২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, বুধবার, ৯:৫৩

এপির প্রতিবেদন

রাখাইনের মানচিত্র থেকে মুছে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা

২১৪ গ্রাম ধ্বংস : এইচআরডব্লিউ

প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ রোহিঙ্গা মুসলিমদের আবাসস্থল। রোহিঙ্গাদের সেই মাতৃভূমি পদ্ধতিগতভাবে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। তাদের আবাসস্থল ও ঘরবাড়িগুলো ধূলিস্যাৎ করে দেয়া হচ্ছে। মিয়ানমারের মানচিত্র থেকে আক্ষরিক অর্থেই রোহিঙ্গা মুসলিমদের নিশ্চিহ্ন করা হচ্ছে। বার্তা সংস্থা এপির এক প্রতিবেদনে মঙ্গলবার এ কথা বলা হয়েছে। এদিকে স্যাটেলাইট ছবির ভিত্তিতে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে ২১৪টি গ্রাম ধ্বংস করা হয়েছে।

এপি জানায়, গত মাসে বিদ্রোহীদের কয়েকটা হামলার জেরে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী ও সংঘবদ্ধ বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী প্রতিশোধ হিসেবে রোহিঙ্গাদের আবাসস্থলের হাজার হাজার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। নিরীহ-নিরস্ত্র রোহিঙ্গা মুসলিমদের নির্মমভাবে নির্যাতন-হত্যা করতে থাকে তারা। নিরাপত্তা বাহিনীর ভারি মারণাস্ত্রের গুলি ও বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর ছুরির নিচে থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় প্রায় সোয়া চার লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম। বাংলাদেশে অতীতে পালিয়ে আসা কয়েক লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে যোগ দিয়েছে নতুন এসব রোহিঙ্গা। তাদের এ দেশত্যাগ এখনও অব্যাহত রয়েছে।

রোহিঙ্গাদের এ দুর্দশা জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস জাতিগত নিধনযজ্ঞ বলে এর নিন্দা জানিয়েছেন। যারা বাংলাদেশে চলে এসেছে, তাদের আবার মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়া হবে বলে খুব কম লোকই বিশ্বাস করে। রোহিঙ্গাদের অবস্থার উন্নতির জন্য কাজ করা একটি সংগঠন আরাকান প্রজেক্টের পরিচালক ক্রিস লেওয়া বলেন, রোহিঙ্গাদের ইতিহাসে এটা সবচেয়ে শোচনীয় সংকট। বিপুল সংখ্যায় রোহিঙ্গাদের দেশত্যাগ ও দেশত্যাগের গতি বিবেচনা করে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী খুবই পদ্ধতিগত উপায়ে একে একে তাদের গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দিচ্ছে এবং সেটা এখনও অব্যাহত রয়েছে।’ রাখাইন রাজ্যের যে তিনটি জেলায় (মংডু, রথেডং ও বুথিয়াডং) রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর আংশিক বা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে, লেওয়া ও তার সংগঠন নিখুঁতভাবে সেসব গ্রাম ও বাড়িঘরগুলোর হিসাব রাখছে বলেন জানান।
রাখাইন প্রদেশের ওই তিনটি জেলায় একসময় ১১ লাখ রোহিঙ্গার বাস ছিল। মিয়ানমারের এই রোহিঙ্গাদের ইতিহাস এক বিড়ম্বনার। কয়েক শতাব্দী আগে থেকেই তারা এখানে বসবাস করে এলেও ১৯৮২ সালে দেশটির সামরিক সরকার তাদের নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নেয়। অস্বীকার করা হয় তাদের মৌলিক অধিকারগুলো। রাষ্ট্রহীন এক দুঃসহ জীবন কাটাতে থাকে তারা। অবশেষে তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু থেকেও বঞ্চিত করা হচ্ছে।

তবে জ্বালিয়ে দেয়া ঘরবাড়ির হিসাব রাখা খুব কঠিন কাজ বলে জানান লেওয়া। কেননা প্রতিনিয়ত শত শত ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত যাচাই করাও কঠিন। কারণ ওই এলাকায় বাইরের কারও প্রবেশের অনুমতি নেই। এ মুহূর্তে কোনো ত্রাণ সহায়তা গোষ্ঠী বা কোনো সাংবাদিককেও সেখানে যেতে দিচ্ছে না সেনাবাহিনী।
মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পাওয়া স্যাটেলাইট ছবিতে এসবের কিছু কিছু ধরা পড়েছে বলে জানিয়েছে সংস্থা দুটো। এসব ছবিতে দেখা যাচ্ছে, বিশাল এলাকা ও গ্রামগুলো থেকে বিশাল ধোঁয়ার কুণ্ডলী উড়ছে। আরাকান প্রজেক্ট তাদের পর্যবেক্ষণে দেখেছে, রাখাইন রাজ্যের অন্যতম জেলা মংডুর প্রত্যেকটা গ্রামেই আগুন দেয়া হয়েছে এবং পুরো মংডু এখন রোহিঙ্গাশূন্য। আরেকটি জেলা রথেডংয়ের উত্তরে পাঁচটি গ্রাম বাদে ২১টি গ্রাম পুরো জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে বুথিয়াডংয়ের আগে গ্রামগুলোও ব্যাপকভাবে শূন্য হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অনেকেই জানিয়েছে, তাদের গ্রাম ও বাড়িঘরগুলো জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে এবং যারা গ্রাম ছেড়ে যায়নি তাদেরকে পুড়িয়ে, গুলি করে ও জবাই করে হত্যা করা হয়েছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে ২১৪টি গ্রাম ধ্বংস করা হয়েছে। স্যাটেলাইটের ছবি পর্যালোচনা করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের এ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছে। সংস্থাটি বলছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নির্মূল করছে এবং সে জন্য জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে এর নিন্দা জানিড়ে প্রস্তাব পাস করা দরকার। একই সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওপর কিছু বিষয়ে অবরোধ আরোপের জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা কাউন্সিলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, আকাশ থেকে মৌসুমি মেঘ সরে যাওয়ার কারণে স্যাটেলাইটের চিত্রগুলো বেশ পরিষ্কারভাবে এসেছে। সেপ্টেম্বরের ১৬ তারিখে স্যাটেলাইট থেকে এ ছবিগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে বলে সংস্থাটি জানিয়েছে। ধ্বংসযজ্ঞ সম্পর্কে আগে যা জানা গিয়েছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যাপকতা উঠে এসেছে স্যাটেলাইটের সাম্প্রতিক ছবিগুলোতে। রাখাইনের মংডু এবং রথেডং এলাকায় হাজার-হাজার বাড়িঘর ধ্বংসের চিহ্ন দেখা গেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ফিল রবার্টসন বলেন, ‘রোহিঙ্গারা যাতে বাড়িঘরে ফিরতে না পারে সে জন্য মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা ছবিতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের প্রমাণ দেখা যাচ্ছে।’

https://www.jugantor.com/first-page/2017/09/20/156921