১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ১০:৩৩

দেশীয় মানবাধিকার ও সামাজিক সংগঠন ৯,০৯২

ছোট ইস্যুতে সরগরম রোহিঙ্গা ইস্যুতে চুপ!

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর চলমান গণহত্যা, তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গন সোচ্চার হয়ে উঠলেও মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে বাংলাদেশের মানবাধিকার ও সামাজিক সংগঠনগুলো। চলমান রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে দেশের মানবাধিকার ও সামাজিক সংগঠনগুলোর কোনো কার্যক্রম নেই। ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন শুরুর পর ২০ দিন পেরিয়ে গেলেও রাজপথে কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম নেই মানবাধিকার সংগঠনগুলোর। হাতে গোনা দু-একটি সংগঠন শুধু বিবৃতি দিয়ে তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে। অথচ এসব মানবাধিকার ও সামাজিক সংগঠন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মানবাধিকারের কথা বলে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা নিয়ে আসছে দেশে।
দেশে মানবাধিকার ও সামাজিক সংগঠনের সংখ্যার সম্প্রতি একটি জরিপ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। তাতে দেখা গেছে, দেশে ৯ হাজার ৯২টি মানবাধিকার ও সামাজিক সংগঠন রয়েছে। এর মধ্যে শহরকেন্দ্রিক কাজ করে তিন হাজার ১৮১টি সংগঠন এবং পাঁচ হাজার ৯১১টি সংগঠন কাজ করে গ্রামে। এনজিও ব্যুরো, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তর থেকে তথ্য নিয়ে পরিচালিত জরিপে আরো দেখা গেছে, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগে মানবাধিকার ও সামাজিক সংগঠনের সংখ্যা বেশি। এর মধ্যে ঢাকায় আছে তিন হাজারের মতো সংগঠন, চট্টগ্রামে আছে প্রায় দেড় হাজার। মানবাধিকার ও সামাজিক সংগঠনের বাইরে আড়াই হাজার বেসরকারি সংস্থা আছে বলে বিবিএসের জরিপে উঠে এসেছে।
জরিপের ফল শিগগিরই প্রকাশ করার কথা রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের অভ্যন্তরে ছোটখাটো কোনো ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে সরব হয়ে ওঠে মানবাধিকার ও সামাজিক সংগঠনগুলো। অথচ দেশে বড় আকারের প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা মানবাধিকার লঙ্ঘন হলে চুপ থাকে এসব সংগঠন। গত বছর জুলাইয়ে রাজধানীর হলি
আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর এসব সংগঠনের কোনো ভূমিকা দেখা যায়নি। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তাদের রাজপথেও চোখে পড়েনি। এমনকি যে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কোনো রাজনীতি নেই, আওয়ামী লীগ-বিএনপির রং নেই, সেখানেও নিশ্চুপ মানবাধিকার সংগঠনগুলো। চলমান রোহিঙ্গা সংকটে দেশের গণমাধ্যম, সরকারি দল ও বিরোধী দল সরব হলেও সংগঠনগুলোর এমন নীরব ভূমিকাকে লজ্জাকর বলে উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
এত বড় মানবিক বিপর্যয়ের পরও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কেন এমন নীরবতা—এমন প্রশ্নে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, সবার স্বার্থ জড়িত। তা ছাড়া সংগঠনগুলো দুই ভাগে বিভক্ত। কোনো সংগঠন হয়তো আওয়ামী লীগের অনুগত। কেউ আবার বিএনপির অনুগত। আর দুই দলের মধ্যে বিভাজন এত বেশি যে এ কারণে দেশের বড় কোনো ইস্যুতেও মানবাধিকার সংগঠনগুলো এক হতে পারে না।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে সরকারের এগিয়ে আসা উচিত। দলমত-নির্বিশেষে সবাইকে এক করে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা উচিত।

দেশের মানবাধিকার ও সামাজিক সংগঠনগুলোর এমন নীরবতায় হতবাক এবং বিস্মিত মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বিশ্ববিবেক জেগে উঠলেও আমরা জেগে উঠতে পারিনি। আমাদের দেশের সংগঠনগুলো কি এখনো ঘুমাচ্ছে? এত বড় একটি ঘটনা ঘটল, এখানে দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে সবার এগিয়ে আসা উচিত। এখানে কোনো র্ধম নেই, বর্ণ নেই। এটা মানবিকতার প্রশ্ন। কোনো স্বার্থ জড়িত থাকতে পারে না। ’
বিবিএস বলছে, স্বাধীনতার আগে দেশে এত মানবাধিকার ও সামাজিক সংগঠনের অস্তিত্ব ছিল না। স্বাধীন হওয়ার পর থেকে দেশের আনাচকানাচে গড়ে ওঠে অসংখ্য সংগঠন। দেখা গেছে, দেশ স্বাধীনের আগে মানবাধিকার ও সামাজিক সংগঠন ছিল মাত্র ৪১০টি। সেটি এখন ফুলেফেঁপে ৯ হাজারে উন্নীত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি সংগঠনের জন্ম হয়েছে ২০০১ থেকে ২০১০ এই সময়ে। প্রায় দুই হাজার ৯০০ সংগঠনের জন্ম হয়েছে এ সময়ে। ১৯৯১ থেকে ২০০০—এই সময়ে জন্ম হয় দুই হাজার ৮০০ সংগঠনের। এসব সংগঠনের সঙ্গে এখন এক লাখের মতো মানুষ জড়িত। বিবিএসের যুগ্ম পরিচালক জিয়াউদ্দিন আহমেদ বলেন, ৯ হাজার ৯২টি সংগঠনের বার্ষিক আয় হয় ৪৯০ কোটি টাকা। এদের বার্ষিক ব্যয় হয় ৩১৮ কোটি টাকা। উদ্বৃত্ত থাকে ১৭২ কোটি টাকা।

বিবিএসের জরিপের সূত্র ধরে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাংলাদেশে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে থাকে আইন ও সালিশ কেন্দ্র, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন, বাংলাদেশ মানবাধিকার সমন্বয় পরিষদ, বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা, অধিকার, ইনস্টিটিউট অব ডেমোক্রেটিক রাইটস, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামসহ অনেকে। আর বিদেশি সংস্থার মধ্যে কাজ করছে টিআইবি, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, কেয়ার, অ্যাকশনএইড, ইউনিসেফসহ অনেকে। এসব সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কেউ কেউ রোহিঙ্গাদের ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। কেউ কেউ বিবৃতি তৈরি করেছেন। শিগগিরই গণমাধ্যমে পাঠাবেন। কেউ আবার কক্সবাজারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

সব সংগঠন এক হয়ে রাজপথে কেন নামছে না—এমন প্রশ্নে মানবাধিকার সংগঠনের নেতারাও মনে করেন, ঐকমত্যের ভিত্তিতে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা উচিত। কিন্তু সেটা হয়ে উঠছে না। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার চেয়ারম্যান সিগমা হুদা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে রোহিঙ্গাদের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করেছি। তাদের জন্য আরো কী করা যায়, আমরা সে পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছি। ’
বাংলাদেশ মানবাধিকার সমন্বয় পরিষদের সভাপতি ও রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে গণহত্যা চলছে, আমরা তার বিরুদ্ধে বিবৃতি তৈরি করেছি। সেটা যত দ্রুত সম্ভব গণমাধ্যমে পাঠাব। আমরা মনে করি, এটা মানবিকতার বিরুদ্ধে অপরাধ। এখানে ধর্ম-বর্ণ বিচার্য নয়। রোহিঙ্গারাও মানুষ। তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। মানবাধিকারের প্রশ্নে সবাইকে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। ’
মানবাধিকার ও সামাজিক সংগঠন কেন এক হতে পারছে না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা মাত্র নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উঠেছি। আমরা জাতিগতভাবে এখনো পরিপূর্ণ হয়ে উঠিনি। সময় লাগবে। ’ বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের পরিচালক রুহুল আমিন কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁরা রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটি বিবৃতি দিয়েছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধনও করেছেন। এর বাইরে আর কোনো কার্যক্রম নেই তাঁদের। তবে তিনিও মনে করেন, মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে সবার এক হওয়া জরুরি।

বাংলাদেশে মানবাধিকার ও সামাজিক সংগঠনের কার্যক্রম নিয়ে সম্প্রতি প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কাজ কী তা তারা নিজেরাই জানে না। দেশীয় যেসব মানবাধিকার সংগঠন রয়েছে, তাদের বেশির ভাগ কারো না কারো স্বার্থ হাসিলের জন্য কাজ করে। আবার অনেকেই অর্থ উপার্জনের জন্য মানবাধিকার সংগঠনের নামে এক ধরনের ব্যবসা করে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো নানা সময় নানা দিবস পালন করে। অথচ দেশের স্বার্থের বেলায় তারা একেবারেই নীরব। আন্তর্জাতিক যেসব মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশের নানা বিষয়ে নাক গলায় তাদের ব্যবসায়ী হিসেবে আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, এরা তো গায়ে মানবাধিকারের লোগো লাগিয়ে লবিস্ট হিসেবে কাজ করে।

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/09/19/544358