্গাদের তিন ভাগের এক ভাগ কেটে ফেলেছ, আরেক ভাগ বন্দি করে রেখেছ আবার বাকিদের দেশ ছাড়া করেছ। ’
মিয়ানমারের মংডু থানার কোয়াঞ্চিবং ইউনিয়নের নাপ্পুংজা পাড়ার বাসিন্দা আবদুল গাফফারের ছেলে ও কুতুপালং রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারী আশ্রয়শিবিরের সরদার (শেড মাঝি) রুহুল আমিন (৫৪) এসেছেন ১৫ বছর আগে। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘১৯৭৫ সালে আমার শাশুড়ি ছুরুজ্জামান (মৃত) মিয়ানমার সরকারের কাছ থেকে নাগরিকত্ব সনদ পান সেই দেশের নাগরিক হিসেবে। ১৯৭৮ সালেও তাঁকে একই কার্ড দেওয়া হয়। সেই কার্ড আমার স্ত্রী রহিমা খাতুনের কাছে সংরক্ষিত আছে। ’ রুহুল আমিন জানান, তিনি ১৯৭৮ সালে এসে ফিরে গিয়েছিলেন, পরে আবার আসেন।

আরেক রোহিঙ্গা কুতুপালং অনুপ্রবেশকারী আশ্রয়শিবিরের ১ নম্বর ব্লকের মাঝি আবদুল হাফিজ বলেন, ‘আজ (গতকাল) জাতির উদ্দেশে দেওয়া সু চির ভাষণকে আমরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলাম। তিনি জঘন্য মিথ্যা কথা বলেছেন। সু চি তাঁর দেওয়া বক্তব্যে দাবি করেছেন, ‘আমরা মিয়ানমারের নাগরিক নই এবং রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর কোনো ধরনের নির্যাতন, গণহত্যা বা বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়নি। যদি তাঁর বক্তব্যই সত্য হয় তাহলে বিশ্ববাসী ও বিশ্বের মিডিয়াকে রাখাইনে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হোক। তখন প্রমাণিত হবে কে সত্য বলছেন আর কে মিথ্যা কথা বলছেন। ’ আবদুল হাফিজ দুঃখ করে বলেন, ‘ওহ্ সু চি, আমরা তোমার বাবা অং সানকে সমর্থন দিয়েছিলাম প্রকাশ্যে। তুমি যখন জেলে ছিলে তখন আমরাই অগ্রভাগে আন্দোলন করেছিলাম। জেল থেকে বের হয়ে তুমি যখন শাসনভার নিলে তখন আমরা মনে করেছিলাম আমরা শান্তিতে থাকতে পারব। আসলে তুমি জেলে থাকলেই আমরা ভালো থাকতাম। ’
এক সপ্তাহ আগে কুতুপালং রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে আসা রাখাইনের দেওয়ান আলী গারতির বিল এলাকার রোহিঙ্গা নাগরিক মো. সানাউল্লাহ (৪৫) বলেন, ‘এই রকম মিথ্যা সু চি কেমনে বলে? তিনি কারাগার থেকে বের হওয়ায় আমরা দেশত্যাগে বাধ্য হলাম, লুণ্ঠনের শিকার হলাম, হত্যার শিকার হলাম, শোষিত হলাম, নির্যাতিত হলাম, জাতি হারালাম। ’

’৬২ সালে পাওয়া নাগরিক সনদ হাতে এক রোহিঙ্গা।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/09/20/544756