২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, বুধবার, ৯:৫৯

রোহিঙ্গাদের মোবাইলে ভয়ঙ্কর চিত্র

গত দু’একদিনে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের মোবাইলে ধারণ করা ভিডিও চিত্রে পিলে চমকানো এমন ধ্বংসস্তূপের বহু দৃশ্য দেখা গেছে। রাখাইন থেকে প্রাণ বাঁচাতে সম্প্রতি বাংলাদেশে আসা শত শত রোহিঙ্গা পথে পথে এমন ধ্বংসলীলা প্রত্যক্ষ করে আসছে বলে জানাচ্ছে। গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করছেন শতাধিক রোহিঙ্গা।

উখিয়ার আঞ্জুমানপাড়া সীমান্ত দিয়ে নাফ নদ পেরুলেই কোয়াংচিবং। রাখাইনের ওই এলাকাটি মংডুর তুম্বরুতে পড়েছে। সেখান থেকে পরিবারের ১৬ সদস্যের সঙ্গে বাংলাদেশে ঢুকেন ওই এলাকার অলি চানের ছেলে আমজাদ। তার বয়স ১৮। গত ২৬শে আগস্ট তার গ্রামে হানা দেয় কয়েকশ’ সেনা ও বৌদ্ধরা। তারা ৫০ থেকে ৬০ জনের দলে ভাগ হয়ে পাশের লাউয়ারপাড়া ও তুম্বরুসহ কয়েক দিক থেকে তাদের গ্রামে ঢুকে। বাড়িঘর লক্ষ্য করে গুলি করতে করতে আসে তারা। সেদিন ওই গ্রামের ৯ জন প্রাণ হারায়। বাকিরা প্রাণ বাঁচাতে কোয়াংচিবং পাহাড়ে গিয়ে লুকায়। একই পরিণতি থেকে বাঁচতে সে পাহাড়ে পাশের লাপ্পিয়া, মঠপাড়াসহ কয়েক পাড়ার অন্তত ৫ হাজার মানুষ আশ্রয় নেয়। রাতটি সেখানেই পার করে গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ। পরদিন শনিবার সকালে একটি বড় গাড়িতে চেপে আবার সেনা সদস্যরা কোয়াংচিবং আসে। সেদিন স্থানীয় এক মগডাক্তারসহ দুই শতাধিক সেনা ও রাখাইন আসে। এসেই কয়েকজন মেয়েকে ধরে গাড়িতে ওঠানোর চেষ্টা করে। তা প্রতিরোধে এক মেয়ের ভাই হাফেজ সাদ এগিয়ে যান। তাকে চোখে বেয়নেট ঢুকিয়ে দেয়। আরো এক যুবককে ধরে বেঁধে ফেলে। তা দেখে মেয়েদের উদ্ধারে কয়েক হাজার মানুষ এগিয়ে আসে। তখন সেনারা ওই দুজনকে গাড়িতে তুলে নিয়ে সরে পড়ে। মেয়েরা রক্ষা পায়। এমন বিভীষিকাময় পরিস্থিতি দেখে গত ২৭শে আগস্ট তারা বাংলাদেশে আসেন। সঙ্গে আসেন তার মৃত সৎ মা হাসিনার ছয় মেয়ে এবং নিজের ১০ সহোদর। তখনও তাদের গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়নি। এরপর থেকেই তারা বাংলাদেশে আছেন।
এরই মধ্যে গত শুক্রবার তিনি তার গ্রাম দেখতে এই সীমান্ত দিয়ে আবার মিয়ানমারে ঢুকেন। জনশূন্য গ্রামে অপেক্ষা করেন বিকাল পর্যন্ত। হাতে এনরয়েড মোবাইল সেট। তাতে তিনি তার ফেলে আসা গ্রামের চিত্র ভিডিও করেন। ধারণ করা বেশ কয়েকটি ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে তার গ্রাম বিরানভূমিতে পরিণত হওয়ার দৃশ্য। কোয়াংচিবংয়ের স্থানীয় দীর্ঘ মাদরাসাটি পুড়ে ছাই। এখানে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে দু’একটি পোড়া খুঁটি। কয়েকটি অর্ধ পোড়া খুুঁটিও চোখে পড়ে। পাশের পাকা মসজিদটিতে আগুন দেয়া হলেও তা পুড়েনি। আশপাশের সব গাছপালা পুড়ে গেছে। গাছের কাণ্ড-পাতা পুড়ে লাল হয়ে আছে।
অপর চার ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে, কোয়াংচিবংয়ের বিভিন্ন বসতভিটায় ছাই আর ছাই। কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। কোনো কোনো পুড়া ভিটায় ছাইয়ের উঁচু গাদা। তা কী জানতে চাইতেই বললেন, ধানের স্তূপ পুড়ে এমন হয়েছে। এক বাড়ির ভিডিও চিত্রে একটি নলকূপ ছাড়া আর কিছুই দাঁড়িয়ে নেই। বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে গ্রামটি। এসব ভিডিও চিত্রে মাত্র একটি জীবন্ত কুকুর চোখে পড়েছে। খাদ্যের সন্ধানে শুঁকছে এদিক-সেদিক।

এর আগে বাংলাদেশের ওই সীমান্ত থেকে একাধিক দিনে কয়েক দফায় যে বাড়িঘরগুলো পুড়তে দেখা গেছে, তা সেগুলোর কাছের দৃশ্য বলে নিশ্চিত করলেন আমজাদ।
তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে মানবজমিনকে বলেন, আমাদের গ্রামে একটি মসজিদ এবং কিছুটা নিচু জায়গা ও আড়ালে থাকা মৌলানা আতাউল্লাহর বাড়িই অবশিষ্ট আছে। বাকি ৬০টির বেশি ঘর পুড়ে ছাই। বিচ্ছিন্ন ঘরগুলোও পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে বীভৎস লাশ দেখার কথাও জানান তিনি।
এদিকে দুই সহোদর ও দুই মামাতো ভাইসহ গ্রামের ৬০ জনকে হারিয়ে গত ২৫শে আগস্ট ৯ সদস্যের পরিবার নিয়ে ঘর ছাড়েন জাকারিয়া। বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। বুথেডংয়ের মিনগিজির নয়াপাড়ায় তার বাড়ি। তাদের পাড়ায় সহস্রাধিক ঘর। হামলার সময় আগুন ও বোমায় কিছু ঘর পুড়লেও তিনি দেশ ছাড়ার সময় সব পুড়ে নি। পরে শুনেছেন অনেক ঘরই জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। তার গ্রামও এখন জনশূন্য বলে শুনেছেন। তবে ঘর ছাড়ার পর দীর্ঘ ২৩ দিনের পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসার পথে দেখেছেন অনেক কিছুই।

তিনি বলেন, গত ২৫শে আগস্ট সেনা হামলায় আমার বড় ভাই মোহাম্মদ আলী ও বাকের গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। দুই মামাতো ভাই মৌলভী সাজ্জাদ ও আনোয়ারসহ গ্রামের ৬০ নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ প্রাণ হারিয়েছে। আমি অন্তত অর্ধশতাধিক গ্রাম পুড়া দেখেছি। বিভিন্নস্থানে দেখেছি কয়েক হাজার লাশ।
তিনি তার দেখা রাখাইনের বর্তমান অবস্থার বর্ণনা দিয়ে বলেন, আমরা কয়েক হাজার মানুষ ঘর ছাড়ার পর থাকি পাহাড়ে। গত ২৮শে আগস্ট বাংলাদেশের দিকে রওয়ানা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেই। পরদিন যাত্রা শুরু করি। ২৯শে আগস্ট এসে পৌঁছি খিনিচিতে। তখনও ওই গ্রামটি পোড়ায় নি। আরো ছয়টি পরিবারসহ একঘরে আশ্রয় মেলে। এরপর ৩১শে আগস্ট খিনিচি থেকে আসি তটমবাজারে। বাজারটি না পুড়ালেও লুটপাট হয়েছে। আর পাড়ার সব ঘর পুড়ে গেছে। তবে একটি গোয়াল অক্ষত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। তা কিছুটা দূরে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছিল। পাড়ার মধ্যে আর একটি ওষুধের দোকানও অক্ষত দেখা গেছে। বাদ যায়নি গাছপালাও। তটমবাজারে বিভিন্ন বাড়ির উঠানে আমি ৮টা লাশ দেখেছি। এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ।

গত ১লা সেপ্টেম্বর আসি বৈদ্যপাড়ায়। আমরা দল বেঁধে হাঁটছিলাম। পাড়ায় দীর্ঘ সারিতে সব ঘর পুড়ে ছাই। মাঝে মাঝে ৭টি বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কিছুটা দূরে কয়েকটি খড়ের গাদা অক্ষত রয়েছে। সেখানেও একরাত পার করি। তিনটি ছাগল দেখা গেছে। বেশ দূরে রাখাইন বৌদ্ধদেরকে সেখানকার গরু নিয়ে যেতে দেখা গেছে। পরদিন পাহাড়ি পথ ধরে রওয়ানা দিলে পথে ৩টি শিশু ও ৬ জন প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের বীভৎস লাশ চোখে পড়ে। সবার শরীরে বেশ কয়েকটি করে কোপের চিহ্ন। হাত, বাহু, পা, মাথা বিচ্ছিন্ন মরদেহ। সেখানে পোড়া ঘরের চিহ্ন আড়াই শতাধিক হবে। এমন অবস্থায়ও আমরা সেখানে পোড়া ভিটেতে বিছানা পেতে এক রাত পার করি।

৩রা সেপ্টেম্বর সকালে আবার যাত্রা। আশপাশে কোনো ঘর এবং মানুষ দেখিনি। একটি দীর্ঘ খালের মাথায় একটি পাড়ায় পৌঁছি। সেখানে দু’গর্ভবতী নারীর লাশ খুবই বীভৎস অবস্থায় দেখা যায়। তাদের পেট চিরে ফেলা হয়েছে। গর্ভের সন্তানের অর্ধেক পেটের ভেতরে এবং অর্ধেক বাইরে। গর্ভের মৃত সন্তানের গায়েও ধারালো অস্ত্রের আঘাত। এছাড়া সেখানে ৬০টি লাশ চোখে পড়েছে। রয়েছে শিশুর লাশও। সেখানে ছাইয়ের নিচে আগুনগুলো দগদগে ছিল। উঠছিলো ধোঁয়া। কিছুটা এগিয়ে অপর যে পাড়ায় আসি সেখানে বাড়িঘর না পুড়ালেও এলাকাটি জনশূন্য। দু’একজন মানুষ আছে। এরপর গত ৪ঠা সেপ্টেম্বর রাতে ঢুকি পাহাড়ে। সেই পাহাড়ের ঢালাতেই দেখা গেছে তিন লাশ। এরপর একদিন পরে একটি খালের কাছে পৌঁছলে সেখানে ১২ লাশ চোখে পড়ে। তা খালের উপর ভাসছিলো। ফুলে উঠেছে। পচন ধরেছে। তখন মগ ও আর্মিরা মানুষ মারছে এমন খবর পেয়ে আমরা পাহাড়ের আরো গভীরে ঢুকে পড়ি। মগবিল থেকে গুলির শব্দ ও আগুন দেখে আমরা সেই আত্মরক্ষা করি। দুদিন পরে আসি মনুপাড়া। সেখানে অর্ধশতাধিক মানুষের লাশ এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কুকুরে খাচ্ছে। খাচ্ছে পোকামাকড়ে। পচা দুর্গন্ধে টেকা দায়। বাচ্চারা অসুস্থও হয়ে পড়েছে। বেশি লাশ চোখে পড়েছে পুনদাওপিংয়েও।

এছাড়া রবিঅংপাড়া, মাঝের পাড়া, মিনগিজি, নারায়ণসং, খানসামাপাড়া, টিপ্পি পাড়া, মগনামাপাড়া, মরিচ্যা, চওপ্রাং, হাজীপাড়া, কাদের পাড়া, জাদিপাড়া এবং ফতেয়ার পাড়াও বিরান হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে দ’ুএকটি ঘর দাঁড়িয়ে থাকলেও প্রায় ঘরবাড়ি আর নেই। তবে তিনি অন্তত পৌনে একশত পোড়া এবং অর্ধপোড়া পাড়া দেখেছেন বলে মানবজমিনকে জানিয়েছেন।
গত রোববার বাংলাদেশে আসা এই রোহিঙ্গার কথার সত্যতা স্বীকার করলেন মিয়ানমার থেকে আসা, রফিক, ছলেমা, হাসিনা, কাজলা, কালাম, ইউনুচসহ শতাধিক মানুষ। রাখাইন প্রদেশের আকিয়াবের মংডু, বুথেডং এবং রাথেডংয়ের শত শত গ্রাম এখন ধ্বংসস্তূপ বলে জানালেন তারা। সেখানেই তাদের সব অবলম্বন পুড়ে ছাই হয়েছে। স্বজনদের লাশে ভারি হয়ে উঠেছে আকাশ-বাতাস। অনেক প্রিয়জন হারিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচাতে তারা বাংলাদেশে আসার পর জনমানবশূন্য হয়ে পড়েছে গ্রামের পর গ্রাম।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=83750