২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, বুধবার, ৯:৪০

মানবিক বিপর্যয় ভয়াবহ রূপ নিতে যাচ্ছে

সৈয়দ আবদাল আহমদ

উখিয়ার বালুখালীর একটি চিকিৎসাশিবির। একজন রোহিঙ্গা মা তার তিন-চার বছরের বড় ছেলের লাশ কোনোভাবে দাফন করেই ছুটে এসেছেন চিকিৎসাকেন্দ্রে কোলের ছোট ছেলেটিকে বাঁচাতে। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন নিয়ে ওষুধের জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছেন। শিশুটির জ্বর ও কাশি। এই মুহূর্তে তাকে বাঁচানোই তরুণী মায়ের প্রধান কর্তব্য। তাই বড় ছেলের করুণ মৃত্যুতে শোক করাও তিনি সম্ভবত ভুলে গেছেন। তার চোখে-মুখে অজানা শঙ্কা আর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।

পালংখালীর একটি ত্রাণসামগ্রী বিতরণকেন্দ্র। অঝোর ধারার বৃষ্টির মধ্যে এক কিশোরী মা পরনের শাড়ির আঁচলে জড়িয়ে কোনোভাবে এক হাতে কোলের শিশুকে ধরে রেখেছেন; অন্য হাতে ত্রাণের খাবারের প্যাকেট সংগ্রহের চেষ্টা করছেন। একই জায়গায় আরেক মা একবার বুক চাপড়াচ্ছেন, আরেকবার বৃষ্টিভেজা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আহাজারি করছেন হারানো স্বজনের জন্য। পাশের লোকজন জানান, রাখাইনে ওই নারীর স্বামী ও ছেলেমেয়েকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। চোখের সামনে দেখা স্বজনের নৃশংস খুনের দৃশ্য তিনি ভুলতে পারছেন না। প্রতিবেশীরা প্রাণ বাঁচাতে তাকেও তাদের সাথে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছেন। রোহিঙ্গা শরণার্থী এলাকাগুলোতে এখন এ ধরনের শত শত কাহিনী।

টেকনাফ উখিয়া হাইওয়ে এবং আশপাশ এলাকায় বেশির ভাগ নারী ও শিশু-কিশোরকে দেখা গেল, কোনো সংগঠন ত্রাণ নিয়ে এলেই সেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়তে। কেউ দৌড়াচ্ছেন, কেউ উ™£ান্তের মতো ছুটছেন। একমুঠো খাবারের জন্য কী প্রাণান্ত চেষ্টা, নিজ চোখে না দেখলে উপলব্ধি করার উপায় নেই।

এ এলাকা এখন যেন রোহিঙ্গা জনপদে রূপ নিয়েছে। রোববার আমরা যখন পালংখালী, থাইংখালী, বালুখালী এবং কুতুপালং এলাকায় পৌঁছি, তখন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টির পানি আর রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কান্না যেন একাকার হয়ে গিয়েছিল। পলিথিনশিট দিয়ে কিছু ঝুপড়ি তৈরি হয়েছে। এগুলোকে কোনোভাবে আশ্রয়শিবির বলা যায় না। লাখো শরণার্থীকে দেখেছি, বৃষ্টিতে ভিজে হাহাকার করছেন। কী করুণ মর্মান্তিক দৃশ্য!

কক্সবাজারের সিভিল সার্জন সাংবাদিকদের ব্রিফিং করে জানিয়েছিলেন, শরণার্থীশিবিরগুলোতে ৩২টি মেডিক্যাল টিম কাজ করছে। কিন্তু আমরা পালংখালী ও বালুখালীর বিস্তীর্ণ এলাকা ঘুরে সরকারি মেডিক্যাল টিম কাজ করতে দেখিনি। রেডক্রিসেন্ট, গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল এবং ডক্টরস্ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) চিকিৎসা ক্যাম্পে অসুস্থ নারী ও শিশুদের চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতে দেখা গেছে। ডা: মোস্তাক রহিম স্বপন ও অধ্যাপক ডা: এ জেড এম জাহিদ হোসেন জানান, তারা স্বাস্থ্যসেবা পরিচালনা করতে গিয়ে গত এক সপ্তাহের অভিজ্ঞতায় লক্ষ করেছেন, ৭০ শতাংশ রোহিঙ্গা শিশুই অসুস্থ এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। এরপরই রয়েছেন নারী শরণার্থীরা। প্রতিদিন তাদের ক্যাম্পে পাঁচ থেকে সাত হাজার মানুষকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। বেশির ভাগই শিশু ও নারী। নারীদের মধ্যে আবার অন্তঃসত্ত্বাও রয়েছেন অনেক। গণস্বাস্থ্যের কর্মীরাও একই কথা জানান। ডায়রিয়া, আমাশয়, সর্দি-জ্বর-কাশি, শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ ও নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে শরণার্থীরা।
আমরা লক্ষ করলামÑ মানবিক আবেদনে সাড়া দিয়ে ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম (ডব্লিউএফপি) এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা, সংগঠন এবং জেলা-উপজেলা থেকে ব্যক্তি উদ্যোগে মানুষ ত্রাণসামগ্রী নিয়ে ওইসব এলাকায় যাচ্ছে। কিন্তু সুষ্ঠুভাবে শরণার্থীদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছাতে পারছে না। ট্রাক বা লরি থেকে ত্রাণের প্যাকেট নিক্ষেপ করে দিতে গিয়ে বিশৃঙ্খল অবস্থা এবং হুড়োহুড়িতে মৃত্যুর ঝুঁকি পর্যন্ত সৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তায় থাকা শরণার্থীরা কিছু ত্রাণসামগ্রী পেলেও ভেতরে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের কাছে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছতে পারছে না। এভাবে বৈষম্যের সৃষ্টি হচ্ছে। ত্রাণ পরিচালনাকারী সংগঠনগুলোকে সমন্বয়ের মাধ্যমে কার্যক্রম চালাতে যেভাবে গাইড করা প্রয়োজন সে প্রচেষ্টা নেই। প্রশাসনের লোকজন এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিও খুবই কম। এলাকাগুলোতে শৌচাগার ও বিশুদ্ধ পানির নেই ব্যবস্থা। শরণার্থীরা খোলা আকাশের নিচে, ঝোপঝাড়, পাহাড় ও জঙ্গলে প্রাকৃতিক প্রয়োজন মেটাচ্ছেন। নারীদের ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছেÑ এ প্রয়োজন মেটানোর জন্য তাদের সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে। ত্রাণকার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য ব্যবস্থাপনার অভাবকেই সবচেয়ে বড় সঙ্কট বলে মনে হয়েছে। এই মুহূর্তে শরণার্থীদের জন্য অগ্রাধিকার কী, সেই বিষয়টির প্রতিও নজর দেয়া হচ্ছে না। সরকার থেকে ঘোষণা করা হয়েছে, কুতুপালং ও বালুখালী এলাকায় দুই হাজার একর জায়গায় পরিকল্পিত আশ্রয়শিবির স্থাপন করা হবে। এই পরিকল্পিত আশ্রয়শিবির দ্রুত গড়ে তোলা এবং ত্রাণকার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য জরুরি ভিত্তিতে এখনই সেনাবাহিনীকে নিয়োগ করা প্রয়োজন। বিশেষ করে সেনাবাহিনীর মেডিক্যাল কোর এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কোরকে সর্বাগ্রে ঘটনাস্থলে দায়িত্ব দেয়া প্রয়োজন। এ কাজে সেনাবাহিনীর দক্ষতা পরীক্ষিত। তারা কাজ শুরু করলে স্বল্পতম সময়ে পুরো ত্রাণকার্যক্রম শৃঙ্খলার মধ্যে চলে আসতে পারে।

মিয়ানমারের রাখাইনে ২৫ আগস্ট থেকে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর যে গণহত্যা ও জাতিগত নিধন চলছে তার ফলে প্রাণ বাঁচাতে টেকনাফ-উখিয়ায় নতুন করে প্রায় পাঁচ লাখ শরণার্থী ঢুকে পড়েছে। জাতিসঙ্ঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে যে, রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে। গত রোববার মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং লেইংয়ের নতুন করে হুঙ্কার জাতিসঙ্ঘের এ আশঙ্কাকে আরো জোরালো করে তুলেছে। ২৫ আগস্টের পর স্রোতের মতো রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢুকেছে। এখনো প্রতিদিন ১০-১৫ হাজার করে শরণার্থী আসছে। একইভাবে ইউনিসেফ থেকে আশঙ্কা করা হয়েছেÑ দুই লাখ রোহিঙ্গা শিশু স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এসব শিশু শরণার্থী শারীরিক ও মানসিকভাবে এখন বিপর্যস্ত। তাই বসে থাকার সময় নেই। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিপর্যয় দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রোধ করতে না পারলে তা ভয়াবহ রূপ নিতে বাধ্য। মনে রাখতে হবে, ১৯৭৪ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের জন্য ত্রাণ, বিশেষ করে খাদ্যসামগ্রীর অভাব মুখ্য ছিল না। ওই সময়ও প্রচুর ত্রাণসামগ্রী এসেছিল। দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির জন্য প্রধানত দায়ী ছিল ব্যবস্থাপনার অভাব। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন পরে বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করে এর সত্যতা তুলে ধরেন। এবারো লক্ষ করা গেছে সঙ্কট ব্যবস্থাপনার বড় ধরনের ঘাটতির। দক্ষ ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্ব দিয়ে তাই নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনব্যবস্থা এবং পরিকল্পিত আশ্রয়শিবির দ্রুত গড়ে তুলতে হবে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগকে এখনই শত শত নলকূপ বসানোর ব্যবস্থা করতে হবে। রোহিঙ্গা মুসলমানরা প্রাণ বাঁচাতে তাদের দেশ ও ভিটেমাটি ছেড়ে এসেছে। দেশছাড়া এসব অসহায় মানুষকে বাঁচাতে এবং মানবিক বিপর্যয় রোধ করতে না পারলে জাতি হিসেবে আমাদের কঠিন মূল্য দিতে হতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/253146